সুন্দরবনে হরিণের অস্তিত্ব হুমকির মুখে ১৩ টি অভিযানে ৫১০ কেজি মাংস উদ্ধার

0
523

হেদায়েত হোসাইন লিটন,বাগেরহাট প্রতিনিধিঃ
পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ সুন্দরবনে পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ মায়াবী চিত্রল হরিণের অস্তিত্ব এখন হুমকির মুখে। থেমে নেই চোরা শিকারী ও পাচারকারীদের অপতৎপরতা। চোরা শিকারীদের কবলে পড়ে মারা পড়ছে অসংখ্য হরিণ। বন বিভাগ সহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সুন্দরবনের সম্পদ ও বন্যপ্রাণি রক্ষায় তৎপর থাকলেও ওই চক্রটি বিভিন্ন কৌশলে বনে ঢুকে বিভিন্ন প্রকার ফাঁদ পেতে হরিণ শিকার করে প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে মাংস, চামড়া, মাথা পাচার করছে। মাঝে মধ্যে বন বিভাগ, কোস্টগার্ড বা পুলিশের হাতে  পাচারের সময় ধরাও পড়ছে। গত প্রায় দেড় বছরে পূর্ব সুন্দরবন ও পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন এলাকায় বন বিভাগ, কোস্টগার্ড, পুলিশ ১৩টি অভিযানে প্রায় ৫’শ ১০ কেজি হরিণের মাংস, ৩টি চামড়া, ৬ টি মাথা, ৮টি নৌকা সহ বিপুল পরিমাণ হরিণ শিকারের ফাঁদ জব্দ করছে। এ সময় হরিণ শিকার ও পাচারের অভিযোগে অর্ধশতাধিক ব্যক্তিকে আটক করা হয়েছে।
১৯৯৫ সালের এফএও এবং ইউএনডিসি’র কারিগরি সহযোগিতায় পরিচালিত পশু শুমারী অনুযায়ী সুন্দরবনে হরিণের সংখ্যা ছিল ১ লাখ ২০ হাজার। ১৯৯৬-৯৭ সালের ইন্টিগ্রেটেড রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট প্রকল্পের আওতায় বন্য প্রানীর উপর এক জরিপে হরিণের সংখ্যা ছিল এক লাখ থেকে দেড় লাখ। ২০০১ সালের আরেক জরিপে হরিণের সংখ্যা ছিল একই।
সুন্দরবনের আকর্ষণ বনের রাজা রয়েল বেঙ্গল টাইগার ও শিকারীদের হাত থেকে রক্ষা পেতে সব সময় সতর্ক থাকলেও চোরা শিকারীদের বুলেটবিদ্ধ, মাছ বা কাঁকড়ার পাস করে বনে ঢুকে জাল পেতে স্প্রি বসানো ফাঁদ, বিষটোপ, কলার মধ্যে বরশি ঝুলিয়ে রাখা এবং চেতনা নাশক ঔষদ দিয়ে নিধন করা হয়ে থাকে বিপুল সংখ্যক হরিণ। শিকারীদের শিকার করা হরিণের মাংস, চামড়া পাচার হচ্ছে দেশের বিভিন্ন এলাকা শহরের এক শ্রেণির উচ্চবিলাসী মানুষ ও সমাজপতিদের বাসায়। আবার হরিণের ২/৪ কেজি মাংস দিয়ে করা হয়েছে নানা কাজের তদবীর। কেজি প্রতি এ মাংস ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। হরিণের চামড়ারও কদর রয়েছে যথেষ্ঠ। একটি চামড়া ৫/৭ হাজার টাকা বিক্রি হয়ে থাকে বলে সূত্র জানায়।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, পূর্ব সুন্দরবনের পশুর নদীর চিলা এলাকা থেকে গত ৭ জানুয়ারি বনরক্ষীরা অভিযান চালিয়ে ৩০ কেজি হরিণের মাংস ও পাঁচারকারীদের ফেলে যাওয়া একটি নৌকা উদ্ধার করে। এ সময় পাচারকারীরা পালিয়ে যায়। গত ৩ জানুয়ারি শরণখোলা রেঞ্জের চরখালী টহল ফাঁড়ির বনরক্ষীরা চরখালী এলাকায় অভিযান চালিয়ে ১৪’শ ফুট হরিণ ধরার ফাঁদ জব্দ করে। এ সময় শিকারীরা গহীন বনে পালিয়ে যায়। গত ৯ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় একই এলাকায় অভিযান চালিয়ে ২০ কেজি হরিণের মাংস ও ১ টি নৌকা এবং ৮ ডিসেম্বর দুপুরে শরণখোলা রেঞ্জের শাপলা টহল ফাঁড়ির বনরক্ষীরা সিন্দুরবাড়িয়া এলাকায় অভিযান চালিয়ে পরিত্যাক্ত অবস্থায় ১০ কেজি হরিণের মাংস ও ১ টি নৌকা উদ্ধার করে। গত ২২ নভেম্বর রাতে ও ২৩ নভেম্বর বন বিভাগের স্মার্ট টহল টিম বিভিন্ন এলাকা থেকে দুবলার চরের রাস মেলায় আসা ৫৭ জনকে হরিণ শিকার করার অভিযোগে আটক করে। এদের দুটি ট্রলারের তল্লাশি চালিয়ে হরিণের মাথা, চামড়া, ৫০ মিটার হরিণ শিকার করার ফাঁদ উদ্ধার করে। তাদের বিরুদ্ধে বন আইনে মামলা করা হয়েছে।
