করোনায় কোন পথে দেশের অর্থনীতি

0
413
কারখানা বন্ধের বিষয় বিবেচনা করতে বিজিএমইএ’র চিঠি

খবর৭১ঃ বিশ্ব মহামারি করোনাভাইরাসে স্থবির বিশ্ব অর্থনীতির চাকা। এই বিপর্যয়কারী ঢেউয়ের আঘাত লেগেছে বাংলাদেশেও। ইতিমধ্যে বাংলাদেশে প্রায় প্রতিটি খাত ক্ষতির মুখে পড়লেও বিশেষ করে তৈরি পোশাকশিল্প, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প, চামড়া, ওষুধ, পর্যটন, যোগাযোগ ও পরিবহন এবং বেসামরিক বিমান পরিবহন খাত বেশি হুমকিতে।

অর্থনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও অর্থনীতিবিদরা। বাংলাদেশ গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ) সূত্রে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ৯৬৬টি কারখানার ৮২৮ মিলিয়ন পিস পোশাকপণ্যের অর্ডার বাতিল ও স্থগিত হয়েছে। এর মূল্য ২ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

একের পর এক ক্রয়াদেশ বাতিল হওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বিজিএমইএ সভাপতি রুবানা হক গণমাধ্যমকে জানান, করোনার কারণে পোশাক খাতে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে এসেছে। বিভিন্ন দেশ ও মহাদেশ থেকে ক্রেতারা তাদের সব ক্রয়াদেশ (অর্ডার) আপাতত বাতিল করছেন।

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় রপ্তানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এটি আপৎকালীন ধাক্কা সামলাতে সহায়ক হবে বটে, কিন্তু পোশাক শিল্পের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে ক্রেতাদের পরবর্তী আচরণের ওপর।

দেশের অর্থনীতিতে করোনার প্রভাব সম্পর্কে অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘রপ্তানি আয়ে করোনার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। কারণ, আমাদের তৈরি পোশাক খাতের প্রধান বাজার যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, স্পেন ও ইতালিতে করোনার সংক্রমণ সবচেয়ে বেশি। এই পরিস্থিতিতে তারা পোশাক নেওয়া কমিয়ে দিয়েছে। সামনে তাদের অর্থনীতিতেও মন্দা দেখা দেবে। এর সরাসরি প্রভাব বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ে পড়বে।’

করোনাভাইরাসের কারণে দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) নেতিবাচক প্রভাবের আশঙ্কা করছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। একই সঙ্গে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়েও নেতিবাচক ধারা হতে পারে বলে মনে করে গবেষণা সংস্থাটি।

সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘যেসব দেশ থেকে আমদানি-রপ্তানি করা হয় সব দেশই করোনায় আক্রান্ত। ফলে সামগ্রিকভাবে বহির্খাতে যে পারফরম্যান্স, সামনের দিকে তার নেতিবাচক প্রভাব দেখতে পাচ্ছি।’ তিনি আরও বলেন, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা বেশি সমস্যায় পড়েছে। তাদের প্রতি সরকারের বিশেষ নজর দিতে হবে।

এদিকে আসছে বাজেট প্রণয়নের সময় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর)করোনাভাইরাসের কারণে উদ্ভূত পরিস্থিতি বিবেচনায় রাখার আহ্বান জানিয়েছে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই)। যাতে সরকার, সাধারণ জনগণ এবং বেসরকারি খাত এই অবস্থা উত্তরণে সহায়ক নীতিমালা ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনার সুফল পেতে পারে।

ডিসিসিআইয়ের সভাপতি শামস মাহমুদ এনবিআরকে এ সম্পর্কে বিভিন্ন প্রস্তাব দিয়েছেন। সেখানে রপ্তানিমুখী শিল্পে উৎপাদন বাড়াতে ও রপ্তানি বহুমুখীকরণকে উৎসাহিত করতে শিল্পপণ্য উৎপাদনে সব ধরনের কাঁচামাল ও মেশিনারিজের ওপর অগ্রিম কর প্রত্যাহারের প্রস্তাব রয়েছে। এ ছাড়া তৈরি পোশাক খাতের ডিজাইন এবং ডামি সেন্টার, স্যাম্পল, ইটিপি, জ্বালানি দক্ষতা এবং পরিবেশবান্ধব পণ্য ও সেবার ওপর ভ্যাট অব্যাহতিরও প্রস্তাব করেছে ডিসিসিআই।

জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থার (আঙ্কটাড) হিসাবমতে, ২০২০ সালে সারা বিশ্বে করোনার প্রভাবে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ শতাংশ কমতে পারে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার মতে, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে বিশ্বে আনুমানিক ২ দশমিক ৫ কোটি লোক তাদের চাকরি হারাতে পারে।

এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ইতিমধ্যে প্রাক্কলন করেছে, বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের কারণে প্রবৃদ্ধি প্রায় ১ দমমিক ১ শতাংশ হ্রাস পেতে পারে এবং প্রায় আট লাখ ৯৪ হাজার ৯৩০ কর্মজীবী তাদের চাকরি হারাতে পারে।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) জ্যেষ্ঠ গবেষক ড. নাজনীন আহমেদ ঢাকাটাইমসকে বলেন, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের যেকোনো সংকট মোকাবেলার সক্ষমতা কম থাকে। এই সময়ের সংকটের বড় জায়গা চাহিদার সংকট। এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়বে অনু, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে তারা। অভ্যন্তরীণ বাজারের চাহিদার ওপর তাদের আয় অনেকাংশেই নির্ভরশীল। এসএমই উদ্যোক্তারা মূলত দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারের জন্য উৎপাদন করে। এই সময় যেহেতু নানা শিল্পপণ্যের চাহিদা কমে গেছে, তাই এসব প্রতিষ্ঠান সমস্যায় পড়তে পারে। তাদের কর্মচারীদের বেতন দেওয়া নিয়েই বিপাকে পড়ছেন তারা।’

ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, বড় শিল্পে সক্ষমতা বেশি, তাই বড় শিল্পের চেয়ে বর্তমান পরিস্থিতিতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দরকার।

বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন তাদের প্রাথমিক এক হিসাবে উল্লেখ করেছে, শুধু কয়েকটি রপ্তানি খাতে ক্ষতির পরিমাণ ৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে। সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে করোনার ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কেমন প্রভাব পড়তে পারে, এ-সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন তৈরি করতে বলা হয়েছিল ট্যারিফ কমিশনকে। প্রাথমিক তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে ট্যারিফ কমিশন একটি প্রতিবেদন তৈরি করে তা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে দিয়েছে।

ওই প্রতিবেদনে তিন খাতের সম্ভাব্য ক্ষতির পরিমাণ উঠে উসেছে। এই তিন খাত হলো-ফিনিশড লেদার, গার্মেন্ট এক্সেসরিজ ও মুদ্রণ শিল্প। এ ছাড়া, দেশের প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাক শিল্পও সুদূরপ্রসারী ক্ষতির মুখে হতে পারে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে আরও বলা হয়েছে, করোনার কারণে গত এক মাসে ২০০ কোটি টাকার জীবন্ত কাঁকড়া ও কুঁচে রপ্তানি করা যায়নি। সবই নষ্ট হয়ে গেছে। রপ্তানি শুরু না হলে শুধু এই খাতেই ক্ষতি হতে পারে ৩৫০ থেকে ৪০০ কোটি টাকা।

ইতিমধ্যে মুখ থুবড়ে পড়েছে পর‌্যটন ও ভ্রমণ খাতের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো। সারা বিশ্বে বন্ধ হয়েছে এয়ারলাইন্স। তার প্রভাবে বন্ধ হয়ে পড়েছে হোটেল, রিসোর্ট, ক্রুজলাইন, রেস্টুরেন্ট ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ট্যুর অপারেটর ও ট্রাভেল এজেন্সি।

এশিয়ান ট্যুরিজম ফেয়ারের আহ্বায়ক ও পর্যটন বিচিত্রা সম্পাদক মহিউদ্দিন হেলাল ঢাকাটাইমসকে বলেন, স্থবির হয়ে পড়েছে বিশ্ব। থমকে গিয়েছে গোটা মানবজাতি। বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে পর্যটন শিল্প। অন্যান্য শিল্প দুর্যোগ কেটে যাওয়ার পরপরই উৎপাদন শুরু করতে অথবা গতিশীলতায় আসতে পারলেও পর্যটন শিল্পে এমন সম্ভাবনা নেই। সঠিকভাবে এখনই পরিকল্পনা না করলে, সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা এই আপদকালীন সময় সরকারি প্রণোদনা না পেলে, বন্ধ হবে অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, চাকরি হারাবে অনেক কর্মচারী। এই দুর্যোগকাল মোকাবেলার জন্য কী কী করা যেতে পারে সে বিষয়ে অনতিবিলম্বে বিশেষজ্ঞ ও ব্যবসায়ীদের নিয়ে জাতীয়ভাবে ‘পর্যটন শিল্পে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি’ (Tourism Crisis Management Committee) গঠনের প্রস্তাব করেন মহিউদ্দিন হেলাল।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here