স্লিপ অ্যাপনিয়ায় মৃত্যু বাপ্পি লাহিড়ীর, কী এই রোগ?

0
208

মঙ্গলবার মধ্যরাতে অবসট্রাক্টিভ স্লিপ অ্যাপনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন সুরকার ও গায়ক বাপ্পি লাহিড়ী।

এই রোগে অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেলে মৃত্যু অবধারিত। এছাড়া শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক না থাকলে অনেক জটিল সমস্যা দেখা দেয়।

আমরা ঘুমিয়ে গেলেও আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাস ক্রমাগত নিয়মতান্ত্রিকভাবেই চলতে থাকে। কারণ আমাদের মস্তিষ্কের রেসপিরেটারি সেন্টার সবসময় কাজ করতে থাকে।তবে ঘুমের মাঝে শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো জটিল সমস্যা কারও কারও দেখা যায়। এটিকে স্লিপ অ্যাপনিয়া বলা হয়।

এ বিষয়ে বিস্তারিত জানিয়েছেন স্লিপ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ইনজিনিয়াস পালমোফিট ডা. ফাতেমা ইয়াসমিন।

তিনি বলেন, স্লিপ অ্যাপনিয়া রোগটি কোনো বিরল রোগ নয়। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ৪ শতাংশ লোক এই রোগে ভোগেন। পরিসংখ্যানে আরও দেখা যায়, ২৫ শতাংশ মধ্য বয়সি পুরুষ ও ৯ শতাংশ মধ্য বয়সি নারী স্লিপ অ্যাপনিয়ায় আক্রান্ত। স্লিপ অ্যাপনিয়া হলে ঘুমের মাঝে শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়, যা কিনা ১০ সেকেন্ড থেকে কয়েক মিনিট সময় ধরে থাকে।

এ সমস্যাতে ঘুমের মাঝে শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার পাশাপাশি আমাদের রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণও কমে যায়। এটি একটি প্রাণঘাতী বিষয়। শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা কমে যাওয়ার প্রভাব প্রথমে পড়ে আমাদের মস্তিষ্কের ওপর। অক্সিজেনের অভাবে মস্তিষ্ক জেগে ওঠে এবং ঘুম ভেঙে যায়।

এই রোগে আক্রান্ত রোগীরা ঘুম ভাঙার পর শ্বাস নেয় এবং সঙ্গে সঙ্গে আবার ঘুমিয়ে পড়ে। খুবই জটিল অবস্থায় সারা রাতে বারবার শ্বাস বন্ধ ও ঘুম ভাঙা এই চক্রটি চলতে থাকে। ফলে ঘুমিয়েও ঘুম পূরণ হয় না।

এ ঘটনাগুলো যেহেতু গভীর ঘুমের মাঝে ঘটছে তাই রোগী তার এই সমস্যা বুঝতে পারেন না। সকালে ঘুম থেকে উঠে হয়তো তাদের মনেও থাকে না। যেহেতু বারবার ঘুম ভাঙার ফলে ঘুমিয়ে কখনও ঘুম পূরণ না হওয়ার ফলে সারাদিন ঘুম ঘুম ভাব থাকে।

স্লিপ অ্যাপনিয়া রোগে যদি মস্তিষ্কের রেসপিরেটরি সেন্টার থেকে নির্দেশ আসে না তখন একে বলা হয় সেন্ট্রাল স্লিপ অ্যাপনিয়া। এ সমস্যা হলে মস্তিষ্কের নির্দেশ না আসার কারণে ওই সময়ের শ্বাস কাজটি শুরু হয় না। মস্তিষ্কের বিভিন্ন সমস্যার কারণে এই বিভ্রাট ঘটে।

আবার দেখা যায়, মস্তিষ্কের নির্দেশ ঠিকমতোই আসছে কিন্তু শ্বাসনালির প্রবেশ পথে বাধা তখন একে বলা হয় অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া। অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়ায় শ্বাসনালির প্রবেশ পথটি স্বাভাবিকের চেয়ে সরু অথবা গলার মাংসপেশি স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি শিথিল, আবার এই দুটি একসঙ্গে ঘুমের সময় শ্বাসনালির প্রবেশ পথটি বন্ধ করে দেয়। কখনও কখনও সেন্ট্রাল স্লিপ অ্যাপনিয়া ও অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া দুটো একসঙ্গে দেখা দেয়, তখন একে বলা হয় মিক্সড স্লিপ অ্যাপনিয়া।

এ সমস্যাগুলোতে ঘুমের মাঝে শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার পাশাপাশি আমাদের রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণও কমে যায়।

আমাদের মস্তিষ্ক অক্সিজেন ছাড়া বেশিক্ষণ বাঁচতে পারে না। অক্সিজেন কমে যাওয়ার প্রভাবে মস্তিষ্ক জেগে ওঠে ও ঘুম ভেঙে যায় এবং ঘুম ভাঙার পর শ্বাস নিতে শুরু করে।

