ধর্মীয় গ্রंथে ইতিহাস কখনো কখনো প্রতীকী ভাষায় তুলে ধরা হয়। কিন্তু কোরআনের কিছু ঐতিহাসিক ঘটনা নিখুঁতভাবে পরবর্তী সময়ের প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে। ফেরাউনের দেহ সংরক্ষণ কোরআনে বলা হয়েছে— “আজ আমি তোমার দেহকে সংরক্ষণ করবো, পরবর্তী যুগের জন্য নিদর্শন হিসেবে।” মিশরের ফেরাউন মুমিনাহ ছিল অজানা, কিন্তু ১৮৯৮ সালে মমি আবিষ্কার হলে— •শরীর অক্ষত •লাল সাগরে ডুবে মৃত্যুর প্রমাণ •কোরআনের বক্তব্যের যথার্থতা নিয়ে গবেষকদের মধ্যে আলোড়ন তৈরি হয় রোমানদের পরাজয়–বিজয় ভবিষ্যদ্বাণী সূরা রূম–এ বলা হয়— “রোমানরা পরাজিত হলেও শীঘ্রই বিজয়ী হবে।” ইতিহাস দেখায়— •পারসিকদের কাছে রোমানরা পরাজিত হয়েছিল •ঠিক নয় বছরের মাথায় তারা আবার বিজয় অর্জন করে এ ঘটনাটি কোরআনের বর্ণনার সাথে বিস্ময়করভাবে মিলে যায়। লোহা—মহাজাগতিক উৎস থেকে আগত কোরআনে বলা হয়েছে— “লোহা নাযিল করেছি”—অর্থাৎ আনা হয়েছে। বিজ্ঞান দেখায়— • পৃথিবীর কেন্দ্রের লোহা উল্কাপিণ্ড থেকে এসেছে • সুপারনোভার বিস্ফোরণে লোহা উৎপন্ন হয় • স্পেস ডাস্ট হয়ে পৃথিবীতে পড়ে এটি সপ্তম শতকের জ্ঞানের বাইরে। ফুটনোট: ১. British Museum Egyptology Papers ২. Roman–Persian War Chronicles ৩. Journal of Astrophysics লেখক : এম. ইমরান, বিশ্লেষক ও গবেষক
মানুষের আঙুলের ছাপ। আজ এটি পরিচয়ের সর্বাধিক নির্ভরযোগ্য মাধ্যম। কিন্তু কোরআনে শতাব্দী আগেই বলা হয়েছিল— “আমি মানুষের আঙুলের ডগা পর্যন্ত পুনর্গঠন করতে সক্ষম।” এই উক্তি আজ বিজ্ঞানসম্মতভাবে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ফিঙ্গারপ্রিন্ট কেন অনন্য? আধুনিক forensic science দেখায়— • পৃথিবীতে কোনো দুই মানুষের আঙুলের ছাপ এক নয় • যমজ সন্তানেরও নয় • আঙুলের ডগায় ৪০টির বেশি অনন্য প্যাটার্ন থাকে • মৃত্যুপরবর্তী অবস্থাতেও ফিঙ্গারপ্রিন্ট শনাক্তযোগ্য আঙুলের ডগার এই অনন্যতা ১৯শতকেও অজানা ছিল। সপ্তম শতকে তো কল্পনাই অসম্ভব। ফিঙ্গারপ্রিন্ট: অপরাধ বিজ্ঞান বিপ্লব • অপরাধী শনাক্ত • জীবিত–মৃতদেহ শনাক্ত • বর্ডার সিকিউরিটি • মিলিটারি আইডেন্টিফিকেশন সবই আজ আঙুলের ডগা ভিত্তিক। কেন কোরআনের উল্লেখ বিশেষ? কারণ— • আঙুলের ডগা মানব শরীরের অন্যতম ক্ষুদ্রতম অংশ • এতে পরিচয়ের তথ্য সংরক্ষিত • আধুনিক বায়োমেট্রিকস–এর ভিত্তি ফিঙ্গারপ্রিন্ট কোরআনের বর্ণনা আধুনিক forensic identification system-এর সাথে উল্লেখযোগ্য সামঞ্জস্য রাখে। ফুটনোট: ১. FBI Forensic Handbook ২. Journal of Identity Science লেখক : এম. ইমরান, বিশ্লেষক ও গবেষক
সমুদ্র পৃথিবীর ৭১ শতাংশ এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। কিন্তু সমুদ্রের গভীর রহস্য মানুষ সামান্যই জানে। কোরআনে সমুদ্রের মধ্যে ‘প্রতিবন্ধক পর্দা’ বা ‘অদৃশ্য বাধা’র কথা কয়েকবার এসেছে—যা শতাব্দী পরে মেরিন সায়েন্সে সত্য বলে প্রমাণিত হয়। লবণাক্ত ও স্বাদু পানির বিভাজন কোরআনে বলা হয়— দুই সমুদ্র পাশাপাশি বয়ে চলে, কিন্তু তাদের মাঝে আছে এক প্রতিবন্ধক—যা তারা অতিক্রম করে না। বিজ্ঞান দেখায়— • নদীর স্বাদু পানি যখন সমুদ্রে মেশে, তখন ঘনত্বের পার্থক্যের কারণে “halocline barrier” বা “salinity barrier” তৈরি হয় • দুই পানি সম্পূর্ণ মিশে না মনে হয় যেন এক অদৃশ্য পর্দা তাদের আলাদা করে রেখেছে। সমুদ্রের অভ্যন্তরীণ তরঙ্গ (Internal Waves) আজকের oceanography দেখিয়েছে— • সমুদ্রে এমন তরঙ্গ আছে যা উপরে দেখা যায় না • এগুলো ২০০–৩০০ মিটার নিচে ঘটে • এগুলো আলোর প্রবেশ ঠেকায় • দুই স্তরের পানি মিশতে বাধা দেয় কোরআনে সমুদ্রের নিচে অন্ধকার স্তর, ঢেউয়ের পর ঢেউ—এই বিষয়গুলোরও উল্লেখ আছে। গভীর সমুদ্রের অন্ধকার সূরা নূর–এ বলা হয়েছে— সমুদ্রের গভীরে অন্ধকার, তার উপরে ঢেউ, তার উপরে ঢেউ, তার উপরে মেঘ... আধুনিক গবেষণা দেখায়— • ২০০ মিটারের গভীরতার নিচে আলো পৌঁছায় না • গভীরে ঢেউ থাকতে পারে—internal waves • আবহাওয়াজনিত মেঘ ঢেউয়ের উপর ঢেউ তৈরি করে এটি নিখুঁতভাবে আধুনিক বিজ্ঞানকে সাহায্য করে ব্যাখ্যা করতে। ফুটনোট: ১. Oceanography Journal, Vol. 36 ২. UNESCO Marine Science Reports লেখক : এম. ইমরান, বিশ্লেষক ও গবেষক
পর্বতমালা পৃথিবীর সৌন্দর্যের অন্যতম মহান প্রাকৃতিক নিদর্শন। তবে শুধু সৌন্দর্য নয়—পৃথিবীর স্থায়িত্বে পর্বতের ভূমিকা আধুনিক ভূতত্ত্বের আবিষ্কারের আগে কেউ জানতো না। কোরআনে বহু আয়াতে পর্বতমালা সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট উল্লেখ আছে, যা ভূতাত্ত্বিক গবেষণার সঙ্গে আশ্চর্যভাবে মিলে যায়। পর্বত “খুঁটি” বা “পেগ” কোরআনে বলা হয়েছে— “আমি পৃথিবীতে দৃঢ় পর্বত স্থাপন করেছি, যাতে তা কাঁপে না।” আধুনিক geophysics বলছে— • পর্বতের উপরের অংশের চেয়ে নিচের অংশ কয়েকগুণ গভীর, যাকে বলে mountain roots • এগুলো পৃথিবীর টেকটোনিক প্লেটগুলোকে স্থিতি দেয় • ভূকম্পন কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে এটি ঠিক পেরেকের মতো—উপরে সামান্য, নিচে গভীর। প্লেট টেকটোনিক্স ও পর্বত গঠন পৃথিবীর ভূত্বক ১২টি বড় টেকটোনিক প্লেটে বিভক্ত। যখন প্লেটগুলো ঠেলে দেয়— • হিমালয় জন্ম নেয় • আলপাইন বেল্ট তৈরি হয় • অ্যান্ডিস পর্বতমালা গঠিত হয় পর্বত গঠনের এই প্রক্রিয়া কোরআনের বর্ণিত “স্থাপন” ধারণার সঙ্গে মিল রয়েছে। কেন পর্বত পৃথিবীকে স্থিতিশীল রাখে? • পর্বতসহ ভূত্বকের গভীর শিকড় mantle-এ নোঙর করে থাকে • মাধ্যাকর্ষণ ভারসাম্য বজায় রাখে • প্লেটের গতি নিয়ন্ত্রণ করে • ভূত্বকের তাপমাত্রা, চাপ, ঘনত্ব ব্যবস্থাকে স্থিতিশীল করে এই বৈজ্ঞানিক তথ্য সপ্তম শতকে কারও জানা ছিল না। পর্বত বৃষ্টি–চক্রে ভূমিকা আধুনিক ক্লাইমেট সায়েন্স দেখায়— • পর্বত মেঘকে বাধা দেয় • বৃষ্টিকে কেন্দ্রীভূত করে নদীর জন্ম দেয় • জলবায়ু নিয়ন্ত্রণ করে কোরআনে পর্বতের এই ভূমিকারও উল্লেখ পাওয়া যায়। লেখক : এম. ইমরান, বিশ্লেষক ও গবেষক
মানুষের জীবনে অপমান, কষ্ট, অবহেলা এসবের মুখোমুখি হওয়া যেন অবধারিত। কারও একটি আচরণ, একটি কটু বাক্য বা একটি ভুল আমাদের হৃদয়ে দাগ কাটে। তখন মন চায় প্রতিশোধ নিতে, বদলা দিতে। কিন্তু প্রতিশোধ সবসময় ক্ষত সারায় না; বরং ক্ষতকে আরও গভীর করে। কিন্তু এমন এক প্রতিশোধ আছে, যা আঘাত না দিয়ে আরোগ্য দেয়, ঘৃণা না বাড়িয়ে হৃদয়কে প্রশান্ত করে— আর সেটি হলো ক্ষমা। ক্ষমা শুধু এক ধরনের আচরণ নয়; এটি হৃদয়ের মহত্ত্ব, ঈমানের আলো এবং চরিত্রের সর্বোচ্চ সৌন্দর্য। ক্ষমাই মানুষকে সবচেয়ে বড় বিজয়ী করে তোলে। তাই তো বলা হয় ‘সবচেয়ে মধুর প্রতিশোধ হলো ক্ষমা। কুরআনে ক্ষমার মর্যাদা ১. ক্ষমা শক্তির পরিচয় দুনিয়ায় যে ক্ষমা করে, তার পুরস্কার আল্লাহ নিজ হাতে রাখেন। আর আল্লাহর প্রতিদান কত মহৎ! আল্লাহ তাআলা বলেন— وَ جَزٰٓؤُا سَیِّئَۃٍ سَیِّئَۃٌ مِّثۡلُهَا ۚ فَمَنۡ عَفَا وَ اَصۡلَحَ فَاَجۡرُهٗ عَلَی اللّٰهِ ؕ اِنَّهٗ لَا یُحِبُّ الظّٰلِمِیۡنَ ‘মন্দের প্রতিফল অনুরূপ মন্দ দ্বারা এবং যে ক্ষমা করে ও আপোষ-নিস্পত্তি করে তার পুরস্কার আল্লাহর নিকট রয়েছে। আল্লাহ যালিমদের পছন্দ করেন না। (সুরা আশ-শুরা: আয়াত ৪০) ২. আল্লাহ ক্ষমাশীলদের ভালোবাসেন রাগ গিলে ফেলে অন্যকে ক্ষমা করা মহান আল্লাহর ভালোবাসার পথ। আল্লাহ তাআলা বলেন— الَّذِیۡنَ یُنۡفِقُوۡنَ فِی السَّرَّآءِ وَ الضَّرَّآءِ وَ الۡكٰظِمِیۡنَ الۡغَیۡظَ وَ الۡعَافِیۡنَ عَنِ النَّاسِ ؕ وَ اللّٰهُ یُحِبُّ الۡمُحۡسِنِیۡنَ ‘যারা স্বচ্ছলতা ও অভাবের মধ্যে ব্যয় করে এবং ক্রোধ সংবরণ করে ও মানবদেরকে ক্ষমা করে : এবং আল্লাহ সৎকর্মশীলদের ভালবাসেন। (সুরা আল-ইমরান: আয়াত ১৩৪) হাদিসে ক্ষমার মহত্ব ১. ক্ষমা মানুষকে সম্মানিত করে ক্ষমা মানুষের চোখে নয়, বরং আল্লাহর কাছে মর্যাদা বেড়ে যায়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন— وما زادَ اللهُ عبدًا بعفوٍ إلا عزًّا ‘বান্দা ক্ষমা করলেই আল্লাহ তার মান–সম্মান বৃদ্ধি করেন। (মুসলিম ৬৭৫৭) ২. নবীজির চরিত্র—সকল অন্যায়ের উত্তরে ক্ষমা নবীজিকে (সা.) মানুষ কষ্ট দিলেও তিনি তাদের জন্য দোয়া করতেন, প্রতিশোধ নিতেন না। এটাই ক্ষমার সর্বোচ্চ উদাহরণ এক কথায় মহানুভবতার জ্যোতি। মক্কা বিজয়ের দিনে যারা তাকে বছরের পর বছর নির্যাতন করেছিল, তিনি বললেন— اذهبوا فأنتم الطلقاء ‘তোমরা যাও, তোমরা সবাই মুক্ত। (ইবন হিশাম) ক্ষমা নিয়ে রয়েছে মনীষীদের বাণী— ১. হজরত ইমাম শাফি (রহ.) বলেছেন— ‘যে ক্ষমা করে দিল সে ঘৃণা থেকে মুক্ত হলো, আর ঘৃণা হলো হৃদয়ের রোগ। ২. হজরত আলী ইবনে আবি তালিব (রা.) বলেছেন— ‘শত্রুর উপর সর্বোত্তম বিজয় হলো তাকে ক্ষমা করে দেওয়া। ৩. হজরত হাসান আল-বাসরি (রহ.) ‘ক্ষমা এমন একটি গুণ, যা শুধু শক্তিশালী মানুষের পক্ষেই সম্ভব।’ ৪. হজরত ওমর ইবন আল-খাত্তাব (রা.) বলেছেন— ‘মানুষের উপর প্রতিশোধ সহজ; কিন্তু ক্ষমা করা শুধু মহত্ত্বের কাজ। ক্ষমা যে কারণে সবচেয়ে মধুর প্রতিশোধ— > কারণ ক্ষমা মানুষকে আঘাত দেয় না হৃদয়কে জিতে নেয় কারণ ক্ষমা রাগকে গলিয়ে শান্তি এনে দেয় কারণ ক্ষমা সম্পর্কের ভাঙনকে জোড়া লাগায় কারণ ক্ষমা আল্লাহর রহমত ডেকে আনে কারণ ক্ষমাকারী সবসময় সম্মানিত হয় কারণ ক্ষমা মানুষের আত্মাকে পবিত্র করে ক্ষমা করলে মানুষ বড় হয় আঘাত নয়, ভালোবাসা জন্ম নেয়। আর সত্যিই প্রতিশোধ কখনো জয় নয়; ক্ষমাই প্রকৃত বিজয়। পরিশেষে ক্ষমা হলো হৃদয়ের সেই আলো, যা মানুষের রাগ, কষ্ট এবং ঘৃণার অন্ধকার দূর করে দেয়। প্রতিশোধ ক্ষত গভীর করে, কিন্তু ক্ষমা ক্ষত সারিয়ে দেয়। আমরা যখন ক্ষমা করি, তখন অপরাধী নয় আমরাই প্রথম মুক্ত হই। ক্ষমার মাধ্যমে আল্লাহ আমাদের হৃদয়কে প্রসারিত করেন, সম্মান বাড়িয়ে দেন, শান্তি নাজিল করেন এবং জান্নাতের পথ সুগম করেন। তাই সম্পর্কের ভাঙন, জীবনের কষ্ট, মানুষের আচরণ সবকিছুর উত্তম প্রতিক্রিয়া হলো ক্ষমা। ক্ষমাই মানুষের মহত্ত্বের মাপকাঠি। আর ক্ষমাশীল হৃদয়ই আল্লাহর সবচেয়ে প্রিয় হৃদয়। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে ক্ষমাশীলতার গুণে ভরপুর চরিত্র দান করুন। আমিন।
