ওসি প্রদীপ ও এসআই লিয়াকতের ফাঁসির আদেশ

0
187

খবর৭১ঃ সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যার মামলার রায় ঘোষণা করা হয়েছে। এতে বরখাস্ত ওসি প্রদীপ ও এসআই লিয়াকতকে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়েছে।

কক্সবাজারের জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মোহাম্মদ ইসমাঈল সোমবার এ রায় ঘোষণা করেন। এতে এপিবিএন’র তিন সদস্যসহ ৭জনকে খালাস দেওয়া হয়েছে। যাবজ্জীবন সাজা দেওয়া হয়েছে ৬জনকে।

এর আগে ২টার দিকে এই মামলার ১৫ আসামিকে কঠোর নিরাপত্তায় আদালত চত্বরে আনা হয়।২টা ২৫ মিনিটে এজলাসে এসে আদালতের কার্যক্রম শুরুর পর মামলা সম্পর্কে প্রাসঙ্গিক আলোচনা করেন বিচারক। এরপর শুরু করেন অপরাধের পর্যবেক্ষণ বয়ান। সাক্ষ্য প্রমাণে কার কী অপরাধ দাঁড়িয়েছে সেসব তুলে ধরার পর হত্যায় সংশ্লিষ্টতার অপরাধ অনুসারে সাজা ঘোষণাকালে প্রধান দুই অভিযুক্তকে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছেন আদালত।

এদিকে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যার চাঞ্চল্যকর মামলার অন্যতম আসামি বরখাস্ত ওসি প্রদীপের ফাঁসিসহ সব আসামির দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করে আদালত প্রাঙ্গণে অব্স্থান নেন নির্যাতিত শত শত পরিবারের সদস্যরা।

তারা ‘খুনি প্রদীপের ফাঁসি চাই, ফাঁসি চাই’, ‘মেজর সিনহার খুনি প্রদীপের ফাঁসি চাই’, ‘২০০ মানুষ হত্যাকারীর প্রদীপের ফাঁসি চাই ‘ইত্যাদি বলে স্লোগান দিতে থাকেন।

কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, সিনহা হত্যা মামলার রায়কে ঘিরে যেন কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে, সেদিকে পুলিশের সর্বোচ্চ সতর্ক দৃষ্টি রয়েছে। আদালতে নিরাপত্তার স্বার্থে পোশাকধারী পুলিশের পাশাপাশি সাদা পোশাকেও বিপুলসংখ্যক পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে।

কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট ফরিদুল আলম বলেন, কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালত সৃষ্টির ৩৮ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম এত দ্রুত কোনো হত্যা মামলার রায় ঘোষণা হয়েছে। এ মামলায় ৮৩ সাক্ষীর মাঝে ৬৫ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। এর আগে হত্যা কিংবা ফৌজদারি কোনো মামলায় এত বিপুলসংখ্যক সাক্ষী নেওয়ার নজির নেই। তেমন নজির নেই এত স্বল্পসময়ে চার্জগঠন, শুনানি, সাক্ষ্যগ্রহণ, জেরা ও যুক্তিতর্ক উপস্থাপনেরও। মাত্র ৩৩ কার্যদিবসে আমরা এ মামলার সব বিচারিক কার্যক্রম শেষ করতে সক্ষম হয়েছি।

তিনি বলেন, আমরা সিনহা হত্যার বিষয়টি প্রমাণে সক্ষম হয়েছি। আমাদের আশা সর্বোচ্চ শাস্তি পাবেন বরখাস্ত ওসি প্রদীপ ও অভিযুক্তরা। স্বল্পসময়ে সিনহা হত্যার রায় দেশে একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

সূত্রমতে, প্রদীপ কুমার দাশ টেকনাফ থানার ওসি থাকাকালে মাদক নির্মূলের নামে ২২ মাসে ১৪৪টি বন্দুকযুদ্ধের ঘটনার জন্ম দেন। তাতে মারা গেছেন ২০৪ জন। এসব ঘটনাকে দেওয়া হয়েছে মাদক ও অস্ত্র উদ্ধারের তকমা। অথচ সাধারণ মানুষ বলছেন, ক্রসফায়ারে নিহতদের বেশিরভাগই ছিলেন নিরীহ।

এমনই একটি সাজানো বন্দুকযুদ্ধের ঘটনায় ২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের টেকনাফ উপজেলার বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান।

এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে টেকনাফ থানায় দুটি এবং রামু থানায় একটি মামলা করে। সরকারি কাজে বাধা প্রদান এবং মাদক আইনে এসব মামলা করা হয়। টেকনাফ থানায় করা দুই মামলায় নিহত সিনহার সঙ্গী সাইদুল ইসলাম সিফাতকে আসামি করা হয়। আর রামু থানায় মাদক আইনে করা মামলাটিতে আসামি করা হয় নিহত সিনহার অপর সফরসঙ্গী শিপ্রা দেবনাথকে।

২০২০ সালের ৫ আগস্ট নিহত সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস বাদী হয়ে ৯ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে কক্সবাজার আদালতে মামলা করেন। এতে প্রধান আসামি করা হয় টেকনাফের বাহারছড়া পুলিশ তদন্তকেন্দ্রের সাবেক ইনচার্জ পরিদর্শক লিয়াকত আলীকে।

মামলার অন্য আসামিরা হলো— টেকনাফ থানার তৎকালীন ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, বাহারছড়া পুলিশ তদন্তকেন্দ্রের তৎকালীন উপপরিদর্শক (এসআই) নন্দ দুলাল রক্ষিত, কনস্টেবল সাফানুর করিম, কনস্টেবল কামাল হোসেন, কনস্টেবল আব্দুল্লাহ আল মামুন, সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) লিটন মিয়া, উপপরির্দশক (এসআই) টুটুল ও কনস্টেবল মোহাম্মদ মোস্তফা।

মামলাটি টেকনাফ থানায় নথিভুক্ত করার পর আদালত তদন্তভার দেন র‌্যাবকে। একই সঙ্গে পুলিশের করা মামলা তিনটিও র‌্যাবকে তদন্ত করার আদেশ দেন আদালত।

২০২০ সালের ৬ আগস্ট সকালে মামলাটি টেকনাফ থানায় নথিভুক্ত করে তদন্তের জন্য র‌্যাবকে হস্তান্তর করা হয়। ওই দিন বিকালে মামলায় অভিযুক্ত ৯ জনের মধ্যে সাত পুলিশ সদস্য আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। ওই দিন পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছিল এসআই টুটুল ও কনস্টেবল মোহাম্মদ মোস্তফা নামের কোনো পুলিশ সদস্য জেলা পুলিশে কর্মরত ছিল না। ওই দিনই আত্মসমর্পণকারী আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালতে বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ডের আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা।

র‌্যাবকে মামলার তদন্তকালীন ২০২০ সালের ১১ আগস্ট পুলিশের মামলার তিন সাক্ষী টেকনাফের মারিশবুনিয়া এলাকার মো. নুরুল আমিন, মোহাম্মদ আয়াজ ও নিজাম উদ্দিনকে গ্রেফতার করে আদালতে সোপর্দ করে। ওই দিনই তাদের ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা।

মামলা তদন্তের একপর্যায়ে ২০২০ সালের ১৮ আগস্ট এপিবিএনের তিন সদস্য সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) শাহজাহান মিয়া, কনস্টেবল মো. রাজীব ও কনস্টেবল মো. আব্দুল্লাহকে গ্রেফতার করে আদালতে সোপর্দ করে র্যা ব। ওই দিনই তাদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালতে রিমান্ড আবেদন করা হয়।

২০২০ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর কনস্টেবল রুবেল শর্মাকে গ্রেফতার করে আদালতে সোপর্দ করে র‌্যাব। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালতে ওই দিনই রিমান্ড আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা।

কারাগারে থাকা এই ১৪ আসামিকে বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেন তদন্ত কর্মকর্তা। এদের মধ্যে প্রদীপ কুমার দাশ ও কনস্টেবল রুবেল শর্মা ছাড়া অন্য ১২ আসামি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।

২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর র‌্যাব-১৩ কক্সবাজার ব্যাটালিয়নের জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) খাইরুল ইসলাম ১৫ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিল করেন। অভিযুক্তদের মধ্যে ১৪ জন কারাগারে থাকলেও টেকনাফ থানার কনস্টেবল সাগর দেব পলাতক ছিল। অভিযোগপত্রে সাক্ষী করা হয় ৮৩ জনকে। একই দিন পুলিশের করা মামলা তিনটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here