কোস্টগার্ড পশ্চিম জোনের হারবাড়িয়া টহল দল গত ১১ নভেম্বর বন সংলগ্ন মিরগামারি খাল সংলগ্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে ১০ কেজি হরিণের মাংস, একটি চামড়া, একটি মাথা উদ্ধার করে চাঁদপাই ফরেস্ট অফিসে হস্তান্তর করে। গত ৮ জুন ভোরে সুন্দরবন সংলগ্ন হরিণ শিকরী ও পাঁচারকারী হিসাবে পরিচিত চরদুয়ানী এলাকার বলেশ্বর নদীর শাখা নাপিতখালী খাল থেকে শরণখোলা রেঞ্জের সুপতি কোস্টগার্ড অভিযান চালিয়ে ২৪০ কেজি হরিণের মাংস, একটি নৌকা উদ্ধার করে। এ সময় পাঁচারকারীরা পালিয়ে যায়। গত ১২ মে সন্ধ্যায় ও গভীর রাতে সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের স্মার্ট টিমের টহল ও জ্ঞানপাড়া টহল ফাঁড়ির বনরক্ষীরা শেলার চরের মানিকখালী খাল ও চরদুয়ানীর বলেশ্বর নদীতে অভিযান চালিয়ে হরিণ শিকারে ব্যবহৃত এম.বি আল-মদিনা-১ নামের একটি কার্গো জাহাজ, ৩০ কেজি হরিণের মাংস, ২৩০ টি হরিণ ধরার ফাঁদ ও ১টি নৌকা জব্দ করে। এ সময় হরিণ শিকারের দায়ে দাকোপ উপজেলার আমতলা গ্রামের বিশ্বজিৎ মৃধা, বাউফল উপজেলার দাসপাড়া গ্রামের আল-আমিন, গলাচিপা উপজেলার চরকাজল গ্রামের মোঃ হাসান, একই গ্রামের মোঃ সুমন, আসাশুনি উপজেলার নওয়াপাড়া গ্রামের সাইদ সরকারের বিরুদ্ধে বন বিভাগীয় মামলা হয়েছে।
কোস্টগার্ড পশ্চিম জোনের অপারেশন কর্মকর্তা লে. আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ বলেন, পূর্ব সুন্দরবন এলাকায় কোস্টগার্ডের ৫টি স্টেশনের কর্মকর্তা ও সদস্যবৃন্দ তাদের আওতাধীন এলাকাসমূহে আইন শৃংখলা নিয়ন্ত্রন ও বন্যপ্রাণী রক্ষায় প্রতিনিয়ত তাদের টহল অব্যাহত রয়েছে। যে কারণে শিকারী চক্র হরিণ শিকার করলেও শেষ পর্যন্ত ধরা পড়ে। চোরা শিকারী ও পাচারকারীরা মাছের পাস নিয়ে সুন্দরবনে ঢুকে হরিণ সহ বন্যপ্রাণি শিকার করে। তাই হরিণ শিকার প্রতিরোধে বৈঠক করে চোরা শিকারীদের একটি তালিকা তৈরি করে তাদের পাস বন্ধ করে দিয়েছে বন বিভাগ। এ ব্যাপারে স্থানীয় এলাকাবাসী অসচেতন। যার কারণে অভিযানকালে হরিণ শিকারী ও পাচারকারীরা মাংস, চামড়া ও মাথা রেখে পালিয়ে যায়। আমাদের পক্ষ থেকে ক্যাম্পেইং এর মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য বন্যপ্রাণি রক্ষায় জনসাধারণকে বিভিন্ন ভাবে অবহিত করা হয়। সুন্দরবনের সম্পদ রক্ষা সহ আইনী বিষয়গুলো বাস্তবায়নের ভূমিকায় রয়েছে বন বিভাগ। আমরা তাদের সহায়তা করছি মাত্র।
সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মাহমুদুল হাসান বলেন, সুন্দরবনের হরিণ শিকার ও পাচার রোধে কঠোর নজরদারি রয়েছে। শিকারী ও পাচারকারীদের বিরুদ্ধে বন বিভাগের দায়ের করা মামলায় সম্প্রতি দুইজন হরিণ শিকারীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাকিদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। হরিণ সহ বন্যপ্রাণি ও বনজ সম্পদ রক্ষায় বনরক্ষীদের পাশাপাশি বন বিভাগের ৪টি স্মার্ট টিম পর্যায়ক্রমে পূর্ব সুন্দরবনে কাজ করছে। হরিণ শিকারের ঘটনা আগের চেয়ে কমেছে। সুন্দরবন বিশাল এলাকা তাই হরিণ শিকার রোধে সর্ব মহলের সহযোগিতা প্রয়োজন।
খবর৭১/এসঃ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here