জসীমউদ্দীন ইতি
জ্ঞান মানুষকে শুধু যোগ্য নয় বরং করে সমৃদ্ধ। জ্ঞান লাভেরই আরেক নামকে বলা যায় শিক্ষা যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অতীব পরিচিত এবং কার্যকরী একটি বিষয়। শুধু সমৃদ্ধ দেশ গড়তে নয়, সমৃদ্ধ মানবজাতি তৈরিতেও শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। শিক্ষা শুধু জীবনযাত্রার মানকে উন্নত করে না, সাথে আত্মাকেও করে পরিশুদ্ধ। কিন্তু বর্তমান জনজীবনে এই শিক্ষালাভই যেন হয়ে উঠেছে বাধ্যবাধকতার গণ্ডী। শিক্ষা লাভ নয়, জীবনের মূল লক্ষ্য হয়ে উঠেছে শিক্ষিতের পদবি অর্জন আর সেই পদবির জোরে নিজেকে যোগ্য প্রমাণের লড়াই। তবে, আসলেই আমরা কতটা শিক্ষিত আর কতটা যোগ্য এই আত্মোপলব্ধির রয়েছে যথেষ্ট অভাব।
বিআইডিএস এর জরিপে জানা যায়, বর্তমানে বাংলাদেশে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে বেকারত্বের হার ৩৪ শতাংশ এবং স্নাতক পর্যায়ে বেকারত্বের হার ৩৭ শতাংশের মতো। দোষারোপের খালি খাতা দিলে সেখানে ক্ষমতার অপব্যবহার, কর্মসংস্থানের অভাবসহ নানান অভিযোগ তুলে পাল্লা ভারি করা হয়ে থাকে। স্নাতক শেষ করেই বেশিরভাগ মানুষ সোশ্যাল মিডিয়াতে নিজেকে শিক্ষিত বেকার হিসেবে পরিচয় দিতে চায়, এ যেন এক কম্পিটিশন। চাকরির জন্য লড়াইয়ে নামার আগে যে নিজেকে যোগ্য হিসেবে গড়ে তোলার লড়াইটা শুরু করতে হবে সেটা কয়জন জানে! আর বর্তমানে যোগ্যতা তো সার্টিফিকেটকেন্দ্রিকই হয়ে উঠেছে।
বাবা মা সন্তানের জ্ঞান আহরণের দিকে লক্ষ্য না দিয়ে ভালো জিপিএ পাওয়ানোর লড়াইয়ে নাম দেখাচ্ছে। ভালো রেজাল্ট, সোস্যাল মিডিয়াতে প্রচার এটি যেন এই সময়ের নিয়ম হয়ে পরছে দিন দিন। সন্তান বাস্তবিক জ্ঞান কতটুকু অর্জন করল তার থেকে বেশি সন্তান পরীক্ষার খাতায় কত নম্বর আনতে পারলো গুরুত্বপূর্ণ। যার ফলশ্রুতিতে স্নাতক সার্টিফিকেট হাতে পেলেই সকলে নিজেকে যোগ্য বলে ধরে নিতে শুরু করেছে। নামি দামি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি পেলেই সে যোগ্য, কিন্তু বাস্তবিক জীবনে ঘটে যাওয়া কোনো দুর্ঘটনা নিজ দায়িত্বে সামলে ওঠার ক্ষমতা তার কতটুকু আছে এটা নিয়েও সন্দেহ থেকে যায়।
অভিযোগের খাতা খুললে তাতে দুর্নীতি আর কর্মসংস্থানের অভাব যতটানা উজ্জ্বল করে দেখানো হয়, সেখানে হয়তো দক্ষতার কথা খুব কম মানুষেরই মাথায় আসে। শিক্ষা অর্জন করা যেমন মানবাধিকার তেমনি চাকরি পাওটাকেও তারা মানবাধিকারের আওতায় ফেলতে চায়। নিজেকে দক্ষ না করে অভিযোগের খাতা ভর্তি করে ডিপ্রেশনের শিকার হচ্ছে বহু শিক্ষার্থী। তারই উদাহরণস্বরূপ দেখা যায়,পরীক্ষায় কাক্সিক্ষত ফলাফল না পেয়ে