মানব সভ্যতা মহাবিশ্বকে বুঝতে চেয়েছে কল্পনার দৃষ্টিতে, ইতিহাসের প্রতিটি অধ্যায়েই। কিন্তু মহাবিশ্বের উদ্ভব ও তার গঠন এত দীর্ঘকাল রহস্যাবৃত ছিল যে, ২০শ শতাব্দীর আগে পর্যন্ত বৈজ্ঞানিকভাবে এর উত্তর পাওয়া যায়নি। হাবল টেলিস্কোপ, কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশন, অ্যাস্ট্রোফিজিক্স—এসবের আগে মহাবিশ্ব সম্পর্কিত কোনো জ্ঞানই ছিল কেবল অনুমাননির্ভর। এই প্রেক্ষাপটে কোরআনে বর্ণিত মহাবিশ্ব–সম্পর্কিত আয়াতগুলো বিজ্ঞানীদের মাঝেও বিস্ময়ের জন্ম দেয়। বিগ ব্যাং ধারণা: আকাশ ও পৃথিবী একত্র ছিল সূরা আম্বিয়ায় বলা হয়েছে— আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী একত্র ছিল, পরে আমি তাদের পৃথক করেছি। বিজ্ঞান বলে— • মহাবিশ্ব প্রায় ১৩.৮ বিলিয়ন বছর আগে একটি singularity থেকে বিস্ফোরণের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে। • এই বিস্ফোরণকে বলা হয় Big Bang। • শুরুতে সবকিছু একই বিন্দুতে ছিল। কোরআনের এই বর্ণনা বিগ ব্যাং–এর মৌলিক ধারণার সাথে অসাধারণ মিল খায়। মহাবিশ্ব প্রসারিত হচ্ছে সূরা যারিয়াতে বলা হয়েছে— “আমরা আকাশকে শক্তি দিয়ে নির্মাণ করেছি এবং নিশ্চয়ই আমরা তা প্রসারিত করছি।” এডউইন হাবল ১৯২৯ সালে দেখান— • দূরবর্তী গ্যালাক্সিগুলো আমাদের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। • অর্থাৎ মহাবিশ্ব প্রসারিত হচ্ছে। কোরআনের যুগে মহাকাশ সম্পর্কে পৃথিবীবাসীর কোনো ধারণাই ছিল না। তবু মহাবিশ্বের বিস্তৃতি নিয়ে এরূপ ঘোষণা অলৌকিক বলেই বিবেচিত হয়। ধূলিকণার পর্দা ও মহাজাগতিক ধোঁয়া আরও এক স্থানে বলা হয়েছে— আকাশ একসময় ধোঁয়ায় পরিপূর্ণ ছিল। এটি আজকের অ্যাস্ট্রোফিজিক্সে “nebula theory” হিসেবে পরিচিত। বিজ্ঞানীদের মতে— • নক্ষত্র ও গ্রহের জন্ম ধূলিকণার মেঘ থেকে। • প্রাথমিক মহাবিশ্ব ছিল ধোঁয়াটে গ্যাসীয় মিশ্রণে আবৃত। পৃথিবীর সুরক্ষামূলক বায়ুমণ্ডল কোরআনে বলা হয়েছে, আকাশ (বায়ুমণ্ডল) পৃথিবীকে রক্ষা করে— • মাইক্রো-মিটিওরাইট • ক্ষতিকর বিকিরণ • অতিবেগুনী রশ্মি থেকে আধুনিক বিজ্ঞান দেখিয়েছে— • ওজোন স্তর এবং বায়ুমণ্ডলীয় ঘর্ষণ পৃথিবীকে প্রতিদিন হাজারো ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করে। তারা–পথ, কক্ষপথ, নিখুঁত গতিময়তা কোরআনে বারবার উল্লেখ আছে— • সূর্য, চাঁদ, গ্রহ—সব “নিজ নিজ কক্ষপথে” ঘুরছে। সপ্তম শতকে যখন পৃথিবীকেন্দ্রিক ধারণাই সর্বজনস্বীকৃত ছিল, তখন কোরআনের এই বক্তব্য বৈপ্লবিক। ফুটনোট: ১. NASA Astrophysics Division Reports ২. Hubble 1929: The Expanding Universe Paper ________________________________________ লেখক : এম. ইমরান, বিশ্লেষক ও গবেষক
শুধুমাত্র তারিখ ঘোষণার বাকি। ত্রয়োদশ ভোটের অন্য সব আয়োজন চলছে পুরোমাত্রায়। দেশ এখন নির্বাচনের মহাসড়কে। ব্যস্ত সময় পার করছেন রাজনৈতিক দলগুলো ও তাদের মনোনীত প্রার্থীরা। এতোদিন ভোট দিতে না পারার যন্ত্রণায় কাতর সাধারণ ভোটারদের মধ্যেও আগ্রহ ব্যাপক। সবার প্রত্যাশা একটি উৎসবমুখর, সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। আশায় বুক বেঁধেছে দেশের মানুষ। সর্বজনীন ভোটাধিকারে শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের মাধ্যমে এগিয়ে যাবে দেশ। আর হারাবে না পথ। এমন সন্ধিক্ষণেও গণভোট ইস্যুতে দ্বিধাদ্বন্দ্বে রাজনীতিকরা। সন্দিহান একে অপরের প্রতি। প্রকৃত গণতান্ত্রিক রূপান্তরের যাত্রাপথে এ নিয়ে আত্মতৃপ্তির ঢেঁকুর তোলা যাচ্ছে না মোটেও। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখনও সন্তোষজনক মাত্রা পায়নি। রাজনীতিকদের অনৈক্যে জন্ম হচ্ছে নতুন নতুন সঙ্কট। তপশিল ঘোষণার কাউন্টডাউন। অন্তর্বর্তী সরকার ব্যর্থ হতে চায় না কোনোভাবেই। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস নির্বাচন প্রসঙ্গে বারবার নিজের শক্ত অবস্থান পরিস্কার করেছেন। যত খেলা আর ষড়যন্ত্রই হোক না কেন নির্বাচন ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প দেখছেন না। তিনি জানেন, গণতন্ত্রের মূল ভিত্তিই হচ্ছে প্রত্যেক নাগরিকের ভোটের অধিকার। নির্বাচন ছাড়া গণতন্ত্র কোনভাবেই পূর্ণাঙ্গ হতে পারে না। আলোয় আলোয় ঝকঝক জীবনে প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনের মাধ্যমে তাই ক্ষমতার প্রকৃত মালিক জনগণের হাতেই ক্ষমতা ফিরিয়ে দিতে বদ্ধপরিকর। নির্বাচনকে যিনি মনে করেন একটি ‘টিম ওয়ার্ক’। এই টিম স্পিরিটে সফলতা অর্জনে দেশপ্রেমিক বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর সহায়তা চেয়েছেন এক সপ্তাহে দু’বার। দেশপ্রেমিক সশস্ত্র বাহিনীর প্রতি দেশের জনসাধারণের আস্থা-বিশ্বাস-ভরসা-নির্ভরতা অনুরণিত হয়েছে তার কণ্ঠেও। প্রথমবার বুধবার (১৯ নভেম্বর) মিরপুর সেনানিবাসে ডিএসসিএসসি কোর্স-২০২৫-এর গ্র্যাজুয়েশন সনদ বিতরণ অনুষ্ঠানে ও দ্বিতীয়বার গত শুক্রবার (২১ novembre) সেনাকুঞ্জে সশস্ত্র বাহিনী দিবস উপলক্ষে আয়োজিত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে। প্রধান উপদেষ্টা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন, ‘বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণে আসন্ন জাতীয় নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হবে। একটি নির্বিঘ্ন ও উৎসবমুখর নির্বাচন আয়োজনে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের দক্ষতা ও পেশাদারত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানাচ্ছি।’ প্রথম অনুষ্ঠানটিতেও তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা নির্বাচনের অপেক্ষায় আছি। আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হয়েছে। আবারও আমাদের সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সব ধরনের সহযোগিতা প্রয়োজন।’ এই নভেম্বরের প্রথম দিনেই সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, নৌবাহিনী প্রধান এডমিরাল এম নাজমুল হাসান ও বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খাঁন রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সেদিন দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সামরিক বাহিনীর সদস্যদের কঠোর পরিশ্রমের জন্য সাধুবাদ জানান সরকারপ্রধান। তিনি বলেছিলেন, ‘গত ১৫ মাসে সেনাবাহিনীসহ সব বাহিনীর সদস্যরা দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় অত্যন্ত কঠোর পরিশ্রম করেছে।’ আসন্ন নির্বাচন যেন নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা থাকে, সে জন্যও তিন বাহিনীকে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দেন। গত ১৯ ও ২১ নভেম্বর প্রধান উপদেষ্টার আহ্বানের পরপরই শান্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনে সরকারকে ও নির্বাচন কমিশনকে সর্বাত্মক সহযোগিতার কথা জানিয়েছেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান ও নৌবাহিনী প্রধান এডমিরাল এম নাজমুল হাসান। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, রোববার (২৩ নভেম্বর) সশস্ত্র বাহিনী দিবস উপলক্ষে ‘আর্মি মাল্টিপারপাস কমপ্লেক্স’-এ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সেনাপ্রধান বলেছেন, ‘দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সেনাবাহিনী নিয়োজিত রয়েছে… সুন্দর একটা নির্বাচন পেতে আমরা যথাযথভাবে সরকারকে এবং নির্বাচন কমিশনকে সহযোগিতা করবো।’ একদিন পরেই (২৪ নভেম্বর) বাংলাদেশ নৌবাহিনীর নবীন নাবিকদের কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে নৌবাহিনী প্রধান বলেছেন, ‘সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে আগামী নির্বাচন আয়োজনে সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে নৌবাহিনী সার্বিক সহায়তা প্রদান করবে।’ দেশের প্রতিটি সঙ্কটে ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে সশস্ত্র বাহিনী। সামরিক বাহিনী-ছাত্র-জনতার ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসেই বিরল এক গণঅভ্যুত্থানে বিজয়ী হয়েছে দেশ। এই ঐক্যই পতিত সরকারের জগদ্দল পাথর সরিয়েছে। নতুন সম্ভাবনার পথে এগিয়ে যেতে অন্তর্বর্তী সরকারকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছে। সামনেও নতুন সৌন্দর্যের আবাহনে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে সেনা, নৌ, বিমান বাহিনীর ভূমিকা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ—প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য থেকেও সেটি স্পষ্ট। একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের পূর্বশর্ত হলো স্থিতিশীল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। গত ১৫ মাসে সশস্ত্র বাহিনী দেশের শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে নিজেদের অপরিহার্যতা তুলে ধরেছে। সাধারণ রিকশা চালক থেকে কর্পোরেট কর্মকর্তা, আমলা–শিক্ষক–আইনজীবী—সকলেই জানেন, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কেবল সশস্ত্র বাহিনীর পূর্ণ সহযোগীতাতেই সম্ভব। এই কারণেই ২০২৬ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সশস্ত্র বাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিয়ে মাঠে রাখছে সরকার। এতে ভোট সহিংসতা ও কারচুপি প্রতিরোধ সহজ হবে এবং রাজনৈতিক চাপও কম পড়বে। এক্স-ফোর্সেস অ্যাসোসিয়েশনের সেমিনারে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. রোকন উদ্দিন বলেছেন, ‘ভোট কারচুপিতে দলীয় প্রশাসন মূল ভূমিকা রাখে। তাই সশস্ত্র বাহিনীকে পূর্ণ ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিয়ে মাঠে নামানো জরুরি।’ প্রধান উপদেষ্টা বারবার ‘সবচেয়ে সুন্দর নির্বাচন’ আয়োজনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। যদিও এখনো হাটে-ঘাটে-প্রবাসে নির্বাচন নিয়ে আলোচনায় অনেকে পর্দার আড়ালের নোংরা খেলায় উদ্বিগ্ন। কারণ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এখনো আস্থার সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। দেশে এখনও বিপুল অবৈধ অস্ত্র ছড়িয়ে আছে—যা উদ্ধার না হলে নির্বাচনের আগে–পরে সহিংসতা বাড়তে পারে। ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেওয়া সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। একইসঙ্গে সুশাসন, অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কেও এই নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এই বাস্তবতায় রাজনৈতিক দলগুলোর সহনশীল আচরণ নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। মুসলিম মনীষীদের বাণী—‘জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব’—রাজনীতিকদের মনে রাখা প্রয়োজন। গণভোট ও জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রসঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার সমাধানসূত্র মানা না হলে দেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি নাজুক হতে পারে। ব্যর্থ রাষ্ট্রের দিকে যাত্রা রোধ করতে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনই একমাত্র পথ। ঐক্যবদ্ধভাবে রুখে দিতে হবে নির্বাচন বানচালে সক্রিয় অপশক্তির কারসাজিকে। তবেই দেশে টেকসই গণতন্ত্রের সূর্য উঠবে—কুয়াশা সরিয়ে উজ্জ্বল রোদ্দুর উঁকি দেবে। আলোয় ভরা বাংলাদেশে সাধারণ মানুষ হাসবে, বিজয়ী হবে একাত্তর ও চব্বিশের চেতনাসম্পন্ন বাংলাদেশ।
