মিজানুর রহমান মিলন, সৈয়দপুর থেকে:
গোটা সৈয়দপুরবাসী যখন বিদ্যুৎ ব্যবহারের সুবিধা পাচ্ছে, তখন বিধবা জুলেখা ছিল অন্ধকারে। বাইরে বিদ্যুৎ দেখলেও, নিজের ঘরে বিদ্যুতের আলো কি, জানতো না সে। অন্ধকার ঘরে কুপির আলো জ¦ালিয়ে মেয়েকে নিয়ে রাত কাটাতো অশীতিপর বিধবা জুলেখা। ৪৮ বছর ধরে এ অবস্থা চললেও পাশে দাঁড়ায়নি সমাজের কোন বিত্ববান। এনিয়ে আমাদের প্রিয় সৈয়দপুর নামে ফেসবুক পেইজে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে সৈয়দপুরে ব্যাপক আলোড়নের সৃষ্টি হয়। নড়ে চড়ে বসে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। অবশেষে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. বজলুর রশীদ বিষয়টি বিদ্যুৎ বিভাগকে অবহিত করলে সৈয়দপুর বিদ্যুৎ বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মাদ আলী জিন্নাহ নিজ খরচে ওই বিধবার বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগ স্থাপন করেন। শহরের বাঁশবাড়ী পুরাতন বটগাছ এলাকার বাসিন্দা জুলেখা বেওয়ার বাসায় গত বৃহস্পতিবার সন্ধায় বিদ্যুতের আলো জ¦ালিয়ে দেয়া হয়। সৈয়দপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. বজলুর রশীদ সুইচ টিপে ওই বিধবার বাসা আলোকিত করেন।
দেশ স্বাধীনের পর থেকে স্বামীহারা অসহায় বিধবা জুলেখা ভাঙ্গা জরাজীর্ণ ওই বাসায় বসবাস করছেন। শেষ বয়সে তার একমাত্র সঙ্গী বিয়ের বয়স পার হতে চলা কন্যা আসমা খাতুন (৩৬)। ঘরে গ্লাস, থালা, হাড়িপাতিল, বাসন ছাড়া অন্য কোন আসবাবপত্র নেই। তবে রয়েছে অন্ধকার থেকে আলো ছড়ানোর একমাত্র অবলম্বন ছোট্ট একটি কেরোসিনের কুপি। ওই এলাকায় আশেপাশে বিশাল বিশাল অট্টালিকায় বিত্ত্ববানরা বসবাস করলেও ৪৮ বছরেও বিদ্যুতের আলো জ¦ালাতে কোন সহায়তা মেলেনি জুলেখা বেওয়ার। অথচ অনেক ক্ষেত্রে অনেককেই বড় ধরনের আর্থিক সহায়তা দেয়ার প্রবণতা থাকলেও বিধবা জুলেখা ছিলেন বি ত। অশীতিপর জুলেখা বেওয়া জানান, স্বামী উলকাত হোসেন ও পুত্র কাল্লুর উপার্জন কোন রকম সংসার চলে যেত। তখন তিনি স্বপ্ন দেখতেন তার কন্যা আসমাকে ভালো ঘরের পাত্রের সাথে বিয়ে দিবেন। তখনও তার ঘরে বিদ্যুৎ ছিলনা। কিন্তু সে আশা পূরণ হয়নি। গত ১৫ বছর আগে কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান স্বামী উলফাত হোসেন । এর কয়েক বছর পর ছেলে কাল্লু মারা য়ায়। ফলে তার জীবনে নেমে আসে ঘুটঘুটে অন্ধকার। তখন থেকে জরাজীর্ণ ভাঙ্গা ঘরে বিদ্যুৎবিহীন অবস্থায় মা-মেয়ের বসবাস। অর্থের অভাবে বিদ্যুৎ সংযোগ নেয়া দুরের কথা, ঘর মেরামত করতে পারেনি সে। অভাবের সংসারে মানুষজনের দেয়া খাবার খেয়ে দিন পার করতে হচ্ছে বিধবা জুলেখা ও তার মেয়ে আসামাকে। বুধবার বিকেলে দেখা যায়, ভাঙ্গা ঘরের এক কোণে বসে রয়েছে বিয়ের বয়স পার হতে যাওয়া মেয়ে আসমা খাতুন। তপ্ত গরমে হাতপাখা তাদের ভরসা। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হওয়া মাত্র জ¦ালানো হলো কুপি। কুপির মিটমিট আলোতেই সারাজীবনের দু:খের কথা জানিয়ে বিধবা জুলেখা বলেন, মেয়ের বিয়ে নিয়ে চিন্তায় আছি। বিয়ে দিতে পারব কিনা জানিনা। ওই দিনই বিধবা জুলেখার ঘরে বিদ্যুৎ নেই এমন একটি প্রতিবেদন ফেসবুক পেইজ আমাদের প্রিয় সৈয়দপুর নামে একটি সংগঠন ফেসবুকে পোষ্ট করে। মানবিক এ পোষ্টটি অনেকেই শেয়ার করলে সর্বত্র ভাইরাল হয়। পরের দিন বৃহস্পতিবার ঘটনাটি নজরে আসে সৈয়দপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. বজলুর রশীদের। তিনি তাৎক্ষণিক কথা বলেন সৈয়দপুর বিদ্যুৎ বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সাথে।
এরপরে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার মধ্যেই নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর উপস্থিতিতে বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মীরা পোল থেকে বিদ্যুৎ সংযোগ করে ওই বিধবার ঘরে মিটার লাগানোসহ বাল্ব ও অন্যান্য কাজও সম্পন্ন করা হয়। এসবের পুরো খরচ বহন করেন নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ।
ওইদিন সন্ধায় ইউএনও বজলুর রশীদ সুইচ টিপে বিধবার ঘরে বিদ্যুতের আলো আলোকিত করে দীর্ঘ ৪৮ বছরের অন্ধকার অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটান। দেশ স্বাধীনের পর বিদ্যুৎ পেয়ে বিধবা জুলেখা ইউএনও বজলুর রশীদ ও নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর মাথায় হাত দিয়ে দোয়া ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
এসময় উপস্থিত ছিলেন ইউএনও ও নির্বাহী প্রকৌশলী ছাড়াও রাজনীতিক ও সমাজসেবক মো. জোবায়দুর রহমান শাহীন, আমাদের প্রিয় সৈয়দপুরের এ্যাডমিন নওশাদ আনসারী, স্বেচছাসেবী সংগঠন সেতুবন্ধনের আলমগীর হোসেনসহ অন্যান্যরা। এ ব্যাপারে ইউএনও মো. বজলুর রশীদ বলেন, বিষয়টি আমার জানা ছিলনা। বিধবার ঘরে বিদ্যুৎ নেই জানলে অনেক আগেই ব্যবস্থা নিতাম। তারপরে ফেসবুকের মাধ্যমে জানতে পেরে বিদ্যুৎ বিভাগকে বলে ব্যবস্থা নিয়েছি।
নির্বাহী প্রকৌশলী মোহম্মদ আলী জিন্নাহ বলেন, যেখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন সেখানে কেউ অন্ধকারে থাকবে, তা হতে পারেনা। তাই মানবিক ও নিজের দায়িত্ব বোধ থেকেই ওই বিধবার ঘরে বিদ্যুৎ সংযোগের ব্যবস্থা করেছি।