আত্মহত্যার মতো পথ বেছে নেয় শিক্ষার্থীরা। আবার সারাজীবন ভালো ফলাফলের সার্টিফিকেট অর্জন করেও চাকরির জীবনে পিছিয়ে পড়ে শুধু মাত্র সঠিক দিকনির্দেশনার অভাবে এবং শেষপর্যন্ত নিজের জীবনকে অর্থহীন ভেবে হারিয়ে যায় তারা। জীবন পরিচালনার ক্ষেত্রে যেমন সঠিক দিক নির্দেশনা প্রয়োজন ঠিক তেমনি চাকরির মাঠেও সঠিক দিক নির্দেশনায় পারে সফলতা এনে দিতে।
আবার অনেকক্ষেত্রে দেখা যায়, শিক্ষক নিজেই সার্টিফিকেটকে এত বেশি গুরুত্ব দেয়, শিক্ষা দেওয়ার থেকে, সেক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদেরকেও দোষ দেওয়া যায়। যেখানে শিক্ষকই গৎবাঁধা মুখস্থ থিওরির ওপর ভিত্তি করে মানবন্টন করে, সেখানে শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা বৃদ্ধি পাওয়ার আশা করাই বৃথা। আমাদের অনেকাংশেই দেখা যাচ্ছে বিশেষ করে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরকেই আরও বেশি দক্ষ করা প্রয়োজন। কারণ ভিত শক্ত না হলে ওপরের অংশে বেশি ভার সহ্য করা সম্ভব না।
বর্তমানে দেশে মোট ২৫ লাখ ৯০ হাজার বেকারের মধ্যে পুরুষ ১৭ লাখ ১০ হাজার এবং নারী ০৮ লাখ ৮০ হাজার। ২০২২ সালের জরিপে ওই বছর দেশে মোট বেকার ছিলেন ২৬ লাখ ৩০ হাজার। এর মধ্যে পুরুষ ১৬ লাখ ৯০ হাজার এবং নারী ৯ লাখ ৪০ হাজার। দেশের শ্রমশক্তিতে নিয়োজিত মোট জনগোষ্ঠী সাত কোটি ৩৬ লাখ। যা থেকে বোঝা যায় ধীরে হলেও দেশে বেকারত্বের হার কমছে যা বেকার সমাজের জন্য খুশির সংবাদ। তবুও বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশে ২৫ লাখ ৯০ হাজার কর্ম যোগ্য বেকার আসলেই হতাশার বিষয়। একটি দেশের জন্য জনগণই সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ আর এই জনসম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার না করতে পারলে ব্যর্থতা ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ে না।
মানুষকে দেখানোর জন্য না, উন্নতি করা উচিত নিজের ভেতরে। সার্টিফিকেট কাওকে উন্নত করতে পারে না, শিক্ষার প্রয়োজন হয় আর সেই সঠিক শিক্ষা দান করার জন্য প্রয়োজন সঠিক শিক্ষক। সার্টিফিকেটের জোরে গড়ে ওঠা শিক্ষক শুধু সার্টিফিকেটই গড়তে পারবে, মানুষ না। মানুষ গড়তে মানুষ লাগবে, কাগজ না। প্রোডাক্টিভ মানুষ থাকলে বেকারত্বের হার কমার পাশাপাশি অগ্রসর হবে দেশও। প্রতিটি মানুষ যদি নিজেকে উন্নত করার লড়াইয়ে নামে তাহলে সার্টিফিকেট স্বাভাবিকভাবেই উন্নত হয়ে যাবে। সমাজ বা সমাজের নিয়ম বদলানো এত সহজ না, তবে বিন্দু বিন্দু জল থেকেই সাগর গড়া সম্ভব। নিজের মানসিকতা এবং নিজেকে বদলানোর মাধ্যমেও সফল হওয়া যায়।
জসীমউদ্দীন ইতি
সাংবাদিক