ঢাকা শহরকে আমরা প্রায়ই ‘অপরিকল্পিত ’-এর উদাহরণ হিসেবে দেখি। বাস্তবেও তাই—অতিঘনবসতিপূর্ণ এ শহরের দিকে তাকালে বিশেষ করে কিছু এলাকার ভবনগুলো দেখলেই বুঝা যায়, দুর্যোগের মুহূর্তে এরা যেন নিজেরাই নিজেদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যাবে। অসংখ্য ভবন গায়ে–গা লাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, নেই খোলা জায়গা, নেই পার্ক বা খেলার মাঠ; জরুরি পরিস্থিতিতে আশ্রয় নেয়ার মতো একটি ফাঁকা স্থানও খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। প্রশ্ন জাগে—এ শহর কি সত্যিকারের পরিকল্পিত, নাকি কাগজে–কলমে পরিকল্পনার আড়ালে নির্মিত গভীর ঝুঁকির এক নগর? আইনের শিক্ষার্থী হিসেবে আমি জানি, আমাদের দেশে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও নগর পরিকল্পনার জন্য রয়েছে একাধিক আইন, বিধি ও নির্দেশিকা—Disaster Management Act 2012, National Building Code, RAJUK-এর বিস্তারিত এলাকা পরিকল্পনা, পরিবেশ সুরক্ষা আইনসহ আরও অনেক নিয়মনীতি। এগুলোর উদ্দেশ্যই শহরকে নিরাপদ ও বাসযোগ্য করা। কিন্তু সমস্যার শুরু এখানেই: দেশে আইন আছে, নীতি আছে, কিন্তু কার্যকর প্রয়োগ নেই। ফলে উন্নয়ন হয় শুধু ভবনের সংখ্যায়; নষ্ট হয় নিরাপত্তা, কমে যায় বাসযোগ্যতা। ঢাকা কি প্রস্তুত? সাম্প্রতিক ভূমিকম্পগুলো স্পষ্ট করে দিয়েছে—একটি বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি হলে ঢাকা নিজেকে রক্ষা করতে পারবে না। মাঝারি মাত্রার একটি ভূমিকম্পেও আশঙ্কা তৈরি হয়—রাস্তা বন্ধ হয়ে যাবে, ভবন ধসে পড়বে, গ্যাস বিস্ফোরণ হবে, বিদ্যুৎ–যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো—উদ্ধারকারী দল ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে পারবে না। সংকীর্ণ গলি, অবৈধ স্থাপনা, অগোছালো নির্মাণ ও খোলা জায়গার অভাবে উদ্ধারকাজ ধীর ও অকার্যকর হবে, আর এতে মৃত্যু কয়েকগুণ বাড়বে। এ পরিস্থিতির কারণ কী? ঢাকার বেশির ভাগ ভবনই নির্মিত হয়েছে জাতীয় বিল্ডিং কোড না মেনে। অনুমোদন প্রক্রিয়ায় অনেক ধাপ থাকলেও এর প্রয়োগ অত্যন্ত সীমিত। বহু ভবনের কাঠামোই ভূমিকম্প–সহনক্ষম নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ডের তুলনায় ঢাকায় মাথাপিছু খোলা জায়গার পরিমাণ অনেক কম। দ্রুত নগরায়ণের চাপে মাঠ, পার্ক, জলাধার ও ফাঁকা স্থানগুলো দখলে গেছে। ফলে বড় বিপর্যয়ের সময় মানুষ কোথায় জড়ো হবে—তা নিয়েও বড় প্রশ্ন রয়ে যায়। অনেক এলাকায় এমনভাবে ভবন নির্মাণ হয়েছে যে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি পর্যন্ত ঢুকতে পারে না। জরুরি লেন তৈরির পরিকল্পনা থাকলেও বাস্তবায়ন নেই। তাছাড়া নগরবাসীর একটি বড় অংশই জানে না ভূমিকম্পের সময় কী করতে হয়। স্কুল–কলেজে নিয়মিত ড্রিল নেই; সরকারি–বেসরকারি অফিসেও নেই। প্রস্তুতির অভাব আতঙ্ক বাড়ায়, দুর্ঘটনার ঝুঁকি আরও গভীর করে। সমাধান কী? ঢাকাকে বাঁচানো সম্ভব—যদি আমরা এখনই প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নিই এবং তা কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করি। ঝুঁকিপূর্ণ এ নগরীর বাসিন্দা হিসেবে আমাদের ভাবতে হবে—আমরা কি এমন একটি শহর চাই, যেখানে একটি ভূমিকম্প মুহূর্তেই হাজারো প্রাণ কেড়ে নিতে পারে? নাকি এমন একটি শহর চাই, যেখানে উন্নয়ন হবে সুরক্ষা ও পরিকল্পনার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে? নিরাপদ ঢাকার দায়িত্ব আমাদের সবার। রানা সরকার, শিক্ষার্থী আইন বিভাগ, সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটি
মিয়ানমার দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার অস্থিতিশীল ও দীর্ঘদিনের সংঘাত–পীড়িত একটি দেশ। দুর্বল রাষ্ট্র কাঠামো, গভীর দুর্নীতি এবং অবিরাম সামরিক–রাজনৈতিক সংকটের ফলে দেশটি এখন বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ মাদক উৎপাদনকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে ‘গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেল’—যা মিয়ানমার, থাইল্যান্ড ও লাওসকে ঘিরে গঠিত—দীর্ঘদিন ধরে ইয়াবা ও ক্রিস্টাল মেথ উৎপাদনের প্রধান অঞ্চল হিসেবে পরিচিত। এই বিশাল আন্তর্জাতিক অপরাধচক্রের সবচেয়ে বড় লক্ষ্য এখন বাংলাদেশ। কারণ এখানে তরুণ–যুবকের সংখ্যা বেশি, ভোক্তা বাজার দ্রুত বাড়ছে, আর ভৌগোলিক অবস্থান অপরাধচক্রের জন্য অত্যন্ত অনুকূল। সীমান্তঘেঁষা নাফ নদী, পাহাড়ি অরণ্য, দুর্গম পথ ও বিচ্ছিন্ন বসতির সুযোগে মাদক ব্যবসায়ীরা খুব সহজেই বাংলাদেশে প্রবেশের পথ তৈরি করেছে। কখনো ট্রলার বা মাছ ধরার নৌকায়, কখনো পর্যটকের গাড়িতে, আবার কখনো সাধারণ মানুষের ব্যাগে লুকিয়ে বিপুল পরিমাণ ইয়াবা ঢুকে পড়ে দেশে। এখন তো অনলাইন অর্ডার, কুরিয়ার প্যাকেট এবং অ্যাপভিত্তিক ডেলিভারির মাধ্যমেও মাদক ছড়িয়ে পড়ছে। ফলে স্পষ্ট বোঝা যায়—মাদক আর ছোটখাটো অপরাধ নয়, বরং এটি এক সুসংগঠিত, প্রযুক্তিনির্ভর আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক অপরাধচক্র, যা বাংলাদেশের নিরাপত্তাকে প্রতিদিন নতুন করে হুমকির মুখে ফেলছে। মাদকের সবচেয়ে ভয়াবহ প্রভাব পড়ে ব্যক্তির জীবনে। ইয়াবা বা আইস কয়েক মাস নিয়মিত গ্রহণ করলেই একজন যুবকের মানসিক স্থিতি ভেঙে পড়ে—স্মৃতিভ্রংশ, চিন্তাশক্তি নষ্ট হওয়া, হ্যালুসিনেশন, আত্মগ্লানি, এমনকি আত্মহত্যার প্রবণতাও তৈরি হয়। শারীরিক ক্ষতিও ভয়ানক—হার্ট, কিডনি, লিভার, মস্তিষ্কসহ পুরো দেহব্যবস্থা ধ্বংস হতে থাকে। মাত্র কয়েক মাসেই একজন মানুষের চেহারা বদলে যায়, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়ে, আর্থিকভাবে পরিবার নিঃস্ব হয়। টাকা ফুরিয়ে গেলে সে চুরি–ছিনতাই, জিনিসপত্র বিক্রি এবং অপরাধচক্রে জড়িয়ে পড়তে বাধ্য হয়। এই মাদক–দুর্যোগের সবচেয়ে বড় শিকার পরিবার। মাদকাসক্ত সন্তানের কারণে বাবা–মা আজীবন যন্ত্রণায় ভোগেন, সংসারে অশান্তি বাড়ে, স্বামী–স্ত্রীর সম্পর্ক ভেঙে যায়, সন্তানরা নিরাপত্তাহীনতায় বড় হয়। সুখী পরিবার ধীরে ধীরে পরিণত হয় অন্তহীন দুঃখ–কষ্টের ঘরে। অনেক ক্ষেত্রে মাদকাসক্ত স্বামীর হাতে স্ত্রী নির্যাতনের শিকার হন, পরিবার অর্থনৈতিক ও মানসিক বিপর্যয়ে পড়ে। সমাজেও মাদকের আগ্রাসন আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ে। ছিনতাই, ধর্ষণ, খুন, সংঘাত, গ্যাং কালচারের বিস্তার—সব কিছুর সঙ্গে মাদকসেবীদের যোগসূত্র পাওয়া যায়। বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ক্যাম্পাসে মাদক এক নতুন ‘ফ্যাশন’ হয়ে উঠছে। তরুণেরা তাদের ভবিষ্যত নষ্ট করছে কিছু ট্যাবলেটের বিনিময়ে। পাড়া–মহল্লায় নিরাপত্তাহীনতা বাড়ছে, রাতের শহরে মাদকাসক্ত গ্যাং দৌরাত্ম্য দেখাচ্ছে। বিশেষ করে আইসের প্রভাবে মানুষ কিছু সময়ের জন্য নিজেকে ‘অপরাজেয়’ মনে করে, আর সেই ভুল ধারণাই বড় অপরাধের জন্ম দেয়। অর্থনীতিতেও মাদকের প্রভাব ভয়াবহ। একজন মাদকাসক্ত যুবক উৎপাদনশীল শ্রমশক্তি থেকে ছিটকে পড়ে। কর্মক্ষমতা হারায়, দুর্ঘটনা বাড়ায়, শিল্পে বিঘ্ন সৃষ্টি করে। রাষ্ট্রকে বিপুল অর্থ ব্যয় করতে হয় তাদের চিকিৎসা, পুনর্বাসন, পুলিশি তৎপরতা ও কারাব্যবস্থাপনায়। এতে স্বাস্থ্য ও আইন–শৃঙ্খলা ব্যবস্থা চাপে পড়ে, দেশের সামগ্রিক উৎপাদনশীলতা হ্রাস পায়। তরুণশক্তি যেখানে অর্থনীতির চালিকা শক্তি হওয়ার কথা, সেখানে মাদক সেই শক্তিকে ভেতর থেকে ক্ষয় করে দিচ্ছে। সবচেয়ে বড় ক্ষতি হচ্ছে জাতির ভবিষ্যতে। দেশের অর্ধেকের বেশি মানুষ তরুণ। শিল্প, প্রযুক্তি, শিক্ষা, গবেষণা, উদ্ভাবন—সব ক্ষেত্রেই তারা নেতৃত্ব দেবে। কিন্তু এদের একটি বড় অংশ মাদকাসক্ত হয়ে পড়লে ভবিষ্যত অন্ধকার হয়ে যাবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ইয়াবা ও আইসের ভয়াবহ বিস্তার একটি বড় জাতীয় সংকটের ইঙ্গিত দিচ্ছে। রাষ্ট্রের নিরাপত্তাও চরম ঝুঁকিতে। মাদক ব্যবসা কখনো একা চলে না—এর সঙ্গে অস্ত্র ব্যবসা, মানবপাচার, বিদেশি সন্ত্রাসী অর্থায়ন, স্থানীয় দুর্নীতি সবই জড়িত। মাদককারবারিরা প্রচুর অর্থ হাতে পায়, আর সেই অর্থ দিয়ে তারা রাজনীতি, প্রশাসন ও ব্যবসার ভেতরে প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। ‘অন্ধকার অর্থনীতি’ তৈরি হয়ে বৈধ অর্থনীতিকে দুর্বল করে দেয়, রাষ্ট্রযন্ত্রে ফাটল ধরে। এ বিপর্যয়ের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত তরুণেরা—বিশেষ করে ১৬ থেকে ৩০ বছর বয়সীরা। তারপর শিক্ষার্থী, বেকার, শ্রমজীবী, নারী ও শিশুরা। এই পরিবারগুলোর শিশুরা বড় হয় মনস্তাত্ত্বিক ক্ষত নিয়ে, যা ভবিষ্যতের নতুন সামাজিক সংকটের জন্ম দেয়। অর্থাৎ মাদক আজকের সমাজকে যেমন ধ্বংস করছে, আগামী দশকের ভবিষ্যতকেও অন্ধকারে ঠেলে দিচ্ছে। এখন করণীয় কী? প্রথমত, সীমান্ত নিরাপত্তা প্রযুক্তিনির্ভর ও বহুগুণ শক্তিশালী করতে হবে। দ্বিতীয়ত, মিয়ানমারকে কূটনৈতিক চাপের মুখে আনতে হবে—তাদের দায় এড়ানো চলবে না। তৃতীয়ত, দেশের ভেতরের দালালচক্রকে চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনতে হবে। আইন–শৃঙ্খলা বাহিনীর ভেতরের দুর্নীতিও নির্মূল জরুরি। চতুর্থত, পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সচেতনতা বাড়াতে হবে। মাদকাসক্তদের পুনর্বাসন কেন্দ্র আধুনিক ও কার্যকর করতে হবে। শেষ কথা— মিয়ানমারের মাদক এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় নীরব শত্রু। এটি পরিবার ধ্বংস করছে, সমাজকে বিপর্যস্ত করছে, অর্থনীতিকে দুর্বল করছে এবং জাতির ভবিষ্যতকে অন্ধকারে নিমজ্জিত করছে। এখনই কঠোর পদক্ষেপ না নিলে আমরা সম্ভাবনাময় একটি প্রজন্ম হারাব। মাদকবিরোধী যুদ্ধ আজ পুরো জাতির যুদ্ধ—নিজেদের ভবিষ্যত রক্ষার জন্য এই যুদ্ধে জয়ী হওয়া ছাড়া আর কোনো পথ নেই।
মানব দেহের সৃষ্টি ও বিকাশ বিজ্ঞানের অন্যতম বিস্ময়কর অধ্যায়। আধুনিক এমব্রিওলজির আবির্ভাবের আগে মানব ভ্রূণের গঠন নিয়ে বিশ্বের কোনো সভ্যতারই সুস্পষ্ট জ্ঞান ছিল না। সপ্তম শতকের আরবেও ভ্রূণ নিয়ে ধারণা ছিল ক্ষীণ এবং বেশিরভাগই কুসংস্কারনির্ভর। এমন এক যুগে কোরআনে ভ্রূণ গঠনের যে ধাপসমূহ বর্ণিত হয়েছে, তা আজকের আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় অবাক করার মতো সামঞ্জস্য খুঁজে পায়। কোরআনের একাধিক সূরায় মানুষের সৃষ্টি নিয়ে ধাপে ধাপে বর্ণনা আছে—নুফা (বীর্যের একটি অংশ), আলাকা (ঝুলে থাকা/রক্তমাংসের দলা), মুদগাহ (চিবানো মাংসপিণ্ড), অস্থি, অস্থির উপর মাংস, এবং শেষে পূর্ণাঙ্গ মানব। এটি সাত শতাব্দী পূর্বে বলা হলেও আধুনিক এমব্রিওলজির নিখুঁত পর্যবেক্ষণের সাথে এক রহস্যময় মিল রেখে চলে। নুফা: নিষিক্তকরণের সূচনা ধাপ আধুনিক জীববিজ্ঞান দেখায়— • লক্ষাধিক শুক্রাণুর স্রোত থেকে মাত্র একটি নিষিক্তকরণে সক্ষম হয়। • নুফা শব্দটি নির্দেশ করে “অত্যন্ত ক্ষুদ্র একটি অংশ”, যা এই বিজ্ঞানসম্মত ঘটনা ব্যাখ্যা করে। এই বিষয়টি অতীতে কেউ জানতো না। মানুষের চোখে শুক্রাণু দৃশ্যমান নয়। আজ মাইক্রোস্কোপিক পর্যবেক্ষণে নুফার ধারণা আরও স্পষ্ট। আলাকা: ঝুলে থাকা কোষগুচ্ছ কোরআন এই ধাপটিকে “আলাকা” বলে উল্লেখ করেছে। আরবি ভাষায় এর অর্থ— • ঝুলে থাকা, • রক্তমতো দলা, • আঠালো বস্তু। আজ এমব্রিওলজির চিত্র দেখায়— • ভ্রূণ জরায়ুর দেয়ালে লেগে (implant) থাকে। • এর আকৃতি রক্তদলার মতো দেখতে। • স্টেম সেলগুলো আঠালোভাব ধারণ করে। এটি কোরআনের ‘আলাকা’ শব্দের তিনটি অর্থের সাথেই সরাসরি সামঞ্জস্যপূর্ণ। মুদগাহ: চিবানো মাংসের মতো আকৃতি এ ধাপটি কোরআনে অত্যন্ত বিচিত্রভাবে বর্ণিত। আধুনিক আল্ট্রাসনোগ্রাফির ছবি দেখলে— • ২৬–৩০ দিনের ভ্রূণ সত্যিই একটি “চিবানো মাংসপিণ্ড”-এর মতো দেখায়। • somite নামক অংশগুলো দাঁতের দাগের মতো চিহ্ন সৃষ্টি করে—যা চিবানো মাংসের দাগের সদৃশ। এটি মধ্যযুগে কল্পনাতীত। হাড় সৃষ্টি →হাড়েমাংসআবরণ কোরআনে বলা হয়েছে— “তারপর আমরা হাড় সৃষ্টি করলাম, তারপর হাড়ে মাংস পরিয়ে দিলাম।” এমব্রিওলজি দেখায়— • প্রথমে cartilaginous skeleton তৈরি হয়। • পরে তার চারপাশে মাংসপেশি গঠিত হয়। এটিও কোরআনের ধাপগত বর্ণনার সাথে মিলে যায়। গবেষকদের ব্যাখ্যা বিশ্বখ্যাত এমব্রিওলজিস্টDr. Keith Moore, যিনি “The Developing Human” বইয়ের রচয়িতা, বলেছেন— “কোরআনে ভ্রূণ গঠনের বর্ণনা আমার গবেষণার জন্য নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে।” আধুনিক যুগে এর তাৎপর্য • ধর্ম ও বিজ্ঞানকে এক বন্ধনে যুক্ত করে। • বৈজ্ঞানিক গবেষণার প্রতি মুসলিম সমাজে আগ্রহ জাগিয়েছে। • মানবদেহ নিয়ে গবেষণায় কোরআনিক উল্লেখ নতুন কৌতূহল সৃষ্টি করেছে। ফুটনোট: ১. Keith L. Moore, The Developing Human, 7th Edition. ২. Journal of Embryology & Reproduction, Vol. 52. লেখক : এম. ইমরান, বিশ্লেষক ও গবেষক
