করোনায় বিশ্ব পরিস্থিতি ও শ্রমিকশ্রেণীর কর্তব্য প্রসঙ্গে

0
385

আবু হাসান টিপু: ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে করোনা মহামারী শুরুর পর থেকেই করোনার ভয়াবহতা এবং এ থেকে মানব জাতীকে বাঁচানোর প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহন করার জন্য বিশ্ব-স্বাস্থ্যসংস্থার পক্ষ থেকে বার বার সতর্ক করা হয়েছিল। তারপরও সারা বিশ্বে মৃতের সংখ্যা এখন প্রায় ৩২ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। বিশেষ করে বিশ্বের তারকা চিহ্নিত পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলোতে মানুষের মৃত্যু মিছিল অনেকবেশী লম্বা। আমেরিকা, ফ্রান্স, ইটালী, ব্রাজিল, স্পেন, এমনকি ভারতে মৃতের সংখ্যা প্রতিটি দেশে একক ভাবে ২/৩ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। অপরদিকে কিউবা, উত্তর কোরিয়া, ভিয়েতনাম, চীন, নেপালসহ কমিউনিস্ট কিংবা বামপন্থীদের দ্বারা শাসিত সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে পরিচিত অপরাপর রাষ্ট্রগুলোর করোনা পরিস্থিতি একেবারেই ভিন্ন। এসব রাষ্ট্রে সব মিলিয়ে মৃতের সংখ্যা এখনও অর্ধ লক্ষেও পৌছায়নি। এমন কি ভারতের কেরালায় কমিউনিস্টরা শুধুমাত্র রাজ্য সরকারের ক্ষমতায় থেকেও করোনা মোকাবেলা বিস্ময়কর সাফল্য অর্জন করেছে। কেরালায় চিকিৎসার কোনো সংকট নেই। নিজ রাজ্যে প্রয়োজনীয় অক্সিজেনের মজুত রেখে প্রতিবেশী আরও ৪টি রাজ্যে অক্সিজেন সহায়তা করছে। তারা লাখ লাখ স্বেচ্ছাসেবক করোনা মোকাবেলায় ট্রেনিং দিয়ে প্রস্তুত রেখেছে।

তাই স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলো অর্থবিত্তের প্রাচুর্য্য থাকার পরও করোনার মহামারী মোকাবেলায় ব্যার্থ হচ্ছে কেন? আর উল্টো দিকে অর্থবিত্তের প্রাচুর্য্য না থাকার পরও কমিউনিস্ট কিংবা বামপন্থীদের দ্বারা শাসিত সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে পরিচিত রাষ্ট্রগুলো করোনা মোকাবেলা বিস্ময়কর সাফল্য অর্জন করছে কি করে? এমন কি মন্ত্র আছে কমিউনিস্টদের কাছে?

করোনার অতিমারী ঠেকানোর প্রতিযোগীতায় পুঁজিবাদী রাষ্ট্র ও কমিউনিস্টদের দ্বারা শাসিত সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে পরিচিত রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক মতাদর্শের রয়েছে আকাশ পাতাল ব্যবধান। পুঁজিবাদ মানুষের জীবন-মৃত্যু নিয়ে বাণিজ্য করে। তার কাছে ব্যবসাটাই প্রধান। মানুষের জীবন মরণে তাদের কিচ্ছুটি যায় আসে না। অপরদিকে সমাজতন্ত্র বিনামূল্যে মানুষের চিকিৎসা করে, মানুষের জীবন রক্ষাকে আদর্শ মনে করে। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে মানুষের জীবনের মৌলিক চাহিদা (অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থান) পুরনের দায়িত্ব নেয় সরকার। রাজনৈতিক মতাদর্শের এই আকাশ পাতাল ব্যবধানের কারণেই করোনার অতিমারী ঠেকাতে ব্যর্থ হচ্ছে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রসমূহ। অপরদিকে বিস্ময়কর সাফল্য অর্জন করছে কমিউনিস্টদের দ্বারা শাসিত সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে পরিচিত রাষ্ট্রগুলো।

একথা অনস্বীকার্য যে, বিশ্বব্যাপী চলমান এই মানবতার বিপর্যয় পুঁজিবাদী ব্যবস্থারই অনিবার্য বাই প্রডাক্ট। যতদিন এই নীতিহীন, বৈষম্যমূলক ও মুনাফাভিত্তিক শোষণ ব্যাবস্থা থাকবে ততদিন বিভিন্ন কারণে বার বার এমন মানবতার বিপর্যয় ঘটতেই থাকবে। মহামারীর এই ভয়াবহ বিপদ থেকে পৃথিবীর কোন মানুষেরই এককভাবে বাঁচা সম্ভব নয়। তাই মহামারী মোকাবেলায় সকল রাষ্ট্রকেই সম্মিলীতভাবে উদ্যোগ গ্রহন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে পুঁজিবাদী বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিত্যাগ করে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে যত দ্রæত বাস্তব সম্মত পদক্ষেপ নিতে হবে।

