মিজানুর রহমান ভোলা প্রতিনিধিঃ
আজ ভয়াল ১২ নভেম্বর। ১৯৭০ সালের এর এইদিনে ভোলার উপকূলে আঘাত হানে প্রলংকারী ঘূর্নিঝড়টি। এতে প্রান হারায় এক লাখের অধিক মানুষ। সেই ঝড়ের কথা মনে করে আজো আতঁকে উঠেন সমগ্র উপকুলের মানুষ। স্বজনহারা মানুষ এখনও ভুলতে পারেনি সেই দুর্বিশহ স্মৃতি।
৭০ এর ভয়াল ঝড়ে পুরো জেলা লন্ড ভন্ড। নদীতে যেমনি ভাসছিলো লাশ ঠিক তেমনি গাছে গাছেও ঝুলে ছিলো মানুষের লাশ।
ঝড়ে স্বজনহারা মানুষের সংখ্য অনেক দীর্ঘ। বেশিরভাগ পরিবারেরই বেঁচে থাকার মতো কেউ ছিলো না। সেই ঝড়ে দ্বীপজেলা ভোলা জেলার সাত উপজেলার বিস্তৃর্ন জনপদ লন্ড ভন্ড হয়ে বিরাণ ভূমিতে পরিণত হয়েছে। মারা যায় এক লাখের অধিক মানুষ। ঝড়ের ক্ষতচিহ্নের বর্ণনা করতে গিয়ে আজো শিউরে উঠেন প্রত্যক্ষদর্শীরা।
ঝড়ে স্বজনহারা আলীনগর এলাকার মো: মনির বলেন, ঝড়ে আমার তিন বোনকে হারিয়েছে। তাদের কথা মনে করে আজো আমরা কাঁদি।
প্রত্যক্ষদর্শী তুলাতলী এলাকার বাদশা মিয়া বলেন, মেঘনা নদী দিয়ে মানুষের মরদেহ ভাসতে দেখেছি। পরিচিত কাউকে উদ্ধার করেছি। বাকি মরদেহ স্রোতে ভেসে গেছে।
স্থানীয় রহমত আলী, ছিদ্দিক ও সিরাজ উদ্দিন বলেন, সেদিনের ঝড়ে মদনপুরের ১৮টি ঘরের মধ্যে ৪০ জনের মরদেহ পাওয়া যায়। একটি পরিবারে কেউ বেঁচে ছিলেন না।
প্রত্যক্ষদর্শী শাহে আলম বলেন, সেদিন দিনভর গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি ছিল। রাতে পুরো দমে ঝড় শুরু হয়। ভোরে জলোচ্ছ্বাসে মানুষ মারা যায়। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল মনপুরা, চরফ্যাশন, লালমোহন উপজেলায়।
প্রবীন সংবাদিক ও দৈনিক বাংলার কন্ঠ সম্পাদক এম হাবিবুর রহমান বলেন, বন্যার পরে দেখেছি সাপ আর মানুষ দৌলতখানের চৌকিঘাটে জড়িয়ে পড়ে আছে। ¯েœহময়ী মা তার শিশুকে কোলে জড়িয়ে পড়ে আছে মেঘনার পাড়ে। সোনাপুরের একটি বাগানে গাছের ডালে এক মহিলার লাশ ঝুলছে। এমনিভাবে মনপুরা, চরফ্যাশন, লালমোহন, তজুমুদ্দিন ও দৌলতখানসহ সমগ্র জেলায় মানুষ আর গবাদি পশু সেদিন বঙ্গোপসাগরের উত্তাল জলে ভেসে গেছে। জন-মানুষ শূণ্য হয়ে পড়েছিলো দ্বীপজেলা ভোলা।
প্রবীন সংবাদিক এম এ তাহের বলেন, ভয়াল সে রাত কেটে গেলে পরদিন শুক্রবার শহরময় ধ্বংশ্য স্তুপ দেখা যায়। প্রায় এক কোমর পানি ছিলো সর্বত্র। চারধারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল শুধু লাশ আর লাশ। বর্তমান বানিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, সাবেক ধর্ম প্রতিমন্ত্রী মরহুম মোশারেফ হোসেন শাহাজানসহ আরো অনেকে বেড়িয়ে পড়েন ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তায়। সেদিন সবাই মিলে প্রায় সাড়ে ৩’শ লাশ দাফন করান।
ভয়ানক সেই ঝড়ের কথা এখনো ভুলেনি উপকূলের মানুষ। ঝড়ের কয়েকদিন পর সামান্য কিছু সাহায্য মিলেছে। গাছে ঝুলে ছিল অনেকের মরদেহ। বাঁচার লড়াই করেছেন অনেকে। কেউ বেঁচেছেন তবে বেশিরভাগই তাদের স্বজনদের হারিয়েছেন।
এদিকে উপকূলবাসীদের অভিযোগ, উপকূলে একের পর এক দুর্যোগ আঘাত হানলেও আজো উপকূলবাসীর জন্য টেকশই বেড়িবাঁধ কিংবা আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ হয়নি। প্রতিবছরই ঝড় আসে। অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়। কিন্তু এখানের মানুষ মৃত্যু ঝুঁকিতে ভোগে। ঝড় কিংবা ঘূর্ণিঝড় আসলেই মৃত্যু তাদের তাড়িয়ে বেড়ায়।
১৯৭০ সালের এই দিনে পুরো উপকূলবাসীর জীবনে নেমে আসে এক মহাদুর্যোগ। মহাপ্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে নিমিষে উপকূলীয় চরা লে ১০ থেকে ১২ ফুট পানিতে বাড়িঘর, সোনালি ফসলের মাঠ, উঠানে স্তূপাকার ও গোলা ভরা পাকা ধান তলিয়ে যায়। স্রোতের তোড়ে হাজার হাজার মানুষ ও কয়েক লাখ গরু-মহিষ ভেসে যায়। বিরাণ ভূমিতে পরিণত হয় পুরো উপকূলীয় এলাকা। ক্ষতিগ্রস্থ হয় ব্যাপক ফসলি জমি, প্রাণী ও বনজসম্পদ।
খবর৭১/ইঃ