২০২৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং পরবর্তী সময়ে সংঘটিত ঘটনাগুলো আবারো আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছে যে, বাংলাদেশে ‘গণতন্ত্র’ এখনও একটি চ্যালেঞ্জিং ধারণা, যার ভিত দুর্বল, আর প্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ।
একচেটিয়া নির্বাচনী সংস্কৃতি ও অংশগ্রহণের সংকট
গত কয়েক দশকে বাংলাদেশের নির্বাচনগুলোতে ক্রমাগতভাবে দেখা যাচ্ছে অংশগ্রহণ সংকট। ২০১৪ সালের নির্বাচনে প্রধান বিরোধীদল বিএনপি অংশ নেয়নি, ২০১৮ সালে অংশ নিলেও অভিযোগ ছিল ব্যাপক কারচুপি, হামলা, গ্রেপ্তার ও প্রহসনের। ২০২৪ সালেও সেই চিত্রের খুব বেশি ব্যতিক্রম দেখা যায়নি।
এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচন কেবলমাত্র একটি আনুষ্ঠানিকতার রূপ নিচ্ছে— যেখানে ভোটার উপস্থিতি কমছে, আগ্রহ হারাচ্ছে সাধারণ মানুষ, এবং প্রশ্ন উঠছে নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে।
জনগণ যদি মনে করে যে তারা ভোট দিলেও ফলাফল পূর্বনির্ধারিত, তাহলে ভোটের প্রতি তাদের আস্থা ভেঙে পড়ে। এটি গণতন্ত্রের অন্যতম প্রধান ভিত্তিকে দুর্বল করে দেয়।
প্রশাসনের দলীয়করণ ও রাজনৈতিক সহিংসতা
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর নিরপেক্ষতা বহু বছর ধরেই প্রশ্নবিদ্ধ। নির্বাচনকালীন সময়ে পুলিশ, র্যাব কিংবা প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে বিরোধীদলের অভিযোগ নতুন নয়। বিশেষ করে যখন বিরোধী দলের মিছিল, সভা বা কর্মসূচি দমন করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অতিমাত্রায় সক্রিয় হয়, তখন স্পষ্ট হয়ে উঠে— প্রশাসন রাজনৈতিক পক্ষপাত থেকে মুক্ত নয়।
এই পরিস্থিতি রাজনৈতিক সহিংসতা উসকে দেয়, যা কেবল গণতন্ত্রকেই নয়, রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতাকেও হুমকির মুখে ফেলে।
বিরোধী দলের দুর্বলতা ও কৌশলগত সীমাবদ্ধতা
বাংলাদেশের রাজনীতি আজ শুধুমাত্র ক্ষমতাসীন দলের আচরণেই নয়, বিরোধী দলের কর্মকৌশল এবং সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণেও ক্ষতিগ্রস্ত। বিএনপি এবং অন্যান্য বিরোধী দল আন্দোলনের নামে মাঝে মাঝে হঠাৎ করে কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করলেও, সেগুলোর ধারাবাহিকতা, জনসম্পৃক্ততা ও সফলতা প্রায়শই প্রশ্নবিদ্ধ।
অনেক সময় জনমনে নেতিবাচক বার্তা পৌঁছায়— যেমন হরতাল, অবরোধ, বা সহিংস কর্মকাণ্ড। আবার দলভিত্তিক ভাঙন, নেতৃত্বে সংকট এবং ভবিষ্যৎ ভিশনের অভাব বিরোধী রাজনীতিকে দুর্বল করে তুলেছে।
রাজনীতি কি শুধুই ক্ষমতা দখলের খেলা হয়ে গেছে?
বর্তমান বাস্তবতায় রাজনীতি যেন একটা "জিততেই হবে" প্রতিযোগিতায় পরিণত হয়েছে। এখানে নীতিগত অবস্থান, জনস্বার্থ, রাষ্ট্রীয় ভবিষ্যৎ— এই বিষয়গুলো যেন গৌণ হয়ে পড়েছে। গণতন্ত্র মানে কেবল নির্বাচন নয়; এটি মানে— স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা, শক্তিশালী সংসদ, জবাবদিহিতামূলক সরকার, এবং বিরোধী মতের প্রতি সম্মান। দুর্ভাগ্যবশত, এগুলো এখন অনেকটাই অনুপস্থিত।
ভবিষ্যতের জন্য কী প্রয়োজন?
বাংলাদেশে একটি কার্যকর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি:
-
নির্বাচন কমিশনের প্রকৃত স্বাধীনতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা নিশ্চিত করা
-
নিরপেক্ষ ও সর্বদলীয় গ্রহণযোগ্য নির্বাচনকালীন সরকার পদ্ধতি ভাবা
-
রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে দলীয় প্রভাব থেকে মুক্ত রাখা
-
সাংবাদিকতা, নাগরিক সমাজ ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে সমুন্নত রাখা
-
রাজনীতিকে সহিংসতা ও প্রতিহিংসার চক্র থেকে বের করে আনা
সময় এসেছে জবাবদিহিমূলক রাজনীতির
বাংলাদেশের রাজনীতি দীর্ঘদিন ধরে সংকটে থাকলেও এখনও সময় আছে ঘুরে দাঁড়ানোর। ক্ষমতাসীন দল যদি সত্যিকার অর্থে গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে চায়, তবে তাদেরকে ক্ষমতার বাইরে থাকার ভয় থেকে মুক্ত হতে হবে। আর বিরোধী দলের উচিত বাস্তববাদী রাজনীতির দিকে ফেরা এবং জনমুখী কৌশল গ্রহণ করা।
রাজনীতি কেবলমাত্র ক্ষমতা অর্জনের পথ নয়— এটি হওয়া উচিত দেশ ও জাতির কল্যাণের মাধ্যম। গণতন্ত্র কোনো একটি দলের নয়, এটি জনগণের অধিকার। আর সেই অধিকার ফিরিয়ে দিতে না পারলে— ভবিষ্যতের বাংলাদেশ হয়তো গণতন্ত্রবিহীন একটি নিষ্ক্রিয় রাষ্ট্রব্যবস্থার নাম হয়ে থাকবে।
🖋️ সম্পাদকের নোট:
এই লেখাটি লেখকের নিজস্ব মতামত। এতে প্রকাশিত মতামত বা বিশ্লেষণ অনলাইন পত্রিকার অবস্থান নির্দেশ করে না। পাঠক চাইলে এ বিষয়ে ভিন্নমত পাঠাতে পারেন।