ভাষা মানুষের চিন্তা, ইতিহাস ও সভ্যতার প্রধান বাহন। আরবি ভাষার ইতিহাসে কোরআন অবতীর্ণ হওয়ার মধ্য দিয়ে ভাষার যে বিপ্লব ঘটে, তা শুধু ধর্মীয় নয়—সাহিত্য, ব্যাকরণ, বাক্যতত্ত্ব এমনকি আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানের গবেষণাতেও নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। সপ্তম শতকের আরব ছিল মৌখিক সাহিত্যের রত্নভাণ্ডার, সেখানে কবিতা ছিল মর্যাদার সর্বোচ্চ আসন। শক্তিশালী কবি গোত্রের প্রতিচ্ছবি, মর্যাদা এবং সাংস্কৃতিক শক্তির প্রতীক ছিল কবিতা। আর এই সমাজেই কোরআন অবতীর্ণ হলো এমন এক ভাষা-রূপে, যা আরবি কবিদের বিস্মিত করেছে, বাকরুদ্ধ করেছে এবং সাহিত্যিকদের চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে। কোরআনের ভাষা কখনো কবিতা নয়, আবার সরল গদ্যও নয়। এর ছন্দ, রূপক, উপমা, যুক্তি, শব্দচয়ন, বাক্যবিন্যাস—সব মিলিয়ে এটি গদ্য ও কবিতার মাঝামাঝি এক নতুন শৈলী। ভাষাতত্ত্ববিদেরা এটিকে “Qur’anic Style” নামে ডাকে। ভাষার এমন গঠন আরবিতে আগে কখনো ছিল না। অপ্রতিদ্বন্দ্বী চ্যালেঞ্জ: “এমন একটি সূরা তৈরি করে আনো” কোরআনে বহুবার চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে— “যদি সন্দেহ থাকে, তবে এর মতো একটি সূরা এনে দেখাও।” আরব ছিল ভাষার ওস্তাদদের কেন্দ্র। তবুও কেউ সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে সফল হতে পারেনি। কারণ— • কোরআনের গঠনশৈলী তৎকালীন আরবি কবিতার নিয়ম মানে না, • আবার তাদের প্রচলিত গদ্যের ধরনেও পড়ে না। এটি এক স্বতন্ত্র, অনন্য রূপ। শব্দের গণিত: কোরআনে শব্দ ব্যবহারের পরিমিতি আধুনিক কম্পিউটেশনাল ভাষা বিশ্লেষণে দেখা গেছে— • “দিন” শব্দটি এসেছে ৩৬৫ বার • “মাস” এসেছে ১২ বার • “পুরুষ-নারী” শব্দদ্বয় সমান সংখ্যকবার • “শয়তান” ও “ফেরেশতা” প্রতিপক্ষ শব্দ হিসেবেও সমান সংখ্যায় ব্যবহৃত এগুলো কাকতালীয় হিসেবেই মেনে নেওয়া কঠিন। আধুনিক ভাষাবিজ্ঞান কী বলে? MIT ও আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা গবেষকেরা দেখিয়েছেন— • কোরআনের বাক্য গঠনে বিশেষ ছন্দ থাকে • শব্দের পুনরাবৃত্তি ও শব্দ-সমতা ভাষাবিজ্ঞানের “balanced structure” ধারণার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ • কোরআনের ব্যাকরণিক শৈলী আরবি ভাষায় নতুন ব্যাকরণ রচনা করে দিয়েছে—আজও “নাহু” ও “সরফ” এর ভিত্তি কোরআন কোরআনের ভাষা কি অলৌকিক? ভাষাবিজ্ঞানীরা এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দেন— • যে ভাষা সাধারণ মানুষের সৃষ্টির বাইরে বিশেষ গঠনমূলক বৈশিষ্ট্য দেখায় • দীর্ঘ ১৪০০ বছর ধরে যার শৈলী অনুকরণযোগ্য নয় • এবং যেটি পরবর্তীতে একটি ভাষার ব্যাকরণিক কাঠামো তৈরি করে— তা অবশ্যই ব্যাখ্যাতীত ‘linguistic miracle’ এর পথ খুলে দেয়। আধুনিক যুগে প্রাসঙ্গিকতা আজকের যুগে, যেখানে ভাষা বিশ্লেষণ, AI ভাষা মডেলিং, computational linguistics—এসবের ব্যাপক ব্যবহার, কোরআনের ভাষা নতুন গবেষণার ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। AI গবেষকেরা কোরআনের ছন্দ-গঠনকে 'mathematical symmetry' বলে উল্লেখ করেছেন। ফুটনোট: ১. M. Abdel Haleem, Oxford Univ. Press—“The Qur’anic Style is simply inimitable.” ২. Dr. Raymond Farrin—“Qur'an demonstrates ring composition and mathematical precision.”
বাংলাদেশের আকাশে আজ ১৪৪৭ হিজরি সনের জমাদিউস সানি মাসের চাঁদ দেখা যায়নি। ফলে আগামীকাল ২২ নভেম্বর (শনিবার) জমাদিউল আউয়াল মাস পূর্ণ ৩০ দিন হয়ে যাবে এবং ২৩ নভেম্বর (রোববার) থেকে নতুন মাসের গণনা শুরু হবে। শুক্রবার (২১ নভেম্বর) সন্ধ্যায় বায়তুল মুকাররমে অনুষ্ঠিত জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটির সভায় এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। সভায় ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. ইমতিয়াজ হোসেন সভাপতিত্ব করেন। সভায় ইসলামিক ফাউন্ডেশন, জেলা প্রশাসন, বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর ও মহাকাশ গবেষণা ও দূর অনুধাবন প্রতিষ্ঠান (স্পারসো) থেকে প্রাপ্ত তথ্য পর্যালোচনা করে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সভায় ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক, মন্ত্রিপরিষদ ও ওয়াকফ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসা, চরমোনাই আহছানাবাদ রশিদিয়া কামিল মাদ্রাসা, চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য ইসলামিক প্রতিষ্ঠানের বিশিষ্ট শিক্ষকরা উপস্থিত ছিলেন।
ফেসবুক প্ল্যাটফর্ম আমাদের অঞ্চলের মানুষের মনস্তত্ত্বের ওপর যে নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করেছে, সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। যার ফলে সামাজিকভাবে এর কুপ্রভাব সর্বত্র বিরাজমান। ফেসবুক আমাদের দেশের মানুষের মনস্তাত্ত্বিক চিন্তাধারার ওপর যে পরিমাণ নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে ক্ষতিসাধন করেছে, সে ক্ষতি অপূরণীয় ও অবর্ণনীয়। মানুষের সুচিন্তা করার ক্ষমতাকে একদম শূন্যস্তরে নামিয়ে এনেছে ফেসবুক। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুক এখন হয়ে উঠেছে অসামাজিকতার মূল কেন্দ্র। এখন বাকি যে ক্ষতিটুকু করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে, সেটা হচ্ছে মনিটাইজিশন নামক লোভের ফাঁদ তৈরি করে মানুষকে অকর্মণ্য ও আনপ্রোডাকটিভ করার চেষ্টা। ফেসবুক হয়তো ক্রিয়েটিভ মানুষ সৃষ্টির জন্য এ লোভের ফাঁদ তৈরি করেছে, যাতে সৃষ্টিশীল মানুষরা তাদের ভেতরকার প্রতিভাকে সবার সম্মুখে তুলে ধরতে পারে এবং সেই প্রতিভার প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে ভিউয়ের ওপর ফেসবুক ডলার প্রদানের ব্যবস্থাও করেছে। কিন্তু বিষয় হচ্ছে, যারা সত্যিকারের সৃষ্টিশীল মানুষ তারা কখনোই অর্থের আশার সৃষ্টি করে না, করতে চায় না। তাদের শুধু সমাজের অগ্রগতি ও নিজের আত্ম-আনন্দের জন্যই সৃষ্টি করে। সম্প্রতি শাহ আবদুল করিমকে নিয়ে একটি প্রতিবেদনে দেখলাম, তাকে এক অনুষ্ঠানে ৩ লাখ টাকার চেক প্রদান করা হলে তিনি তার বিপরীতে ছেলেকে বলছেন, এত টাকা দিয়ে আমি কী করব? আমাদের বাঁচার জন্য তো এত টাকা লাগে না। শাহ আবদুল করিমরা বাংলার সত্যিকারের সৃষ্টিশীল মানুষ। প্রতিভাবান ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ। তিনি তার প্রয়োজনের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে অবগত। তাই তিনি সে চেক নিতে অসম্মতি জানিয়েছেন। যারা সত্যিকারের সৃষ্টি করে, তারা কখনোই লোভের ফাঁদে পা বাড়ায় না; লোভ তাদের কখনোই বাঁধতে পারে না। ফেসবুক ডলার ইনকামের লোভের ফাঁদ পেতে যুবক থেকে বৃদ্ধ সবাইকে সেই ফাঁদে টাকি মাছের মতো আটক করে নাচিয়ে বেড়াচ্ছে। ফেসবুক চাইছে, সবাইকে এর পাতায় নিবিষ্ট করে রাখতে। অঞ্চলভিত্তিক মানুষের মনস্তত্ত্বের ওপর ফেসবুক কর্তৃপক্ষের ব্যাপক বিচরণ রয়েছে। তারা জানে আমাদের অঞ্চলের মানুষকে কীভাবে বন্দি করা যায় ফেসবুকের খপ্পর-খাঁচায়। সে প্রভাবেই এখন সর্বত্রই কনটেন্ট ক্রিয়েটর। সবাই এখন ভিডিও নির্মাতা। যে যা পারছে তাই নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে ফেসবুকের পাতায়। লক্ষ্য একটাই, ফেসবুক মনিটাইজিশন ও ডলার ইনকাম। ফেসবুক মনিটাইজিশনের পেছনে ছুটতে ছুটতে মানুষ তার ভেতরকার সত্যিকারের প্রতিভা হারিয়ে ফেলছে। ফেসবুক স্ক্রিন মানুষের সবকিছুকে গ্রাস করছে, এমনকি তার ভেতরে থাকা সু ও সৎচিন্তা করার ক্ষমতাকেও। ফলে আবাল, যুবক, বৃদ্ধ সবাই তাদের সেই নির্দিষ্ট কাজ ফেলে ছুটে চলছে ফেসবুকের অদৃশ্য ডলারের খোঁজে। একটা সময় ছিল যখন যা ইচ্ছে ভিডিও নির্মাণ করে অনেকে ফেসবুক থেকে যথেষ্ট অর্থ আয় করেছে; কিন্তু ফেসবুক কর্তৃপক্ষ এখন বেশ সচেতন হয়েছে। যা ইচ্ছে তাই ফেসবুকে ছেড়ে অর্থ আয়ের পথ বন্ধ করে দিয়েছে। অনেক ভিউ হওয়ার পরও ফেসবুক এখন খুব অল্প পরিমাণ অর্থ প্রদান করছে। কারণ, ফেসবুক দেখছে সবাই এখন এর ভিডিও ব্যবসায়ী হতে চাচ্ছে। সেই চালাকি তারা ধরে ফেলেছে। সেজন্য ফেসবুক তাদের অর্থও সীমিত করেছে এবং আরোপ করেছে আরও অনেক বিধিনিষেধ। তারা চায় ব্যক্তি তার নিজস্ব প্রতিভা ফুটিয়ে তুলুক। অন্যের সৃষ্ট কোনো প্রতিভা চুরি করে নিজের নামে চালানোর সুযোগ এখন আর নেই। আমি এমনও দেখেছি, মানুষ ফেসবুক মনিটাইজিশনের জন্য ছাগল পর্যন্ত সাজছে। মানুষ নিজেদের স্বতন্ত্রতা হারিয়ে হাস্যকর ভাঁড়ে পরিণত হচ্ছে। ফেসবুক ইন্টেলিজেন্স জানে কীভাবে কোন জাতিকে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। ফেসবুকের মনিটাইজিশনের লোভের ফাঁদে পড়ে সেদিন এক স্কুলশিক্ষককে দেখলাম ছাগলের যুদ্ধ লাইভ করছে এবং সে যুদ্ধের ধারাভাষ্য দিচ্ছে। ফেসবুক হয়তো সৃষ্টিশীল মানুষ তৈরি করা বা সৃষ্টিশীল মানুষ বিনির্মাণের জন্য এ চেষ্টা করছে কিন্তু কথা হচ্ছে, সৃষ্টিশীলতার বিপরীতে তৈরি হচ্ছে এক অথর্ব গোষ্ঠী; যারা যা ইচ্ছে তাই নিয়ে উপস্থিত হচ্ছে এর পাতায়। সেদিন একজনকে দেখলাম লাইভে এসে বারবার বলছে, প্লিজ আপনারা আমার ভিডিওটি ট্যাপ করে শেয়ার দিন প্লিজ। সে কী কান্নাজড়িত আকুতি অনুনয়। ফেসবুক হয়তো চায় প্রতিভাবানদের মূল্যায়ন করতে, কদর করতে, তাদের সবার সামনে তুলে ধরতে কিন্তু উল্টো প্রতিভাবানরা অপ্রতিভাবানদের ভিডিওর নিচে পিষ্ট হয়ে হারিয়ে যাচ্ছে। তাই ফেসবুক কর্তৃপক্ষের অবশ্যই এসব বিষয়ে যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে নজর দিতে হবে। সেইসঙ্গে আমাদের দেশের ফেসবুক ব্যবহারকারীদেরও যা ইচ্ছে তাই ছেড়ে দিয়ে এই মাধ্যমকে আবর্জনাপূর্ণ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। কারণ, ফেসবুক কখনোই নিজস্ব প্রতিভা ছাড়া বা বিশেষ আইডিয়া মেকার ছাড়া কাউকেই সহযোগিতা করবে না এবং ডলার ইনকামের বিশেষ সুযোগও নেই। কাজী বনফুল, প্রাবন্ধিক ও সাংস্কৃতিককর্মী