হঠাৎ মস্তিষ্ক জেগে ওঠার প্রভাবে শরীর আপদকালীন হরমোন বা স্ট্রেস হরমোন নিঃসরণ করে দেয়। একটি পরিতৃপ্তিদায়ক ঘুম আমাদের কর্মদীপ্ত ও কাজে মনোযোগী করে তোলে। স্লিপ অ্যাপনিয়াতে আক্রান্ত রোগীদের জন্য ঘুম হল জীবনের শেষ সময়ের আপদের মতো।

হঠাৎ জেগে ওঠা ও স্ট্রেস হরমোনের প্রভাবে অসংযত হার্টবিটের হার বেড়ে যায় ও ব্লাড প্রেশার বেড়ে যায়, দুর্বল হার্টের তরঙ্গের সমস্যাও দেখা দেয়। স্ট্রেস হরমোনের প্রভাবে ব্লাড সুগার বেড়ে যায়।

এই স্ট্রেস হরমোনটি আমাদের খাদ্য গ্রহণ করার চাহিদাও বাড়িয়ে দেয়। এরই প্রভাবে শরীর মেদবহুল হয়ে পড়ে। প্রদাহ সৃষ্টিকারী বিভিন্ন পদার্থের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার কারণে বিভিন্ন রোগের আবির্ভাব হয়।

গবেষণায় দেখা গেছে, স্লিপ অ্যাপনিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের ৯০ শতাংশ স্ট্রোক, ৭৭ শতাংশ ব্লাড প্রেশার, বুকে ব্যথা ও অসংযত হার্টবিটসহ হার্টের সমস্যা দেখা দেয়, যা কিনা হার্টঅ্যাটাকের ঝুঁকি বেড়ে যায়।

এমনকি স্লিপ অ্যাপনিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের ৩০ শতাংশ ঘুমের মাঝে মৃত্যুর আশঙ্কা থাকে। এ ছাড়া ডিপ্রেশন, মাথাব্যথা, মানসিক রোগগুলো বেড়ে যায়।

দিনের বেলায় ঘুম ঘুম ভাব থাকার জন্য গাড়ি চালানো বা কাজের মাঝে দুর্ঘটনা ঘটারও আশঙ্কা থাকে।

গবেষণায় দেখা গেছে ৬০-৮০ শতাংশ গাড়ি দুর্ঘটনার কারণ হল গাড়ি চালানো অবস্থায় ঘুম আসা। ঘুম আসার অন্যতম কারণ হল স্লিপ অ্যাপনিয়া।

গবেষণায় আরও দেখা গেছে, স্লিপ অ্যাপনিয়ায় আক্রান্ত রোগীর ৭০ শতাংশ অতিরিক্ত ওজনে ভুগে। এ ছাড়া স্লিপ অ্যাপনিয়ায় আক্রান্ত ৮০ শতাংশ মধ্য বয়সি পুরুষ যৌন দুর্বলতাতেও ভুগে।

যারা এই রোগে ভুগছে তাদের মাঝে সাধারণত নিন্মোক্ত উপসর্গগুলো দেখা যায়। স্লিপ অ্যাপনিয়ায় আক্রান্ত রোগীর মাঝে নাক ডাকার প্রবণতা দেখা যায়। নাক ডাকতে হঠাৎ শ্বাস বন্ধ হয়ে যায় এবং কিছুক্ষণ থেমে আবার নাক ডাকতে শুরু করে যারা কিনা রোগীকে এ অবস্থায় দেখেছেন তারাই বলতে পারে।

দীর্ঘসময় বিছানায় থাকার পরও ঘুম পুরা হয় না, সারাদিন ঝিমানো ভাব থাকে। কখনও কখনও খবরের কাগজ পড়তে পড়তে বা টেলিভিশন দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়ে। অনেক ক্ষেত্রে কারও সঙ্গে কথা বলতে বলতে ঘুমিয়ে পড়ে অথবা গাড়িতে উঠলে ঘুমিয়ে পড়ে প্রায়ই। দিনের বেলা অতিরিক্ত ঘুম পায় যার প্রভাবে অপ্রত্যাশিত ও অনিয়ন্ত্রিত ঘুমিয়ে পড়ার দরুন কর্মক্ষেত্রে মর্মান্তিক দুর্ঘটনার শিকার হতে হয়।

দিনের বেলা অতিরিক্ত ঘুমের প্রভাব কাটানোর জন্য অনেকে আবার অতিরিক্ত চা, কফিতে আসক্ত হয়ে পড়ে। এ ছাড়া ক্ষেত্রবিশেষে সকালে ঘুম থেকে উঠে মাথাব্যথা অনুভব করা, হতাশা লাগা, হঠাৎ রাগ হয়ে যাওয়া সমস্যা দেখা দেয়। এর সঙ্গে আরও দেখা দেয় কথা ভুলে যাওয়া, সিদ্ধান্তহীনতা, সারাদিন কাজে মনোযোগী হতে পারে না। ক্লাসে মনোযোগ কমে যায় এবং ছাত্ররা ক্লাসে খারাপ করতে শুরু করে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here