সারা বিশ্বের ন্যায় বাংলাদেশও করোনার ভয়াবহ মহামারীতে বিপর্যস্থ। লুটেরা ধণিকশ্রেণীর এই আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে মানুষের সংকট সমস্যা অন্যান্য রাষ্ট্রের তুলনায় আরো অনেক গুন বেশী ভয়াবহ। পয়সা দিয়েও যথাযথ চিকিৎসা পাওয়া এখানে দুস্কর। তার উপরে করোনার শুরু থেকেই স্বাস্থ্যখাতে চরম অব্যবস্থাপনা, চুরি-চামারী, লুটপাট আর ঘুষ দুর্নীতির কারণে দেশের গোটা স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ইতোমধ্যেই চুড়ান্ত ভেঙ্গে পরছে। বিশ্বের অপরাপর পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলোর মতোই বাংলাদেশেও লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে করোনা আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। তার উপরে ব্যবসায়িক সিন্ডিকেটের কারণে যেন নিত্য পণ্যের উর্ধগতির লাগাম টেনে ধরাই যাচ্ছেনা। এ অবস্থায় দিন এনে দিন খাওয়া মানুষগুলোর জীবন জীবিকা নিয়ে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। আরতাই মৃত্যু ভয়কে উপেক্ষা করে কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষের হাড় ভাংগা পরিশ্রমের কারণে এখনও টিকে রয়েছে দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি। তবে ইতোমধ্যে করোনায় গত কয়েক মাসে নতুন করে আড়াই কোটি মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে নেমে এসেছে। চলতি শতাব্দীর সবচেয়ে বড় স্বাস্থ্য বিপর্যয় এই করোনা সংক্রমণ শুধু স্বাস্থ্য খাতে রাষ্ট্রের অবহেলা ও মানুষের অসহায়ত্ব তুলে ধরেছে তাই নয়, উন্মোচন করেছে সরকারের তথাকথিত উন্নয়নের গল্প ও অর্থনীতির দুর্বলতাও।

আমাদের অর্থনীতি রফতানি আয়, রেমিট্যান্স, কৃষি ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত এই ৪টি স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। করোনা সংক্রমণের কালে এর প্রত্যেকটিই পরেছে সংকটের মুখে। রফতানি আয়ের ৮০ শতাংশের বেশি আয় করে যে খাত সেই গার্মেন্টস খাতের নড়বড়ে চেহারা আর মালিকদের দায় না নেওয়ার মানসিকতা থেকে এটা পরিষ্কার হয়েছে যে প্রণোদনা, মুনাফা আর শ্রম শোষণের মধ্য দিয়ে যে খাতের বিকাশ, অর্থনৈতিক দুর্যোগে তারা কতটা সুযোগ সন্ধানী। ৪০ বছরের শিল্প আজ এতটাই কাহিল হয়ে পরেছে যে, রাষ্ট্রের প্রণোদনা অর্থাৎ জনগণের টাকা ছাড়া সে উঠে দাঁড়াতেই পারছে না। অপরদিকে মৃত্যুর ঝুকি নিয়েই গার্মেন্টসহ অপরাপর কলকারখানার শ্রমিকদের চালিয়ে রাখতে হয়েছে উৎপাদনের চাকা। এরপরও কারখানায় কারখানায় লে-অফ, শ্রমিক ছাটাই, আইনী প্রাপ্য পাওনাদী না দেয়া, ১২ থেকে ১৪ ঘন্টা বাধ্যতামূলক কাজ করানো এখন নিত্য নৈমিত্তিক ব্যপার হয়ে উঠেছে। শ্রম আইনের নামে শ্রমিক স্বার্থ বিরোধী নতুন নতুন ফাদ তৈরী করা হয়েছে। রক্তের বিনিময়ে প্রাপ্ত ১৮৮৬ সালের অর্জন আজ নিশেঃষ হওয়ার পথে।

