নড়াইলে চিত্রশিল্পী সুলতানের আঁকা নষ্ট হতে চলা তিনটি ছবি আবার নতুন রূপে

0
553

উজ্জ্বল রায়, জেলা প্রতিনিধি নড়াইল থেকে:
নড়াইলে বিশ্ববরেণ্য চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানের নষ্ট হতে চলা আঁকা তিনটি মূল ছবি নতুনরূপে আবার ফিরে এসেছে। শিল্পকলা একাডেমির উদ্যোগে উন্নত প্রযুক্তিতে সেগুলো মেরামত করে জীবনকাল দীর্ঘস্থায়ী করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এতে শিল্পকর্মগুলো আরও ২৫-৩০ বছর জীবনকাল পেল বলে জানিয়েছেন এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। ২০২৩ সালের মধ্যে সুলতান স্মৃতি সংগ্রহশালার নষ্ট হওয়া সব ছবি পর্যায়ক্রমে মেরামত করা হবে বলে শিল্পকলা একাডেমি জানিয়েছে। এস এম সুলতান তাঁর নান্দনিক তুলির আঁচড়ে ফুটিয়ে তুলেছিলেন এ দেশের গ্রামবাংলার অপরূপ সৌন্দর্য। তাঁর মননশীলতায় স্থান পেয়েছিল খেটে খাওয়া পেশিবহুল নারী-পুরুষের প্রতিচ্ছবি। তাঁর জীবনের মূল সুর-ছন্দ খুঁজে পেয়েছিলেন বাংলার গ্রামীণ জীবন, কৃষক এবং কৃষিকাজের মধ্যে। আবহমান বাংলার সেই ইতিহাস-ঐতিহ্য, দ্রোহ-প্রতিবাদ, বিপ্লব-সংগ্রাম এবং বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্যেও টিকে থাকার ইতিহাস তাঁর শিল্পকর্মকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করে। এর মধ্য দিয়ে নড়াইলের লাল মিয়া হয়ে ওঠেন বিশ্ববরেণ্য চিত্রশিল্পী এস এম সুলতান সংগ্রহশালার দ্বিতল ভবনটিতে প্রদর্শনীর জন্য রাখা হয়েছে তাঁর ৭৪টি শিল্পকর্ম। এর মধ্যে ২৩টি মূল ছবি। অন্য ৫১টি রেপ্লিকা (মূল ছবি থেকে প্রিন্ট করা)। নড়াইল শহরের মাছিমদিয়ায় তাঁর জন্মস্থানে তাঁকে সমাহিত করা হয়। সেখানে সরকারি উদ্যোগে গড়ে উঠেছে এস এম সুলতান স্মৃতি সংগ্রহশালা। সংগ্রহশালার দ্বিতল ভবনটিতে প্রদর্শনীর জন্য রাখা হয়েছে তাঁর ৭৪টি শিল্পকর্ম। এর মধ্যে ২৩টি মূল ছবি। অন্য ৫১টি রেপ্লিকা (মূল ছবি থেকে প্রিন্ট করা)। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় চিত্রকর্ম ‘সভ্যতার ক্রমবিকাশ’। ৩৬ দশমিক ৫ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৬ দশমিক ৪ ফুট প্রস্থের চটের ক্যানভাসে তৈল রঙের ওই চিত্রকর্মটি নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি সেটি উন্নত প্রযুক্তিতে মেরামত করে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেছে। এস এম সুলতানের চিত্রকর্ম ‘ধান মাড়াই’। উন্নত প্রযুক্তিতে এটিও নতুনরূপে মেরামত করে জীবনকাল দীর্ঘস্থায়ী করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার তোলা
এস এম সুলতানের চিত্রকর্ম ‘ধান মাড়াই’। উন্নত প্রযুক্তিতে এটিও নতুনরূপে মেরামত করে জীবনকাল দীর্ঘস্থায়ী করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার তোলা প্রথম আলো

