স্কুল খুললেও সব শিক্ষার্থীর ফেরা নিয়ে শঙ্কা

0
191

খবর৭১ঃ তকবীর আহমেদ। রাজধানীর মোহাম্মদপুরের নবীনগর এলাকার ফুলকুঁড়ি কিন্ডার গার্ডেন স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান শিক্ষক। দেশে করোনার প্রথম ধাপের লকডাউনে আলোচনায় আসেন স্কুল বিক্রির বিজ্ঞাপন দিয়ে। দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকায় খরচ মেটাতে না পেরে নিজেই রাস্তায় হেটে হেটে স্কুল বিক্রির পোস্টার লাগিয়েছেন। কিন্তু এই দুযোগের সময় কেউ এগিয়ে আসেনি তার স্কুল পরিচালনার দায়িত্ব নিতে।

করোনার প্রভাবে বেসরকারি বা ব্যক্তিমালিকানাধীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর বেহাল দশা দেশের শহর-গ্রাম সব খানেই। করোনার কারণে প্রায় দেড় বছর ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গেটে তালা ঝুলছে। গত দেড় বছরে এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও অনেক প্রতিষ্ঠান আর কখনো হয়তো খুলবে না। স্কুল খুললেও আগের মতো শিক্ষার্থী ফেরা নিয়ে শঙ্কায় আছেন কিন্ডার গার্টেনের শিক্ষকরা।

সম্প্রতি ফুলকুঁড়ি স্কুলে গিয়ে দেখা গেল অফিসকক্ষে বসে আছেন তকবীর আহমেদ। আগে যেখানে স্কুল জুড়ে শিক্ষার্থীদের হইহুল্লোড়ে মেতে থাকত স্কুল প্রাঙ্গণ। এখন সেখানে পুরো উল্টো চিত্র। স্কুল জুড়ে সুনসান নীরবতা। শ্রেণিকক্ষে ঝুলছে তালা।

তবে স্কুল খোলার সরকারি সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষায় আছেন তকবীর আহমেদ। সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, ‘স্কুল খোলার জন্য আমরা অধীর আগ্রহে বসে আছি। ইতিমধ্যে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। তবে যেসব প্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিনধিরে পাঠদান করেছে, তারা চাইলেই বন্ধ করতে পারবে না। তাদের এসএসসি, জেএসসির ব্যাচ আছে। তাই ঋণ করে হলেও আমরা প্রতিষ্ঠান ধরে রাখার চেষ্টা করেছি। তবে নতুন প্রতিষ্ঠানগুলো টিকে থাকার সম্ভাবনা কঠিন।’

গত দেড় বছর ধরে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সব ধরনের আয় বন্ধ। কিন্তু ব্যয় বন্ধ হয়নি। তকবীর আহমেদের যেমন প্রতি মাসে তার প্রতিষ্ঠানের জন্য ব্যয় হয় দেড় লাখ টাকার মতো। অথচ একমাত্র আয়ের রাস্তা শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি নেই গত দেড় বছর ধরে।

ফুলকুঁড়ি স্কুলটা নিম্ন আয়ের মানুষের এলাকায়। দিনমজুর, গাড়িচালক, বাসাবাড়িতে কাজ করে এমন মানুষের বাস। করোনার কারণে তারাও অনেকে কাজ হারিয়েছে। তকবীর আহমেদ বলেন, ‘এই অবস্থায় তাদের কাছে কীভাবে টিউশন ফি চাইব। ফলে টিউশন ফি পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।’

দীর্ঘদিন ধরে স্কুল বন্ধ। এই সময়ে কত পরিবারে কত পরিবর্তন ঘটে গেছে। তাই স্কুল খোলার পরে শিক্ষার্থী পাওয়া নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন তকবীর আহমেদ। তিনি বলেন, ‘স্কুল বন্ধ থাকার সময় সময়ে আমাদের শিক্ষকদের দিয়ে খোঁজ নিয়েছি ইতোমধ্যে অনেক শিক্ষার্থী পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছে। আমার স্কুলের এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিল ৩৫ জন। স্কুল বন্ধ থাকায় পাঁচজন গার্মেন্ট কর্মী হিসেবে কাজ করছে, চারজনের বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলেদের মধ্যে কেউ কেউ পড়াশোনা বাদ দিয়ে ঘুরে বাড়াচ্ছে, কেউ অটোরিকশা চালাচ্ছে।’

নিম্নবিত্ত পরিবারে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার বিষয়ে বাবা-মায়েদের তাগিদ কম। দরিদ্রতার কারণে অনেক পরিবারই তাদের সন্তানদের কাজে পাঠাচ্ছেন। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অনেক শিক্ষার্থী ঢাকায় নেই। অনেকেই গ্রামে চলে গেছে। স্কুল খোলার পরে তারা আবার আসবে কি না সংশয়ে আছেন তারা। কারণ পরিবারের ব্যয় মেটাতে না পেরে অনেকে ঢাকা ছেড়েছেন। এই মুহূর্তে যদি স্কুল খুলে দেয় সরকার, ২৫ ভাগ শিক্ষার্থী ফিরে পাবেন কি না শঙ্কায় আছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো।

বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ কিন্ডার গার্টেন সোসাইটির চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ বলেন, ‘করোনার কারণে ব্যয় মেটাতে না পেরে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এমনকি আমি নিজেও ভুক্তভোগী। আমার স্কুলের বাড়িওয়ালা সাত লাখ টাকা ভাড়া পাবেন। কিন্তু আমি দিতে পারছি না।’

সরকারি প্রতিষ্ঠানের বাইরে শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশ কিন্ডার গার্টেনে পড়াশোনা করছে। এসব কিন্ডার গার্টেনের ৯৫ ভাগ প্রতিষ্ঠানই ভাড়াবাড়িতে পরিচালিত হয়। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার কারণে অনেক প্রতিষ্ঠান হয়তো আর চালুই হবে না। ফারুক আহমেদ, ‘আমাদের সংগঠনে শুধু ঢাকায় ১৫০টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে ৩০ ভাগ ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক শিক্ষক তার পেশা বদলে ফেলেছেন।’

বেসরকারি এসব কিন্ডার গার্টেন রক্ষায় সরকারি কোনো সহযোগিতা পাওয়া যায়নি এবং কোনো আশ্বাসও মেলেনি বলে জানান এ শিক্ষক নেতা। বলেন, ‘এই খাতটি বাঁচাতে আমরা অনেক আন্দোলন করেছি। কিন্তু সরকার কোনো ধরনের সহযোগিতার হাত বাড়ায়নি। আমাদের এ খাত নিয়ে সরকারের কোনো মাথাব্যথা নেই। ফলে অনেক প্রতিষ্ঠান ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কয়েকটি ঘটনা পেয়েছি, অনেকে সহযোগিতার নামে ছবি, ভিডিও করে নিয়ে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করছেন। তারা আমাদের সহযোগিতার নাম করে ফান্ড এনে আর আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন না।’

সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ধীরে ধীরে ‍খুলে দেয়ার তাগিদ দেওয়ার পরে শিক্ষা মন্ত্রণালয় বেশ কিছু প্রস্তুতিমূলক নির্দেশনা দিয়েছে। সে নির্দেশনাগুলো সরকারি স্কুলগুলোর জন্য। কিন্ডার গার্টেন স্কুল নিয়ে সরকার নির্দেশনা না দিলেও নিজ উদ্যোগে তারা প্রস্তুতি নিচ্ছেন স্কুল খোলার। সরকার অনুমতি দিলেই খুলে দেয়া হবে দেশে সব কিন্ডার গার্টেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here