এই করোনা কালীন সময়ে জীবনের ঝুকি নিয়েই বাংলাদেশের কৃষক দেশবাসীর জন্য কেবল ভাতের সংস্থান করা নয়, সবজি, মাছ, ডিম, মুরগি, দুধ, মাংস, ফল কোন কিছুরই অভাব বোধ করতে দেয়নি। অথচ সেই মানুষগুলোও আজ অনেক বেশী উপেক্ষিত। অধিকার বঞ্ছিত। কৃষক তাঁর নিত্য প্রয়োজনীয় কৃষি পণ্য কিনতে গিয়েও ঠকছে আবার বেঁচতে গিয়েও ঠকছে। সরকারের ভুল নীতির কারণে একদিকে কৃষক তার কৃষি পণ্যের ন্যায্য মূল্য পাননি অপরদিকে এই করোনা কালে অধিক পয়সা খরচ করেও অনেকেই উৎপাদিত ফসল গোলায় তুলতে পারেননি, বিক্রয় ও বিপনন করতেও পরেছেন নানা সংকটে।

আর দেশের অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকগণ যারা জীবন জীবিকার তাগিদে সারা জীবন পথেই ছিলেন তারা এই ভয়াবহ করোনা মহামারীতেও পথেই থাকতে বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু এসকল দরিদ্র মানুষের জন্য খাবার, নগদ অর্থ ও প্রয়োজনীয় ওষধ না দিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে লকডাউন কার্যকর করার গণতামাশা ম স্থ করে চলছেন।

আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা পূর্বেও ভঙ্গুর ও দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত ছিল। করোনায় তা আরও নগ্নভাবে উন্মোচিত হয়েছে। পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে ৯টি হাসপাতালে স¤প্রতি ৩৭৫ কোটি টাকার দুর্নীতি, অনিয়ম হয়েছে। খোদ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তদন্তেই এই তথ্য বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু দুঃখজনক যে, দুর্নীতিবাজদের কারোই আজ পর্যন্ত শাস্তি হয়নি। দায়ীদের বদলী এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। ফলে দুর্নীতিবাজরা ভীত ও নিরুৎসাহিত না হয়ে আরও উৎসাহিত হয়েছে। এবং সাহেদ-শামীম-পাপিয়ারা সরকার ও সরকারী দলের রাজনীতির নিয়ামক শক্তি রূপে আবির্ভূত হয়েছে।

সামগ্রিক বিবেচনায় করোনা বিশ্ব পরিস্থিতিতে মানুষের জীবন বাঁচাতে একদিকে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রসমূহের অসহায়ত্ব ও ব্যর্থতা অপরদিকে কমিউনিস্টদের দ্বারা পরিচালিত অথবা সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে পরিচিত রাষ্ট্রগুলোর করোনা মোকাবেলায় বিস্ময়কর সাফল্য আজ বিশ্ববাসীকে নতুন করে ভাবিয়ে তুলছে। পুজিঁবাদ যে মানব সভ্যতার শেষ কথা নয় করোনায় বিশ্ব পরিস্থিতি সেই সত্যই আজ পুনরায় নতুন করে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। পুজিঁবাদের ভালো মানুষি সমস্ত মুখোশ, শ্রেষ্ঠত্বের মিথ্যা দম্ভ আজ চুরমার হয়ে পরেছে। আর তাই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক এ পরিস্থিতিতে মহামারী ও পুঁজিবাদের কবর রচনা করতে শ্রমিকশ্রেণীকেই ঐক্যবদ্ধ হয়ে এগিয়ে আসতে হবে।

দেশের শাসকশ্রেণীর রাষ্ট্র পরিচালনায় অযোগ্যতা, স্বাস্থ্যখাতসহ সর্বত্র চরম অব্যবস্থাপনা, চুরি-চামারী, লুটপাট, ঘুষ, দুর্নীতি, ভোটাধিকার হরণ, এক ব্যাক্তির ফ্যাসিবাদী শাসন থেকে মুক্তি এবং শ্রমজীবী মেহনতী মানুষের জীবন জীবিকা ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় মহামারী ও পুঁজিবাদ এক সাথে বিদায় করার দিপ্ত স্বপথ নেয়ার এখনই সময়। মনে রাখতে হবে এই অনিবার্য কর্তব্য পালনে ব্যার্থ হওয়ার কোন অবকাশ নেই। রাষ্ট্র ভেঙ্গে যায়, টুকরো টুকরো হয়, সরকার পরিবর্তন হয় কিন্তু জনগণ কখনো পরাজিত হয়না।

আবু হাসান টিপু,
পলিট ব্যুরো’র সদস্য, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পর্টি, কেন্দ্রীয় কমিটি। ফোন: ০১৬৮২-৮১৪৫৬৪।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here