মা-বাবা পরিবারে বন্ধনের কেন্দ্রবিন্দু। তাঁদের জীবিত অবস্থায় ভাইবোনদের মধ্যে যোগাযোগ, আদান-প্রদান ও পারস্পরিক ভালোবাসা বজায় থাকে সহজেই। কিন্তু মা-বাবার মৃত্যু অনেক সময় সেই সম্পর্কের ভারসাম্য নষ্ট করে দেয়, অনেক পরিবারেই দেখা যায়, ধীরে ধীরে ভাইবোনেরা একে অপরের থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই বিচ্ছিন্নতার পেছনে রয়েছে মানসিক, আর্থিক ও সামাজিক নানা কারণ। উত্তরাধিকার ও সম্পত্তি বিভাজনের জটিলতা---- সবচেয়ে সাধারণ কারণ হিসেবে দেখা যায় সম্পত্তি নিয়ে মতবিরোধ। মা-বাবার রেখে যাওয়া জমি, বাড়ি বা আর্থিক সম্পদ ভাগাভাগির সময় কেউ যদি বঞ্চিত বোধ করেন বা কেউ সুবিধা নিতে চান, তখনই সম্পর্কের টানাপোড়েন শুরু হয়। অনেক ক্ষেত্রে ভাইবোনদের মধ্যে মামলা-মোকদ্দমাও দেখা যায়, যা স্থায়ী দূরত্ব তৈরি করে। যোগাযোগের অভাব ও ভুল বোঝাবুঝি মা-বাবা জীবিত থাকলে তাঁরা সন্তানদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করেন, সমস্যা মিটিয়ে দেন। কিন্তু তাঁদের মৃত্যুর পর সেই সেতুবন্ধন হারিয়ে যায়। একে অপরের প্রতি মনোযোগ কমে যায়, ছোটখাটো ভুল বোঝাবুঝি বড় হয়ে দেখা দেয়। ধীরে ধীরে নিয়মিত যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়, তৈরি হয় মানসিক দূরত্ব। সামাজিক মর্যাদা ও আর্থিক অবস্থার পার্থক্য একই পরিবারের সন্তান হলেও সবাই সমান অবস্থানে থাকেন না। কেউ উচ্চশিক্ষিত ও প্রতিষ্ঠিত হলে, কেউবা সাধারণ জীবনযাপন করেন। এই অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থানের পার্থক্য অনেক সময় হীনমন্যতা বা অহংবোধ তৈরি করে, যা সম্পর্কের স্বাভাবিক প্রবাহে বাধা দেয়। পারিবারিক দায়িত্ব ও আবেগের পরিবর্তন মা-বাবার মৃত্যুর পর পারিবারিক দায়িত্ব যেমন—বাড়ির যত্ন, ছোট ভাইবোনের খোঁজখবর নেওয়া, পারিবারিক অনুষ্ঠান আয়োজন—এসব দায়িত্ব কেউ কেউ নিতে চান না। আবার কেউ বেশি দায়িত্ব নিলে, অন্যরা অবহেলিত বোধ করেন। এতে সম্পর্কের ভারসাম্য নষ্ট হয়। দাম্পত্য ও আত্মীয়তার প্রভাব অনেক সময় ভাইবোনের মধ্যে দূরত্ব বাড়ানোর পেছনে দাম্পত্য সম্পর্ক বা শ্বশুরবাড়ির প্রভাবও কাজ করে। স্বামী বা স্ত্রী যদি পরিবারের বিষয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করেন, তাহলে ধীরে ধীরে মনোভাব পরিবর্তিত হয়। মানসিক পরামর্শকরা যা বলছেন মনোবিজ্ঞানীদের মতে, মা-বাবার মৃত্যুর পর পরিবারে একটি শূন্যতা তৈরি হয়। এই শূন্যতাকে পূরণ করতে পারস্পরিক বোঝাপড়া ও সহমর্মিতা প্রয়োজন। কিন্তু বেশিরভাগ সময় শোক, দুঃখ ও দায়িত্বের চাপের মধ্যে সেই জায়গায় আসে উদাসীনতা। বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দেন, > “মা-বাবা না থাকলেও ভাইবোনদের উচিত নিয়মিত যোগাযোগ রাখা, উৎসব-অনুষ্ঠানে একত্র হওয়া এবং পারস্পরিক সহযোগিতার পরিবেশ বজায় রাখা। এতে শুধু সম্পর্ক টিকে থাকে না, পরিবারের ঐক্যও অটুট থাকে।” এই সামাজিক বাস্তবতা শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বের বিভিন্ন সংস্কৃতিতেও একইভাবে দেখা যায়। পারিবারিক বন্ধন রক্ষা করতে হলে, হারিয়ে যাওয়া সেই সংযোগ ফিরে আনার উদ্যোগ নিতে হবে পরিবারের প্রতিটি সদস্যকেই। S R SHIJU
জাগরণের অগ্নিবীণা বাজিয়ে যিনি আত্মভোলা, অসচেতন ও অলস জাতিকে তারুণ্যের উদ্দীপনায় উদ্দীপ্ত হতে বলেছেন, মুক্ত প্রাণ ধর্মের তারুণ্যকে জয়যুক্ত করার জন্য যিনি অমর যৌবনের আগ্নেয় দুর্দান্তকে দোড়রা মেরে সচেতন করে তুলেছেন তিনি হলেন মহাবিশ্বের এক জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি, মহাবিদ্রোহের রণতুর্যবাদক বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। কাজী নজরুল ছিলেন ইসলাম সকল শ্রেণির মানুষের কবি, তিনি সমাজের উঁচুতলার লোকদের সাথে যেমন মিশেছেন ততোধিক গভীরভাবে ও নিবিড়ভাবে মিশেছেন সমাজের খেটে-খাওয়া কুলি-মজুর, শ্রমিক-কৃষান, জেলে-মাঝি, কামার-কুমার, সাঁওতাল-মুন্ডা, গারো-খাসিয়া, রাজমিস্ত্রী, তাঁতি-ধোপা, বাউল, সাপুড়ে-বেদে অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষের সাথে। তিনি তাদের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আবেগ-কল্পনা, ভালো লাগা-মন্দ লাগাকে বিষয় করে অসংখ্য কাব্য রচনা করেছেন। পণ্ডিত থেকে পথচারী, শহরবাসী ভদ্রলোক থেকে মাঠের রাখাল সবাই ছিলেন তাঁর আত্মার আত্মীয়। সাম্যবাদী কাব্যগ্রন্থে কবি মূলত মানুষের কথা বলেছেন। মানুষ কবিতায় বিশ্ব শব্দসম্রাট কাজী নজরুল ইসলাম নব শব্দ সৃষ্টির কারিগর হয়ে সমাজের নব বিনির্মাণের নিমিত্তে সাম্যের গান গেয়েছেন। ১৯২৫ খৃষ্টাব্দের ১৬ই ডিসেম্বর তারিখে কবি কাজী নজরুল ইসলামের সম্পাদনায় ৩৭নং হ্যারিসন রোড, কলিকাতা হতে শ্রমিক-প্রজা-স্বরাজ-সম্প্রদায়ের সাপ্তাহিক মুখপত্ররূপে ‘লাঙল’ পত্রিকা প্রকাশিত হয়। লাঙল পত্রিকাতেই ‘মানুষ’ কবিতাটি প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে ‘সাম্যবাদী’ কাব্যগ্রন্থে কবিতাটি সংকলিত হয়। ‘মানুষ’ কবিতায় কাজী নজরুল ইসলাম বৈষম্যহীন, শোষণমুক্ত এবং অসাম্প্রায়িক মানবসমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য মানুষের জয়গান গেয়েছেন। ‘মানুষ’ কবিতায় কবি বেশ কিছু পৌরাণিক চরিত্র ও মহানবীরদের বীরত্বগাঁথাকে উপমা হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন: দেবতা, চেঙ্গিস, কালাপাহাড়, ঈসা, কৃষ্ণ, বৃদ্ধ, নানক, কবীর, কল্কি, মেহেদী ইসা, চণ্ডাল, হরিশচন্দ্র, শ্মশানের শিব, ব্রজের গোপাল, বলরাম, ভোলানাথ গিরিজায়া, মন্দোদরী ইত্যাদি। দেবতা: সাধারণ অর্থে দেবতা হল আধ্যাত্মিক শক্তির অধিকারী। দেবতারা স্বর্গের অধিবাসী পরম পূজনীয় ও পবিত্র বলে বিবেচিত। পুরুষ দেবতাকে দেব এবং নারী দেবতাকে দেবী ডাকা হয়। পুরাণে পুরুষ দেবতার মধ্যে ব্রক্ষ্মা, বিষ্ণু ও শিব হচ্ছেন প্রধান। এঁদের একত্রে বলা হয় ত্রিদেব। নারী দেবতার মাঝে আছেন দুর্গা বা পার্বতী, কালী, জগদ্ধাত্রী, অন্নপূর্ণা প্রভৃতি দেবী শক্তি দেবতা রূপে পূজিত হন। কিছু লৌকিক দেবতাও পুরাণে দেখা যায়, যেমন শীতলা, মনসা, ষষ্ঠী প্রভৃতি। তেত্রিশ কোটি দেবতার কথা বলা হলেও মূলত দেবতার সংখ্যা ৩৩। তেত্রিশ কোটি শব্দটি ভুলবশত প্রয়োগ করা হয়েছে। যর্জুবেদে দেবতার সংখ্যার বর্ণনায় বলা হয়“ত্রয়স্তিমাশতি কোটি” দেবতা। সংস্কৃত ভাষায় কোটি শব্দের দুটি অর্থ, একটি হল ‘প্রকার’ এবং অপরটি হল ‘কোটি’। ভুলবশত কোটি শব্দটির ভুল অর্থ প্রয়োগ করে ৩৩ প্রকার দেবতা পরিবর্তে ৩৩ কোটি দেবতা প্রচার করা হয়। কাজী নজরুল ইসলাম ‘মানুষ’ কবিতায় মূলত মানবিক গুণাবলি যথা: ভ্রাতৃত্ব, দয়া, ও সমতার প্রতীক হিসেবে ‘দেবতা’ শব্দটি ব্যবহার করে বোঝাতে চেয়েছেন মানুষের কষ্ট বুঝে, বিপদগ্রস্ত মানুষকে সাহায্য করে পৃথিবীর মানুষেরাই গোলকধাম ও দেবত্ব সৃষ্টি করতে পারে যেখানে ন্যায় বিচার ও ভ্রাতৃত্ব সদা বিরাজমান থাকবে। কালাপাহাড়: তৎকালীন গৌড় অঞ্চলের অন্তর্গত বর্তমান রাজশাহীর বীরজাওন গ্রামের খ্যাতিমান ব্রাক্ষ্মণ নঞানচাঁদ রায়ের পুত্র কালাচাঁদ রায়। নিয়মিত পূজা অর্চনা ছাড়াও নঞানচাঁদ রায় পেশাগত জীবনে গৌড় অঞ্চলের বাদশাহ সুলায়মান খান কররানীর ফৌজদার হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন। পিতার পরিচয় সুবাদে কালাচাঁদ রায় গৌড়ের সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। সুঠামদেহী বলিষ্ঠ পুরুষ, বিদ্যা ও বুদ্ধিতে বিচক্ষণ কালাচাঁদ যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শিতার পরিচয় দিয়ে সবার নজর কেড়ে নেন। প্রাসাদের অভ্যন্তরে অবাধ যাতায়াতের সুবাদে সুলায়মান খান কররানীর কন্যা দুলারি বিবির সাথে তাঁর প্রণয় গড়ে উঠে। দুলারি বিবিকে বিয়ে করে তিনি প্রধান সেনাপতির পদ লাভ করেন। মুসলিম কন্যাকে বিয়ে করায় ব্রাক্ষ্মণরা ধিক্কার দিয়ে তাকে সমাজ থেকে বহিষ্কার করে। ব্রাক্ষ্মণদের প্রতি ব্রীতস্পৃহ হয়ে তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে 'মহম্মদ ফর্ম্মুলি' নামধারণ করেন। মায়ের অনুরোধে প্রায়শ্চিত্য করার জন্য পুরী মন্দিরে গেলে পুরোহিতরা তাকে ফিরিয়ে দেন। হিন্দু ধর্মে প্রত্যাখাত হওয়ার কারণে প্রবল হিন্দু বিদ্বেষী হয়ে তিনি কালাপাহাড় উপাধি লাভ করেন। গরুর চামড়া দিয়ে বিশাল আকৃতির ঢোল বাজিয়ে কালাপাহাড় মন্দিরে প্রবেশ করতেন। উড়িষ্যার বালেশ্বরের গোপীনাথ মন্দির, ভুবনেশ্বরের কাছে কোনার্ক মন্দির, মেদিনীপুর, ময়ূরভঞ্জ, কটক, কামাখ্যা মন্দিরে ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর পাশাপাশি পুরীর জগন্নাথ দেবের বলভদ্র ও সুভদ্রার কাঠের প্রতিমা উপড়ে ফেলে হুগলীতে নিয়ে আগুনে পুড়িয়ে দেন। সম্বলেশ্বরী মন্দিরে আক্রমণ চালানোর প্রাক্কালে গোয়ালিনীর ছদ্মবেশে এক সুন্দরী ব্রাক্ষ্মণী কালাপাহাড়ের সাথে মিলিত হন। তার দেয়া বিষ মিশ্রিত দুধ, দই ও ছানা খেয়ে কালাপাহাড়ের মৃত্যু হয়। সাম্যের কবি কাজী নজরুল ইসলাম ‘মানুষ’ কবিতায় ধর্মের নামে হওয়া অবিচার ও ভ-ামির বিরুদ্ধে শক্তির প্রতীক হিসেবে কালাপাহাড়কে উপস্থাপন করেছেন। সমাজে অত্যাচার, নিপীড়ন ও বৈষম্য সৃষ্টি হলে সমাজকে কলুষতার কলঙ্ক থেকে মুক্তি প্রদান করে কালাপাহাড়রাই মানুষের জয়গান গাইবেন। ঈসা: যিশু খ্রিষ্ট্রই মূলত ঈসা নবি হিসেবে পরিচিত। যিশু খ্রিষ্ট প্রায় দুই হাজার বছর আগে মাতা মেরির গর্ভে জন্ম গ্রহণ করেন। যীশুর জন্মের সময় তখনকার ইহুদি রাজা হেরদ রাজ জ্যোতিষীর কাছে জানতে পারেন নবজাত এক শিশু খুব শীঘ্রই এদেশের রাজা হবেন। হেরদ বিদ্বেষপরায়ণ হয়ে বেথেলহেম ও তার আশেপাশের নবজাতক সকল পুরুষ সন্তানকে হত্যার আদেশ দিলেন। এই খবর শুনে যীশুর পিতা যোসেফ এবং মাতা মেরী শিশুসন্তানকে নিয়ে মিশরে পালিয়ে যান। যিশু খ্রিষ্ট্রের বয়স যখন ৩০ বছর তখন থেকেই তিনি প্রকাশ্যে ঈশ্বরের বাণী প্রচার করতে শুরু করেন। যিশু খ্রিষ্ট্র ধর্ম প্রচার করতেন একান্ত সাধারণ ভাষায়। যিশু খ্রিষ্ট্র ঈশ্বরের বাণী প্রচারের সাথে সাথে মানুষকে ডেকে বলতে লাগলেন‘ মানুষকে ভালোবাসো’। মানুষের সকল অপরাধ ক্ষমা করো। যারা তোমাদের শত্রু তাদেরকেও ভালোবাসো। মানুষকে ভালোবাসলে ঈশ্বর তোমাদের ভালোবাসবেন।’ মহামানব যীশুর উপদেশ শুনে মানুষ দলে দলে তার দিকে ধাবিত হলে ধীরে ধীরে তাঁর অনুসারীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। তার মুখের অমৃতবাণী শোনার জন্য মানুষ আকুল হয়ে থাকতো। জনপ্রিয়তা ঠেকাতে বিচারের নামে প্রহসন করে যিশুকে মৃত্যুদ-ের আদেশ দেওয়া হয়। মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে ভালোবাসা আর ক্ষমার মহান দূত যিশু খ্রিষ্ট্র ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেছিলেন “হে পিতা, তুমি এদের ক্ষমা করো। ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার চল্লিশ দিন পর যিশু ক্যালভেরি পর্বতে সমবেত শিষ্যদের দর্শন দেন। যিশু তাঁদের বললেন সমস্ত মানুষের কাছে আমার উপদেশ পৌঁছে দাও,দীক্ষিত করো। যারা আমাকে বিশ্বাস করবে তারা অনন্ত শান্তির অধিকারী হবে। অনন্ত কাল আমি তোমাদের সঙ্গে থাকব। এরপরই যিশু অন্তর্ধান করেন । ঈশ্বরপুত্র ফিরে যান তাঁর পিতার কোলে। যিশুর অনুসারীরা খ্রিষ্টান হিসাবে পরিচিত। কৃষ্ণ: কংসের কারাগারে ভাদ্র মাসের মধ্যরাতে শ্রীকৃষ্ণ জন্মগ্রহণ করেন। বসুদেব সূতিকাগারে যশোদার শয্যায় নিজপুত্রকে রেখে যশোদার কন্যাকে সঙ্গে নিয়ে কংসের কারাগারে ফিরে আসেন। কালীয় নামে একটি বিরাট সাপ তাঁর বিষ দ্বারা জলাশয়কে বিষাক্ত করে দিয়েছিল। এই জল পান করে রাখাল ও গরুর মৃত্যু হতো প্রায়শই। বালক কৃষ্ণ জলাশয়ের কাছে গেলে কালীয় নাগ তাকে আক্রমণ করে। কৃষ্ণ কালীয় নাগের মাথার ওপর উঠে নৃত্য করতে শুরু করেন। কালীয় নাগ পরাজয় বরণ করে স্থান ত্যাগ করে। কৈশোরে মথুরায় প্রত্যাবর্তন করে কৃষ্ণ তাঁর মামা কংসকে হত্যা করেন। কংসের পিতা উগ্রসেনকে পুনরায় যাদবকুলের রাজা হিসেবে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করেন। পরে তিনি যাদবদের নিয়ে দ্বারকা নগরীতে বর্তমান গুজরাটে চলে যান। দ্বারকা নগরীকে তিনি স্বর্ণ নগরীতে রূপান্তরিত করেন। অর্জুন যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে তাঁর আত্মীয়স্বজনকে দেখতে পেয়ে অস্ত্র ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিলে কৃষ্ণ অর্জুনকে তার স্বীয় দায়িত্ব সম্পর্কে জ্ঞান প্রদান করেন। তাঁর সমগ্র উপদেশাবলি ভগবদগীতা নামে খ্যাত হয়েছে। বৌদ্ধ: বৌদ্ধ ধর্মের প্রবর্তক গৌতম বুদ্ধ নেপালের লুম্বিনী নগরে জন্মগ্রহণ করেন। বাল্যকালেই তার মাতা মারা যায়। সিদ্ধার্থের পিতা মহারাজ শাক্যবর্ধন তার জীবন বিলাসিতায় ভাসিয়ে দেন। অশোক- তমাল, নীপ-নিকুঞ্জ আর মহুয়া ঘেরা রাজপ্রাসাদে সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে আর বিলাসিতায় তার বাল্যকাল অতিবাহিত হয়। সুন্দরী রাজকুমারীর সাথে বিয়ের পর স্ত্রী পুত্রকে নিয়ে আরাম আয়েশেই তার জীবন চলে যাচ্ছিলো। রোগ-শোক, দুঃখ বলে পৃথিবীতে কোন ব্যাপার আছে তার ধারণাতেই ছিল না। জ্ঞান ছিল না মানুষের জন্ম,মৃত্যু আর বাধর্ক্য সম্পর্কে। কিন্তু একটি ঘটনা তার জীবনকে পাল্টে দেয়। জীবনের উনত্রিশতম বছর বয়সে সিদ্ধার্থ প্রথমবারের মতো তার বন্ধুর হাত ধরে একদিন প্রাসাদের বাইরে বের হন। তিনি রাস্তার ধারে জীবনে প্রথম বারের মতো এক বৃদ্ধ লোক দেখেন। বাধর্ক্যরে ভাড়ে বিপর্যস্ত মানুষের এই রূপ তাকে অবাক করে দেয়। কিছুদূর যাওয়ার পর দেখেন বাজারের পাশে এক মরদেহ পড়ে রয়েছে। মৃতের আত্মীয় স্বজনেরা তার পাশে বসে আহাজারি করছেন। এই দৃশ্য দেখে তিনি ব্যাকুল হয়ে পড়েন। তার ভেতরে নতুন মানুষের জন্ম হয়। তিনি মানুষের জীবন, জীবনের পরিণতি নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে থাকেন। বৈশাখের এক পূর্ণিমার রাতে স্ত্রী,পুত্র,বাবা,মা,রাজপ্রাসাদ ও রাজপ্রাসাদের বিলাসিতা ত্যাগ করে বেছে নেন সন্ন্যাসের শান্ত স্নিগ্ধ করকমল। আহার-নিদ্রা,কামনা-বাসনা ত্যাগ করে একটানা ছাব্বিশ বছর গভীর ধ্যানে মগ্ন হয়ে অবশেষে তিনি সত্যের সন্ধান পান। বোধিবৃক্ষের তলে তপস্যা করে অসীম জ্ঞানের অধিকারী হয়ে মনুষ্য লয়ে ফিরে এসে মানুষের মাঝে প্রেম,সত্য আর ভালোবাসার অহিংস নীতি প্রচার করেন। নানক: শিখ ধর্মের প্রবর্তক গুরু নানক অবিভক্ত ভারতে (বর্তমান পাকিস্তানে) জন্মগ্রহণ করেন। সাম্য, ভ্রাতৃত্ব ও সহনশীলতার পাঠ নিয়ে তিনি সমগ্র ভারতে শান্তির বানী প্রচার করেন। মানুষকে ভালোবাসা, সবার মধ্যে একতা এবং নিঃস্বার্থ সেবার ব্রত দিয়ে মানুষের জয় করেন তিনি। কবীর: কবীর অবিভক্ত ভারতের প্রয়াগ অর্থাৎ বর্তমান এলাহাবাদে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ভারতের কুসংস্কারাছন্ন সমাজের জাতপ্রথা ও বর্ণপ্রথার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। তিনি হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে সাম্যের বাণী প্রচার করে মানুষের মঙ্গলের জন্য জয়গান রচনা করেন। তিনি হিন্দু দর্শন, সুফি দর্শন ও বাউল দর্শন দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সাধারণ মানুষকে ধর্মের অভয়বাণীর জ্ঞান প্রদান করেন। কল্কি: কলি যুগের অন্তিমলগ্নে ভগবান বিষ্ণু কল্কি অবতাররূপে একজন বিষ্ণুভক্তের ঔরসে ধরাধামে অবতীর্ণ হবেন। তিনি বিষ্ণুর ষষ্ঠ অবতার পরশুরামের নিকট থেকে অস্ত্রশিক্ষা লাভ করে সমস্ত অনাচার ও অধর্মের বিনাশ সাধন করবেন। বিষ্ণুর ত্রেতা যুগের অবতার ভগবান রামচন্দ্রের মতো কল্কিরও তিনজন ভ্রাতা থাকবে যারা বিষ্ণু ভক্ত ও দৈবশক্তিধারী হবেন। ভগবান কল্কি তাঁর দুই স্ত্রী পদ্মা ও রমা এবং চার সন্তান জয়, বিজয়, মেঘওয়াল ও বালা হকসহ শিবের আরাধনা করে শৈবশক্তি অর্জন করবেন। ভগবান কল্কি দেবদত্ত নামক সাদা রঙের ঘোড়ায় আরোহণ পাপীদের বিনাশ করবেন। সমস্ত অসত্য, অসাম্য, বৈষম্য নিপীড়নসহ সব কিছু ধ্বংস সাধন করে পুনরায় সত্যযুগের সূচনা করবেন। মেহেদী: ধরিত্রীতে অত্যাচারের মাত্রা বেড়ে গেলে মানুষের পরিত্রাতা হিসেবে মেহেদী আবির্ভূত হবেন। তিনি মন্দ ও অন্যায় থেকে বিশ্বকে পরিত্রাণ দেওয়ার জন্য কেয়ামতের কিছু দিন আগে উপস্থিত হবেন। চণ্ডাল: হিন্দু ধর্মের চার বর্ণের মধ্যে চণ্ডাল সর্বাপেক্ষা নিম্নস্থানীয়। চণ্ডালরা মূলত মৃতদেহ সৎকারের কাজ করে থাকেন। চণ্ডালকে অস্পৃশ্য বলে বিবেচনা করা হয়। হরিশচন্দ্র: সত্যবাদী, ন্যায়-পরায়ণ ও নীতিনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিতি রাজা হরিশচন্দ্র ছিলেন মহা দানবীর। একদা এক শরণাগতকে রক্ষার্থে রাজা হরিশচন্দ্র ধ্যানমগ্ন দুর্বাসা মুনির ধ্যানভঙ্গের কারণ হন। ক্রুদ্ধ দুর্বাসা অভিশাপ প্রদান করতে চাইলে রাজা হরিশচন্দ্র ক্ষমা প্রার্থনা করেন। ঋষি দুর্বাসা সম্পূর্ণ রাজত্ব গ্রহণ করার বিনিময়ে অভিশাপ প্রদান করা থেকে নিবৃত হন। রাজত্ব গ্রহণের পর দক্ষিণা চাইলে রাজা হরিশচন্দ্র আপন পুত্র ও স্ত্রীকে বিক্রি করে দেন। এতেও মুনির চাহিদা না মিটলে রাজা হরিশচন্দ্র নিজেকে মুনির হাতে তুলে দেন। দুর্বাসা এক লক্ষ স্বর্ণ মুদ্রার বিনিময়ে হরিশচন্দ্রকে চন্ডালের কাছে বিক্রি করে দেন। চন্ডালের চাকর হয়ে মৃতদেহ সৎকারের কাজে নিয়োজিত হন রাজা হরিশচন্দ্র। রাজা হরিশচন্দ্রের প্রিয়তম পত্নী তারামতী দাসীর কাজে নিয়োজিত হন আর পুত্র রোহিতাশ্ব কাঠ সংগ্রহ করার কাজ করেন। একদিন কাঠ সংগ্রহকালে রোহিতাশ্ব সর্পাঘাতে মৃত্যুবরণ করে। তারামতী পুত্রকে শ্মশানে দাহ করতে নিয়ে গেলে চন্ডালরূপী রাজা হরিশচন্দ্র পুত্রকে চিনতে পেরে অশ্রুসজল নয়নে মুখাগ্নি করতে উদ্যত হলে ঋষি দুর্বাসা আবির্ভূত হয়ে রোহিতাশ্বের প্রাণ ফিরিয়ে দেন। নজরুল মানুষ কবিতায় চণ্ডাল ও হরিশ্চন্দ্র শব্দ দুটো দ্বারা বোঝাতে চেয়েছেন যে, সামাজিক শ্রেণি, বর্ণ বা পদবি নয় বরং মানুষের মর্যাদা নির্ধারিত হয় তাদের আদর্শ, মনোভাব ও মানবিক গুণাবলীর মাধ্যমে। কবি ‘উঁচু’ ও ‘নিচু’ জাতির বিভাজন ভেঙে মানুষের জন্য সমতার সাম্রাজ্য সৃষ্টির লক্ষ্যে মানুষকে সবার ঊর্ধ্বে তুলে আনার প্রয়াস ব্যক্ত করেছেন। শ্মশানের শিব: কাজী নজরুল ইসলাম তার মানুষ কবিতায় শ্মশানের শিবের উপমা দ্বারা ধ্বংসের মাধ্যমে নব সৃষ্টির জয়গান রচনা করেছেন। হিন্দু পৌরাণিক থেকে তিনি শিবকে তুলে এনেছেন বিদ্রোহের ধ্বংসাত্মক এবং নব সৃষ্টির রূপ দেখানোর জন্য। মহাদেব বিভিন্নরূপে সমগ্র সৃষ্টি জুড়ে আছেন। মহাদেবের ইঙ্গিতেই প্রলয়লীলা ঘটে থাকে। পুরুষবেশী মহাদেবের নৃত্যকে তা-ব নৃত্য বলা হয়। এই নাচ ধ্বংসের পরিচয় বহন করে। কবি মূলত শিবের উপমা দ্বারা আমাদের অজ্ঞতা-মূর্খতা, হানাহানি-সংঘাতকে ধ্বংস করে মনের ভেতর নবসৃষ্টির প্রদীপ প্রজ্বলন করতে চেয়েছেন। ব্রজের গোপাল: ব্রজের গোপাল বলতে শ্রীকৃষ্ণকে বোঝানো হয়েছে। শ্রীকৃষ্ণ ব্রজের গোপালরূপে ব্রজযোগিনীদের সাথে লীলা করেছেন। পুরাণে শ্রীকৃষ্ণের নিত্য অষ্টপ্রহরের আটটি লীলার কথা বলা আছে যার মধ্যে একটি দিব্যলীলাস্থল হলো ব্রজধাম। কিশোর কৃষ্ণ আর রাধারানীর যে মাধুর্যপূর্ণ প্রেমের পরিপূর্ণ প্রকাশ বৃন্দাবনে স্থাপিত হয়েছিল তারই লীলা ব্রজধামে সংগঠিত হয়। কবি এক ও অভিন্ন সত্তার এক পরমপুরষের আখ্যানমালা দিয়ে বিদ্রোহীর প্রেমযাত্রার পথ রচনা করতেই ব্রজলীলার প্রসঙ্গ তুলে ধরেছেন। নজরুল ‘ব্রজের গোপাল’ শব্দটির উপমা দ্বারা বুঝিয়েছেন সমাজে তুচ্ছ, অবহেলিত সাধারণ মানুষ অর্থাৎ রাখাল, চাষা এদের নীচু চোখে দেখা হলেও এদের ভেতরেও ঈশ্বরতুল্য মানবসত্তা লুকিয়ে রয়েছে। শ্রীকৃষ্ণ ব্রজের গোপাল অর্থাৎ গরুর রাখাল হয়েও মহান পুরুষ হিসেবে আবির্ভূত হয়ে ধরাধামকে পাপ পঙ্কিলের কলুষ হতে মুক্ত করেন। জনক রাজা: রাজা জনক ছিলেন মিথিলার রাজা। তিনি ছিলেন সীতার পিতা। রাবণ ঋষিদের হত্যা করে তাঁদের রক্ত একটি বৃহৎ কলসে সঞ্চয় করে রাখতেন। ঋষি রক্ত হলো সব বিষের চেয়েও বিষাক্ত। ঋষিদের হত্যা করায় রাবণের স্ত্রী মন্দোদরী ক্রুদ্ধ হয়ে বিষাক্ত রক্ত পান করে আত্মহত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয়। রক্তের সাথে দুগ্ধ মিশ্রিত ছিল বিধায় মন্দোদরী গর্ভবতী হয়ে পড়েন। মন্দোদরী তাঁর ভ্রুণাংশটি মাটির নিচে লুকিয়ে রাখেন। বহুবছর পর রাজা জনক হাল চাষ করতে গেলে তার লাঙ্গলের হল দ্বারা মাটির নীচ থেকে এই কন্যাকে আবিষ্কার করেন এবং কন্যার নাম রাখেন সীতা। জনকের পণ ছিল যে ব্যক্তি হরধনু ভঙ্গ করতে পারবে তাকেই কন্যাদান করবেন । রাম এই শর্ত পূরণ করে সীতাকে পত্নী হিসেবে লাভ করেন। বলরাম: বলরাম বিষ্ণুর একজন অবতার। দ্বাপর যুগে লক্ষ্মণ কৃষ্ণের বড় ভাই হিসেবে জন্মগ্রহণের ইচ্ছা পোষণ করে। তাই দেবকীর সপ্তম গর্ভে বলরামরূপে আশ্রয় নেন তিনি। বলরাম ছিল শান্ত প্রকৃতির। কিন্তু তাঁর রাগ ছিল ভয়াবহ। বাল্যকালে একদিন বলরাম স্নান করতে যমুনায় যান। বলরাম যমুনা নদীকে তাঁর সাথে খেলা করতে বলেন । যমুনা এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। প্রত্যাখাত বলরাম ক্রুদ্ধ হয়ে যমুনা নদীকে তাঁর লাঙল দ্বারা আঘাত করেন। যমুনা নদী খণ্ডবিখণ্ড হয়ে যায়। নদীকে তীরে এনে শাস্তির ব্যবস্থা করেন। অবশেষে যমুনা তাঁর স্বমূর্তিতে আবির্ভূত হয়ে বলরামের কাছে ক্ষমা চান। বলরাম অস্ত্রবিদ্যায় ছিলেন অত্যন্ত পারদর্শী। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে না পেরে বলরাম তীর্থ ভ্রমণে বের হন। তীর্থ ভ্রমণ শেষে কুরুক্ষেত্রে আসেন। ভীম অন্যায়ভাবে দুর্যোধনের কোমরের নিচে আঘাত করে তাকে হত্যা করেন। গদাযুদ্ধের নিয়ম লঙ্ঘনের অপরাধে ক্রুদ্ধ হয়ে ভীমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। যদু বংশ ধ্বংসের পর প্রিয় ভ্রাতা কৃষ্ণ দেহত্যাগ করেন। প্রিয় ভ্রাতার শোকে বলরাম দ্বারকার এক বটবৃক্ষের নিচে যোগ সাধনায় বসেন। এ সময় তাঁর মুখ থেকে রক্তবর্ণ ও সহস্রমুখ এক সাপ নির্গত হয়ে সমুদ্রে চলে যায়। এরপর তিনি দেহত্যাগ করেন। কবি নজরুল তাঁর ‘মানুষ’ কবিতায় বলরামকে সমাজে বিপ্লব আনার জন্য এবং সৃষ্টিকে পরিবর্তনের হেতু হিসেবে ব্যবহার করেছেন। কাজী নজরুল ইসলামের “মানুষ” কবিতায় ‘জনক রাজা’ ও ‘বলরাম’ শব্দ দুটি মূলত পৌরাণিক রেফারেন্স হলেও নজরুল এগুলো ব্যবহার করেছেন মানবতাবাদী, অসাম্প্রদায়িক ও সাম্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে। ‘জনক রাজা’ ও ‘বলরাম’ হলেন শক্তির প্রতীক যারা কৃষির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন। নজরুল বোঝাতে চেয়েছেন যাদের আমরা সাধারণ কৃষক বলে অবজ্ঞা করি তাদের মধ্যেই বলরাম ও রাজা জনকেরা দেবত্ব শক্তি ধারণ করে বিরাজমান আছেন। তাদের অবজ্ঞা করা মানে বলরাম ও রাজা জনকের শক্তিকে অস্বীকার করা। তাই মানবসাধক নজরুল সকল মানুষের ভেতরে সৃষ্টির অস্তিত্ব স্বীকার করে সবাইকে সমতার জয়গান গাইতে বলেছেন। ভোলানাথ: হিন্দু পৌরাণিকে ভোলানাথ বলতে শিবকে বুঝানো হয়েছে। ভোলানাথ হলেন একজন পরম সত্তা মহাপরুষ। তিনি মহাজগতের পরাচৈতন্যের প্রতিভূ। মর্ত্যে ভোলানাথ শিবলিঙ্গ হিসেবে পুজিত হন। ভোলানাথ জীব জগতের সকলের কল্যাণ দান করে থাকেন। তিনি কল্যাণ কর্তা আদিপুরুষ। তাঁর মাথায় অর্ধচন্দ্র, কণ্ঠে সর্পাহার এবং জটায় দেবী গঙ্গার অবস্থান। মাথার অর্ধচন্দ্র জটার মধ্যে লুকানো অবস্থায় রয়েছে। এই অর্ধচন্দ্র হল জ্ঞানের প্রতীক। গলায় অবস্থিত সাপের কুণ্ডল হল কুলকুন্ডলিনীর প্রতীক, জটায় অবস্থিত দেবী গঙ্গা বিশুদ্ধতার প্রতীক, যা বিশুদ্ধ জ্ঞানকে সংযোগ করে। শঙ্করের ত্রিশূল ত্রিগুণ, ত্রিকাল, সৃষ্টি-স্থিতি এবং লয়ের প্রতীক। মহাদেবই সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর ও কলি এই চার যুগের সৃষ্টি করেন। তিন যুগের অবতার লীলা শেষ করে মহাদেব কলি যুগে অবতীর্ণ হবেন। কলিযুগে ভোলানাথ শঙ্কর নামে মানবরূপ ধারণ করে সৃষ্টি-কে সংহার করবেন এবং নব সৃষ্টির আগমন বার্তা প্রকাশ করবেন। গিরিজায়া: গিরিজায়া বলতে কবি দেবী দুর্গাকে বুঝিয়েছেন। দুর্গা শব্দটির উল্লেখ প্রথম পাওয়া যায় তৈত্তেরীয় আরণ্যকে। দিতির পুত্র দুর্গাসুরকে বধ করায় তার নাম হয় দুর্গা। দেবী দুর্গা হিমালয়ে বাস করেন। দুর্গাকেই গিরিজায়া নামে অভিহিত করা হয়। তিনি মায়ের মতো আগলে রেখে সমস্ত বাধাবিঘ্ন, রোগ-শোক, পাপ-ভয়, শত্রু ও বিপদ থেকে মানুষকে রক্ষা করে থাকেন বলে তাঁকে বিশ্ব মা বলে অভিহিত করা হয়েছে। কাজী নজরুল ইসলাম ‘মানুষ’ কবিতায় ভোলানাথ ও গিরিজায়ার পৌরাণিক উপমা দ্বারা মূলত মানুষের ভেতরে এই দেবত্ব শক্তির অনুসন্ধান করেছেন। সমাজ যে-সব ভিখারি বা দীন-দরিদ্র মানুষকে অবজ্ঞা করে, অপমান করে তাদের মধ্যেই ঈশ্বরের রূপে ভোলানাথ ও গিরিজায়া বিরাজ করেন। মানুষই সর্বোচ্চ ধর্ম আর মানবতাই প্রকৃত পূজা। ঈশ্বর মন্দিরে নয়, সাধারণ মানুষের মধ্যেই বিরাজ করেন। তাই দরিদ্র ও অবহেলিত মানুষদের অপমান করা মানে ঈশ্বরকেই অপমান করা। মানুষের মধ্যেই ঈশ্বরের বসবাস তাই সব মানুষের প্রতি সমান শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা দেখানোই প্রকৃত ধর্ম। মন্দোদরী: স্বর্গের সুন্দরী অপ্সরা হেমা এবং ময়দানবের কন্যা মন্দোদরী ছিলেন মহাপরাক্রমশালী রাবনের স্ত্রী। মন্দোদরী ছিলেন মধুরা নামের এক অপ্সরা। কিশোরী বয়সে একদা মধুরা কৈলাসে শিবের পুজো করতে গেলে শিব সৌন্দর্যে বিমোহিত হন। পার্বতীর অনুপস্থিতিতে মহাদেবের কাছে নিজেকে নিবেদন করে দেন। পার্বতী মধুরার বুকের উপর মহেশ্বরের ভস্মের চিহ্ন দেখতে পেয়ে মধুরাকে কুয়োর ব্যাঙ হয়ে থাকার অভিশাপ দেন। পার্বতীর অভিশাপে কুয়োয় বন্দী হয়ে ব্যাঙ হিসেবে বারো বছর কাটিয়ে দেন। মহাপরাক্রমশালী রাবন তাকে কুয়ো থেকে মুক্তি দিয়ে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করেন। মন্দোদরী রাবণকে সীতা হরণের জন্য তিরস্কার করেন। তিনি সীতাকে শ্রীরামের কাছে ফিরিয়ে দেবার জন্য বারবার রাবণকে অনুরোধ করলেও রাবণ তা প্রত্যাখান করেন। রাবণ অমরত্বের বরদান প্রাপ্ত ছিল। সাধারণ কোনো অস্ত্রে বধ করা তাকে সম্ভব ছিল না। তাঁর মরণাস্ত্রের বিশেষ তীর মন্দোদরীর কাছে সুরক্ষিত ছিল। বিভীষণের নিকট থেকে এই তথ্য পেয়ে হনুমান কৌশলে তাঁর কাছ থেকে সেই বিশেষ তীরটি চুরি করে আনেন। রামকর্তৃক রাবণবধ করা হয়। রাবণের মৃত্যুর পর বিভীষণের সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়। কাজী নজরুল ইসলাম ‘মানুষ’ কবিতায় মন্দোদরীর উপমা দ্বারা মূলত শোষণকারী, অত্যাচারী ও সাম্রাজ্যবাদী প্রভূদের নিপীড়নের দিকে দৃষ্টিপাত করেছেন। যারা অন্যায়ভাবে জনমানুষকে শোষণ করে তাদের ধ্বংসের বীজ তাদের ভোগের মধ্যেই লুকায়িত থাকে। এই বীজ একদিন মহীরূহ আকার ধারণ করে নিজের উপড়েই আছড়ে পড়ে। কবি মানুষকে মানুষ হিসেবে মর্যাদা দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, অবিচার-ভিত্তিক সমাজ একদিন নিশ্চিহ্ন হবেই। কাজী নজরুল ইসলামের ‘মানুষ’ কবিতাটি বিশ্বসাহিত্যের একটি অনন্য ম্যাগনাকার্টা। ‘মানুষ’ কবিতায় পৌরাণিক উপমার সাহায্যে কাজী নজরুল ইসলাম মানুষের আত্মমর্যাদা, চেতনা ও মানবিক গৌরবকে দেবত্বের চেয়েও উচ্চে স্থান দিয়েছেন। পৌরাণিক চরিত্রগুলোর দ্বারা কবি বোঝাতে চেয়েছেন মানুষই সেই অনন্য সত্তা, যার মধ্যে আছে সৃষ্টির শক্তি, প্রেম, করুণা ও প্রতিবাদের সাহস। ‘মানুষ’ কবিতা যুগ যুগ ধরে চলে আসা সমাজের ধর্মীয় গোঁড়ামি, বর্ণবৈষম্য,অনাচার এবং শ্রেণিবিভক্ত সমাজের বিরুদ্ধে একটি মহাবিদ্রোহের ঘোষণা। শুধু এই একটি কবিতা দিয়েই একটি মহাকাব্য রচনা করা যেতে পারে। মানুষের প্রকৃত ধর্ম হলো মানবতা আর মানবিক চেতনা। এই মানবিক চেতনাকে হৃদয়ে ধারণ করে সমস্ত রকম বিভেদ ও অসহিষ্ণুতাকে এড়িয়ে মানুষ হিসেবে আমাদের কর্তব্য হলো ভালোবাসা, সহানুভূতি ও ন্যায়ের পথে চলা। ঐতিহাসিক রেফারেন্স: ১. ছেলেদের মহাভারত : উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরি ২. বৃহৎ শ্রীমদ্ভাগবত : শ্রী বেণীমাধব শীল ৩. বৃহদারণ্যকোপনিষদ: মহামহোপাধ্যায় দুর্গাচরণ ৪. পুরাণসংগ্রহ : বিষ্ণু পুরাণ ; অশোক চট্টোপাধ্যায় ৫. ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ : ড. গৌরিনাথ শাস্ত্রী ৬. হিন্দুধর্ম : ক্ষিতিমোহন সেন ৭. অষ্টাদশ পুরাণ কাহিনি : পৃথ্বিরাজ সেন ৮. উপনিষদ অখ- সংস্করণ : অতুল চন্দ্র সেন ৯. বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন : উপল তালুকদার ১০. শ্রী শ্রী চণ্ডী: নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় লেখক : দেবব্রত নীল
বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকে পদোন্নতিতে অনিয়ম ও অসঙ্গতির অভিযোগে দায়ের করা রিটের পরিপ্রেক্ষিতে মহামান্য হাইকোর্ট রুল জারি করেছেন। একই সঙ্গে আদালত নির্দেশ দিয়েছেন, রুল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত পদোন্নতি সংক্রান্ত যেকোনো কার্যক্রম অবৈধ হিসেবে গণ্য হবে। দেশের বৃহত্তম রাষ্ট্রায়ত্ত বিশেষায়িত ব্যাংকটির ১০ম গ্রেডের পদোন্নতি–বঞ্চিত কর্মকর্তারা দীর্ঘদিন ধরে ন্যায্য পদোন্নতির দাবিতে শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন করে আসছিলেন। দাবি আদায়ে বারবার কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন ও মানববন্ধন করেও সাড়া না পেয়ে তারা শেষ পর্যন্ত আদালতের দ্বারস্থ হন। সূত্র জানায়, পদোন্নতি–বঞ্চিত কর্মকর্তারা গত বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর (শনিবার) ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের সামনে ছুটির দিনে শান্তিপূর্ণ মানববন্ধন করেন, যাতে গ্রাহকসেবা ব্যাহত না হয়। তাদের দাবির প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করে তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শওকত আলী খান দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার আশ্বাস দেন। তবে তিন মাস পার হলেও প্রতিশ্রুত আশ্বাস বাস্তবায়িত না হওয়ায় তারা পুনরায় ওই বছরের ৩০ নভেম্বর মানববন্ধনের আয়োজন করেন। এতে সারা দেশের শাখা থেকে ১২০০–এর বেশি কর্মকর্তা অংশ নেন। পরদিন (১ ডিসেম্বর) বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক সঞ্চিয়া বিনতে আলী পদোন্নতির বিষয়ে মৌখিক আশ্বাস দিলে আন্দোলনকারীরা কর্মস্থলে ফিরে যান। পরে কর্মকর্তাদের জানানো হয়, সুপারনিউমারারি পদ্ধতিতে মার্চের মধ্যে পদোন্নতির বিষয়টি সমাধান করা হবে। কিন্তু এখনো তা বাস্তবায়ন হয়নি। অন্যদিকে অগ্রণী, জনতা, রূপালী ও সোনালী ব্যাংকে ইতোমধ্যে মোট ৭,৩১৬ কর্মকর্তা এই পদ্ধতিতে পদোন্নতি পেয়েছেন, যা অর্থ মন্ত্রণালয়ও অনুমোদন করেছে। পদোন্নতি–বঞ্চিত কর্মকর্তাদের অভিযোগ, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের এই উদাসীনতা তাদের প্রতি কর্মীবান্ধবহীন মনোভাব ও কর্তৃপক্ষের অনীহারই প্রকাশ। তারা বলেন, গত বছরের ৫ আগস্ট স্বৈরাচার পতনের পর অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানে পরিবর্তন এলেও কৃষি ব্যাংকে আগের প্রশাসনিক কাঠামো অপরিবর্তিত রয়ে গেছে, যা ন্যায্য দাবি আদায়ের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের অভিযোগ, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, মহাব্যবস্থাপক ও মানবসম্পদ বিভাগের উপমহাব্যবস্থাপক জাহিদ হোসেন একাধিক বৈঠকে আশ্বাস দিলেও বাস্তব পদক্ষেপ না নিয়ে বরং আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী কর্মকর্তাদের হয়রানি ও নিপীড়ন করা হয়েছে। ফলে তারা বাধ্য হয়ে এ বছরের চলতি মাসে হাইকোর্টে রিট দায়ের করেন (রিট মামলা নং: ১৬৪২৮/২০২৫, মো. পনির হোসেন গং বনাম রাষ্ট্র ও অন্যান্য)। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৬ অক্টোবর হাইকোর্ট রুল জারি করে জানতে চেয়েছেন, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের পদোন্নতিতে দেখা দেওয়া অনিয়ম ও অসঙ্গতি কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না। পাশাপাশি আদালত নির্দেশ দিয়েছেন, রুল নিষ্পত্তির আগে কোনো পদোন্নতি কার্যক্রম শুরু করা হলে তা অবৈধ ও আদালত–অবমাননার শামিল হবে। রিটে বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক পদোন্নতিতে ১০৭৩ জন কর্মকর্তা (ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা থেকে মূখ্য কর্মকর্তা) এবং ৫১ জন মূখ্য কর্মকর্তা (ঊর্ধ্বতন মূখ্য কর্মকর্তা পদে) অনিয়মের মাধ্যমে পদোন্নতি পেয়েছেন। এদিকে জানা গেছে, পূর্বে দুর্নীতির অভিযোগে আলোচিত মানবসম্পদ বিভাগের উপমহাব্যবস্থাপক জাহিদ হোসেন এখনো পদোন্নতি কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। পদোন্নতি–বঞ্চিত কর্মকর্তারা বলেন, হাইকোর্টের নির্দেশ অমান্য করে যদি পুনরায় অনিয়মের পথে যাওয়া হয়, তাহলে তা আদালতের অবমাননা ও রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল হবে। তারা আশা করছেন, এ বিষয়ে দ্রুত ন্যায়বিচার ও সমাধান মিলবে।
বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকে সাম্প্রতিক সময়ে পদোন্নতি ও প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। পদোন্নতিবঞ্চিত কর্মকর্তাদের একটি অরাজনৈতিক সংগঠন ‘বৈষম্য বিরোধী অফিসার্স ফোরাম’ এর কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক মো. পনির হোসেন ও সদস্য সচিব এরশাদ হোসেনকে শৃঙ্খলাজনিত মোকদ্দমা এবং মুখ্য সংগঠক মো. আরিফ হোসেনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া মুখপাত্র তানভীর আহমদকে দুর্গম অঞ্চলে বদলি করা হয় এবং সারাদেশের দুই শতাধিক কর্মকর্তাকে ব্যাখ্যা তলব করা হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে যে, মো. আরিফ হোসেনকে বরখাস্ত করার নথিতে তাকে ‘ব্যাংক ও রাষ্ট্রবিরোধী’ আখ্যা দেওয়া হয়েছে, অথচ ব্যাখ্যা তলবপত্রে বলা হয় তিনি ‘রাজনৈতিক কাজে তহবিল সংগ্রহ করেছেন।’ ফরেনসিক বিশ্লেষণ অনুযায়ী, তার ব্যাখ্যাতলবের জবাব প্রদানের পরও বরখাস্ত চিঠি আগেই তৈরি করা হয়েছিল, যা অনেক কর্মকর্তার মধ্যে প্রশ্ন তোলেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক মহাব্যবস্থাপক জানিয়েছেন, সরকারি কর্মকর্তারা যদি সংবিধান বা আইন অনুযায়ী দায়িত্ব না পালন করেন, হাইকোর্ট তাদের ক্ষমতা প্রয়োগ বা অপব্যবহার রোধের জন্য আদেশ দিতে পারে। অন্য একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জানান, এ সিদ্ধান্তের পেছনে ব্যাংকের ফ্যাসিস্ট সরকারের সহযোগী একটি সিন্ডিকেট রয়েছে। মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা বলছেন, পদোন্নতি ও ন্যায়বিচারের জন্য আন্দোলন এবং আইনি লড়াই চলবে। ভুক্তভোগী কর্মকর্তারা শিগগিরই বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, অর্থ উপদেষ্টা ও প্রধান উপদেষ্টার কাছে এ বিষয়ে প্রতিকার চাইবেন। এ ব্যাপারে মো. আরিফ হোসেন ও পনির হোসেনের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকে একটি ভুয়া কর্মচারী ইউনিয়নের সভায় জোরপূর্বক কর্মকর্তাদের অংশগ্রহণ করানোর অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন ব্যাংকের ভিজিল্যান্স স্কোয়াডের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা তাসলিমা আক্তার লিনা ও তার স্বামী মিরাজ হোসেন। গত ২০ অক্টোবর প্রধান কার্যালয়ের অডিটোরিয়ামে ‘বিশেষ সাধারণ সভা’ নামে একটি অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক এমপ্লয়িজ ইউনিয়নের (সিবিএ) নামে তারা এটির আয়োজন করে। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হিসেবে বিএনপির কার্যনির্বাহী কমিটির সহ-শ্রম বিষয়ক সম্পাদক হুমায়ুন কবির খান ও উদ্বোধক হিসেবে জাতীয়তাবাদী শ্রমিকদলের সভাপতি আনোয়ার হোসাইনকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। তবে তারা প্রকাশিত খবরের মাধ্যমে ভুয়া নেতাদের কার্যকলাপ সম্পর্কে অবগত হয়ে অনুষ্ঠানটি বয়কট করেন। অভিযোগ রয়েছে, তাসলিমা আক্তার লিনা হেড অফিসের বিভিন্ন দপ্তরের নারী কর্মকর্তা এবং তার স্বামী মিরাজ হোসেন পুরুষ কর্মকর্তাদের ভয়ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে ওই সভায় অংশগ্রহণে বাধ্য করেন। অংশগ্রহণে অস্বীকৃতি জানালে বদলি বা পদোন্নতি রোধের হুমকিও দেওয়া হয় বলে জানা গেছে। হেড অফিসের কয়েকজন কর্মকর্তার ভাষ্য অনুযায়ী, লিনা তার স্বামীর প্রভাব খাটিয়ে নারী সহকর্মীদের ওপর দীর্ঘদিন ধরে অনৈতিক প্রভাব বিস্তার করে আসছেন। কেউ আপত্তি জানালে মিরাজের সহযোগীরা এসে অশালীন আচরণ ও গালিগালাজ করে থাকে বলেও অভিযোগ ওঠে। এ ছাড়া, লিনা ‘উইমেনস ফোরাম’ নামে একটি সংগঠন গড়ে মাসিক চাঁদা সংগ্রহ করছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। তার এই কর্মকাণ্ডে অনেক নারী কর্মকর্তা বিব্রতবোধ করলেও চাকরির স্বার্থে নীরব থাকছেন। অভ্যন্তরীণ সূত্রে জানা গেছে, মানবসম্পদ বিভাগের ডিজিএম জাহিদ হোসেনের প্রত্যক্ষ সহায়তায় তাসলিমা আক্তার লিনা ও তার স্বামী মিরাজ ব্যাংকের অভ্যন্তরে প্রভাব বিস্তার করছেন। এ ঘটনায় নারী কর্মকর্তাদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ও অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। তারা কর্তৃপক্ষের কাছে তাসলিমা আক্তার লিনা ও মিরাজ হোসেনকে অবাঞ্ছিত ঘোষণার দাবি জানিয়েছেন। এ বিষয়ে জানতে তাসলিমা আক্তার লিনার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমি নিয়ম অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করছি, অভিযোগগুলো ভিত্তিহীন। অন্যদিকে, মিরাজ হোসেনের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে সংঘটিত এজাহারভুক্ত হত্যা মামলার ওয়ারেন্টভুক্ত আসামি ফয়েজ উদ্দিন আহমেদ ও মিরাজ হোসেন পলাতক রয়েছেন। ব্যাংক প্রশাসন বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। খুনের শিকার কৃষি ব্যাংকের অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী আব্দুল হালিম ছিলেন কৃষি ব্যাংক এমপ্লয়িজ ইউনিয়নের (সিবিএ) সভাপতি। তার গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলায়। পরিবারের ভাষ্য অনুযায়ী, তিনি স্থানীয়ভাবে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। মামলার বিবরণ অনুযায়ী, ১ নম্বর আসামি হিসেবে অবসরপ্রাপ্ত পিয়ন ফয়েজ উদ্দিন আহমেদ এবং ২ নম্বর আসামি মিরাজ হোসেনের নাম রয়েছে। তারা বর্তমানে নিজেদের সিবিএ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দাবি করে ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে প্রভাব বিস্তার করছেন। ব্যাংক সূত্রে গেছে, তারা চাঁদাবাজি, ঘুষ আদায় ও নানা অনিয়মের সঙ্গে জড়িত। সূত্র জানায়, ব্যাংকের ভেতরে একটি সিন্ডিকেটের প্রভাবেই এসব আসামিরা এখনো বহাল তবিয়তে রয়েছেন। এই সিন্ডিকেটের নেতৃত্বে আছেন মানবসম্পদ বিভাগের ডিজিএম জাহিদ হোসেন। এতে আরও যুক্ত রয়েছেন ডিজিএম সৈয়দ লিয়াকত হোসেন, হাবিব উন নবী, ডিএমডি খালেকুজ্জামান জুয়েল ও ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সঞ্চিয়া বিনতে আলী। গত বছরের ১৮ ডিসেম্বর রাতে মতিঝিলের বিমান অফিসের সামনে আব্দুল হালিমের মৃত্যু হয়। পরদিন সকালে পুলিশ মরদেহ উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে পাঠায়। মতিঝিল থানার উপ-পরিদর্শক সজীব কুমার সিং সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করে জানান, পুরনো সহকর্মীদের সঙ্গে বিরোধের জেরে ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং রাত ১টা ৪০ মিনিটে হাসপাতালে মারা যান। হালিমের ছেলে ফয়সাল বলেন, তার বাবা ২০১৪ সাল থেকে কৃষি ব্যাংক সিবিএর সভাপতি ছিলেন এবং বোয়ালখালী উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করতেন। ইউনিয়নের নেতৃত্ব ও পদ নিয়ে সহকর্মীদের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলছিল। এ নিয়ে গত নভেম্বরেই মতিঝিল থানায় একটি জিডি (নং ০৫/১১/২০২৪ - ৩৩৫) করেছিলেন তার বাবা। তিনি আরও বলেন, বুধবার রাতে আমার বাবাকে তার অফিসের সহকর্মীরা মারধর করে হত্যা করেছে। সিবিএর বর্তমান সাধারণ সম্পাদক নাসিম আহমেদ জানান, ২০১৪ সালে আমরা নির্বাচিত হই। এরপর আর কোনো নির্বাচন হয়নি। কিন্তু গত ৫ আগস্ট বিনা নির্বাচনে নতুন কমিটি ঘোষণা করে আমাদের অফিস দখল করে নেয় ফয়েজ ও মিরাজ। এ নিয়ে মামলা চলছে। মামলার তথ্য অনুযায়ী, আসামিরা অস্থায়ী জামিনে ছিলেন। সম্প্রতি তাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। এছাড়া আরও কয়েকজন পলাতক রয়েছেন—যাদের মধ্যে আছেন ড্রাইভার সাইফুল, শাহেদ, ডাটা এন্ট্রি অপারেটর মেহেদী ও অবসরপ্রাপ্ত ক্লিনার সিরাজ। এদিকে, মামলার ২ নম্বর আসামি মিরাজ হোসেন নৈমিত্তিক ছুটির আবেদন করে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। যদিও ওয়ারেন্টভুক্ত আসামির নৈমিত্তিক ছুটি পাওয়ার কোনো এখতিয়ার নেই। মানবসম্পদ বিভাগের উপমহাব্যবস্থাপক এ বিষয়ে বলেন, তিনি বিষয়টি সম্পর্কে অবগত নন এবং নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। কিন্তু স্থানীয় মুখ্য কার্যালয়ের প্রধান মহাব্যবস্থাপক জানান, তিনি কোনো মন্তব্য করতে চান না। কারণ ব্যবস্থাপনা পরিচালক মন্তব্য না করার নির্দেশ দিয়েছেন। ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। অভ্যন্তরীণ এই পরিস্থিতিতে কৃষি ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা প্রধান উপদেষ্টার হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
অভিনব কায়দায় চাঁদাবাজিতে নেমেছে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের একদল ভুয়া সিবিএ নেতা। অভিযোগ উঠেছে, তারা বিশেষ সাধারণ সভা আয়োজনের নামে সারা দেশের শাখাগুলো থেকে কোটি টাকারও বেশি চাঁদা আদায় করছে। তথ্যসূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক এমপ্লয়িজ ইউনিয়ন (সিবিএ), রেজি. নং বি-৯৮৫-এর নাম ব্যবহার করে আগামী ২০ অক্টোবর ‘বিশেষ সাধারণ সভা’ শিরোনামে একটি অনুষ্ঠান আয়োজনের ঘোষণা দেয় একদল ভুয়া নেতা। এ উপলক্ষে তারা ব্যাংকের প্রায় ১ হাজার ২৫০টি ইউনিট থেকে ১০-২০ হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা আদায় করে ১ কোটি ২৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার উঠে। গোপন সূত্র জানায়, তাদের নিয়ন্ত্রিত লোকজন শাখা পর্যায়ে বদলি ও পদোন্নতির ভয় দেখিয়ে টাকা আদায় করছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন উপ-মহাব্যবস্থাপক জানিয়েছেন, তারা এসব কর্মকাণ্ডে চরম ক্ষোভ প্রকাশ করলেও এ সিন্ডিকেটের ভয়ে কিছু বলার সাহস পাচ্ছেন না। এ ঘটনায় ব্যাংকের মানবসম্পদ বিভাগের ডিজিএম জাহিদ হোসেনের প্রত্যক্ষ মদদ ও আস্কারায় চাঁদাবাজি চলছে বলে অভিযোগ উঠেছে। প্রাপ্ত আমন্ত্রণপত্রে দেখা গেছে, ভুয়া সভাপতি দাবিকারী কৃষি ব্যাংকের সাবেক পিয়ন ফয়েজ আহমেদ ও ভুয়া সাধারণ সম্পাদক মিরাজ হোসেন স্বাক্ষরিত পত্রে প্রধান অতিথি হিসেবে বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সহ-শ্রম বিষয়ক সম্পাদক হুমায়ুন কবির, উদ্বোধক হিসেবে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের সভাপতি আনোয়ার হোসেন এবং প্রধান বক্তা হিসেবে সাধারণ সম্পাদক নূরুল ইসলাম খান নাসিমকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। কয়েকজন মহাব্যবস্থাপক জানান, তারা বিভিন্ন শাখা থেকে চাঁদা আদায়ের অভিযোগ পেয়েছেন এবং বিষয়টি ব্যবস্থাপনা পরিচালক অবগত আছেন বলে জানানো হয়েছে। অনুষ্ঠানটি কৃষি ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে আয়োজিত হওয়ায় তারা কার্যত কিছু করতে পারছেন না। অনুসন্ধানে জানা যায়, এর আগেও একই সিন্ডিকেট শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ৪৪তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে প্রায় ৫০ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করেছিল। সেই টাকা তারা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয় বলে অভিযোগ রয়েছে। এ বিষয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, চাঁদাবাজ ও তাদের মদদদাতাদের সঙ্গে দলের কোনো সম্পর্ক নেই। তারা বহিরাগত অনুপ্রবেশকারী। বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এসব ভুয়া সিবিএ নেতাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ও অবাঞ্ছিত ঘোষণা দাবি করেছেন। তাদের আশঙ্কা, এসব কর্মকাণ্ডের নেতিবাচক প্রভাব আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে পড়তে পারে।