স্মৃতি সংগ্রহশালার আরও তিনটি চিত্রকর্মের ক্যানভাস ও রং নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। চটের ক্যানভাসে আঁকা চিত্রকর্মগুলো জায়গায় জায়গায় ছিঁড়ে গিয়েছিল। চট ক্ষয় হয়ে ফেটে একেক জায়গায় গুঁড়া গুঁড়া হয়ে গিয়েছিল। এ ছাড়া রং মুছে চিত্রকর্ম অনেকটা অস্পষ্ট হয়ে যায়। গত বছর নভেম্বর মাসে এমন তিনটি চিত্রকর্ম বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি নিয়ে যায় মেরামত করতে। চেষ্টা করা হয় তার অবয়ব ফিরিয়ে আনতে। মেরামত শেষে গত ফেব্রুয়ারি মাসের শেষে সেগুলো আবার প্রদর্শনীর জন্য সংগ্রহশালায় রাখা হয়েছে। এগুলো হলো ১৭ দশমিক ৯ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৬ ফুট প্রস্থের তৈল রঙের ‘জমি চাষ’, ১১ দশমিক ৫ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৭ ফুট প্রস্থের তৈল রঙের ‘ধান মাড়াই’ এবং ৭ দশমিক ১ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৪ দশমিক ৭ ফুট প্রস্থের তৈল রঙের ‘গ্রাম্য কাইজা’র চিত্রকর্ম। শিল্পী সুলতান চটের ক্যানভাসের ওপর নিজের তৈরি রং ব্যবহার করে ছবি এঁকেছেন। এতে চিত্রকর্ম অন্য রকম নান্দনিক হয়েছে। কিন্তু পাটের তৈরি ওই চট দীর্ঘস্থায়ী হয় না। স্থানীয় উপকরণে নিজের তৈরি করা রং, যা দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার কথা নয়। তাই চিত্রকর্মগুলো নষ্ট হওয়ার পথে ছিল। শিল্পকলা একাডেমি বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে চিত্রকর্মগুলো মেরামত করে জীবনকাল দীর্ঘস্থায়ী করার ব্যবস্থা করছে। সৈয়দা মাহবুবা করিম, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির চারুকলা বিভাগের পরিচালক এ বিষয়ে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির চারুকলা বিভাগের পরিচালক সৈয়দা মাহবুবা করিম বলেন, শিল্পী সুলতান চটের ক্যানভাসের ওপর নিজের তৈরি রং ব্যবহার করে ছবি এঁকেছেন। এভাবে শৈল্পিক কর্ম সৃষ্টি তিনি ছাড়া আর কাউকে করতে দেখা যায়নি। এতে চিত্রকর্ম অন্য রকম নান্দনিক হয়েছে। কিন্তু পাটের তৈরি ওই চট দীর্ঘস্থায়ী হয় না। কিছুদিন পর চট নষ্ট হয়ে যাবে এটিই স্বাভাবিক। স্থানীয় উপকরণে নিজের তৈরি করা রং, যা দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার কথা নয়। তাই চিত্রকর্মগুলো নষ্ট হওয়ার পথে ছিল। শিল্পকলা একাডেমি বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে চিত্রকর্মগুলো মেরামত করে জীবনকাল দীর্ঘস্থায়ী করার ব্যবস্থা করছে। এতে ২৫-৩০ বছর জীবনকাল সুদৃঢ় থাকবে। এরপর আবার কিছুটা কাজ করতে হবে। ২০২৩ সালের মধ্যে সুলতান স্মৃতি সংগ্রহশালার নষ্ট হওয়া সব ছবি পর্যায়ক্রমে মেরামত করা হবে। এস এম সুলতানের চিত্রকর্ম ‘গ্রাম্য কাইজা’। এই ছবিটিও নতুনরূপে মেরামত করা হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার তোলা এস এম সুলতানের চিত্রকর্ম ‘গ্রাম্য কাইজা’।

এই ছবিটিও নতুনরূপে মেরামত করা হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার তোলা শিল্পকলা একাডেমির চিত্রকর্ম সংরক্ষণবিদ মো. হাসানুর রহমান (রিয়াজ) প্রথম আলোকে বলেন, চিত্রকর্মগুলো মেরামত করতে চটের ক্যানভাসের নিচে উন্নত মানের কাপড় পেস্ট করা হয়েছে। এতে ক্যানভাস দীর্ঘস্থায়ী হবে। ছবি আঁকার জন্য সুলতান অনেক চট রোল করে রেখেছিলেন। এগুলো স্মৃতি সংগ্রহশালায় ছিল। সেগুলো নিয়ে চিত্রকর্মের ক্যানভাসের যে যে জায়গায় ছিঁড়ে গিয়েছিল সেখানে লাগানো হয়েছে। এরপর ক্যানভাস বার্নিশ করা হয়েছে। এতে ছবি উজ্জ্বল হয়েছে। পানি, ধুলা বা ময়লা লাগলেও সমস্যা হবে না। এরপর আন্তর্জাতিক মানের আধুনিক রং ব্যবহার করে ইঞ্চি ইঞ্চি ধরে মিলিয়ে ছবিকে স্পষ্ট করা হয়েছে। এ ছাড়া উন্নত মানের কাঠের ফ্রেমে বেঁধে সেগুলো প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হয়েছে। এতে ২-৩ মাস সময় লাগে, খরচও অনেক। বিশ্বনন্দিত এই শিল্পীর স্মৃতি সংগ্রহশালাটি বিশ্ব মানের করতে চেষ্টা করা হবে। সুলতান কমপ্লেক্সকে আধুনিকায়ন করতে ২৫ কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) তৈরি হচ্ছে। মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান, জেলা প্রশাসক, নড়াইল। জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান বলেন, ‘সুলতানের স্মৃতি সংগ্রহশালাটি আধুনিক নয়। ভবনটিও জরাগ্রস্ত। এখানে সুলতানের ওপর প্রামাণ্যচিত্র দেখানোর ব্যবস্থা থাকা দরকার। সব মিলে বিশ্বনন্দিত।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here