নড়াইলে ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতার মধ্যদিয়ে শুরু হলো ৫দিন ব্যাপী হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্যতম ধর্মীয় অনুষ্ঠান বাসন্তী পূজা।

0
562

উজ্জ্বল রায়, নড়াইল জেলা প্রতিনিধি:

নানা ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতায় শুরু হয়েছে হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্যতম বড় ধর্মীয় আয়োজন বাসন্তী পূজা। শনিবার (২৪ মার্চ-) দেবীর অধিবাসের মধ্য দিয়ে পূজার শুরু হয়। বুধবার দশমীতে শেষ হবে পাঁচ দিনের এ আয়োজন। জানান, মহাসপ্তমীতে বিভিন্ন রূপে ধান, দূর্বা, ফুল ও বেলপাতা দিয়ে দেবীর চরণে অঞ্জলি দেন ভক্তরা। এর আগে সকালে সূর্য্যসেন পূজা মন্ডবে উলু ধ্বনি, ঢাকের বাদন, কাসর, ঘন্টা ও শঙ্খ বাজিয়ে এবং পুরোহিতের মন্ত্রপাঠের মধ্যদিয়ে দেবীর পূজা হয়। শহরের রূপগঞ্জ বাজার সূর্য্যসেন মন্ডবের পুরোহিত শ্রী সূর্য্য চক্রবর্ত্তী জানান, চৈত্র মাসের শুক্ল পক্ষের ষষ্ঠী তিথিতে বোধনের মধ্য দিয়ে বাসন্তী পূজা শুরু হয়। বসন্তকালে হয় বলে এর নাম বাসন্তী পূজা। শারদীয় দুর্গা পূজার তুলনায় এর আয়োজন কম হলেও ধর্মীয় তাৎপর্য কোনোভাবেই কম নয়। কথিত আছে সুরত রাজা হারানো রাজ্য ফিরে পেতে বন্তকালে দুর্গা দেবীর আরাধনা করেছিলেন। সেই বিশ্বাস থেকে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন অশুভ শক্তিকে পরাভুত করতে বসন্তকালে এ পূজার আয়োজন করে আসছেন। নড়াইল শহরের রূপগঞ্জ বাজার সূর্য্যসেন মন্ডবের আয়োজক কমিটির সভাপতি, সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা কৃষ্ণ পদ বিশ্বাস, সাধারণ সম্পাদক বাবু লাল ভট্টাচার্য্য, সদস্য বিপ্লব দাস, চিরঞ্জিৎ ভট্টাচার্র্য্য, অচিন্ত কীর্ত্তনীয়াসহ সকল সদস্যবৃন্দ জানান, নড়াইলে এই প্রথম বারের মত বাসন্তীপূজার আয়োজন করেছি। এর আগে নড়াইল শহরের আশপাশে এ বাসন্তীপূজা জাকজমোকভাবে আয়োজন করা হয়নি। প্রথমবারের মত এ পূজার আয়োজন করতে পেরে আমরা সকলে আনন্দিত। নড়াইলের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রায় ১০-১৫ টি বাসন্তী পূজার আয়োজন করা হয়েছে। বাসন্তীপূজা শুধু বসšনÍ কালেই উদ্যাপিত হয়ে থাকে। আমরা আশা করছি আগামীতেও আমাদের অঞ্চলে বাসন্তীপূজার আয়োজন করা হবে। আমাদের এই উদ্বোগে উৎসাহিত হয়ে এলাকার বিভিন্ন অঞ্চলে আগামীতে পূজার সংখ্যা আরো বাড়বে বলে সদস্যদের ধারণা। এ বিষয়ে কমিটির সভাপতি জানান, আমাদের এ পূজার আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য পুলিশে নিকট আবেদন করা হয়েছে। আমরা আশা রাখছি পুলিশ সুপার এ পূজায় আইনশৃঙ্খলা রাক্ষাকারী বাহিনী নজরদারিতে রাখবে। এ বিষয়ে নড়াইল পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন পিপিএম বলেন, পূজা কমিটির পক্ষ থেকে আমাকে একটি পত্র দেওয়া হয়েছে। পত্রটি পেয়ে আমি প্রত্যেকটি পূজা মন্দিরে আইনশৃঙ্খলা রাক্ষাকারী বাহিনী পাঠিয়েছি। সেখানে আইনশ্ঙ্খৃলা জোরদার করা হয়েছে। কোন প্রকার অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলে সাথে সাথে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। আর আমি সময়করে প্রত্যেকটি পূজা মন্দির আগামীকাল ঘুরে ঘুরে দেখব বলে আশ্বাস প্রদান করেন। এ বিষয়ে নড়াইল জেলা অনলাইন মিডিয়া ক্লাবের সভাপতি উজ্জ্বল রায় বলেন, নড়াইলে এই প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে বাসন্তীপূজার আয়োজন করা হয়েছে। এতে আমরা খুবই আনন্দিত। শুধু এবছরেই নয় বাসন্তীপূজা আমরা নড়াইলে প্রতিবছরেই দেখতে চায়। সভাপতির সাথে তাল মিলিয়ে একই বক্তব্য দেন, সাধারণ সম্পাদক মোঃ হিমেল মোল্যা, কোষাধ্যক্ষ আক্তার হোসেন মোল্যা (বাগডাঙ্গা), প্রচার সম্পাদক বুলু দাস, দৈনিক ভোরের বাংলার প্রকাশক ও সম্পাদক মোঃ জাহাঙ্গীর শেখ, বার্তা সম্পাদক মোঃ হাবিবুর রহমান শাওনসহ আরো অনেকে। এই উপমহাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় পশ্চিম বাংলা ও বাংলাদেশেই দুর্গাপূজো প্রধান উৎসব রূপে গণ্য হয়ে আসছে। কলকাতার নামকরা পুরনো পূজাগুলোর মধ্যে প্রথম সারিতে আছে শোভাবাজার রাজবাড়ি, হাটখোলার দত্ত, পাথুরিয়াঘাটা, লাহাবাড়ির পূজা, ছাতুবাবু-লাটুবাবুর বাড়ির পূজা, মালিক বাড়ির পূজা ইত্যাদি। প্রাণকৃষ্ণ হালদারের পুজো: কলকাতার ইতিহাস ঘাঁটলে সবচেয়ে পুরনো পূজা বলতে পাওয়া যায় বাগবাজারের প্রাণকৃষ্ণ হালদারের পূজা। কষ্ঠিপাথরের খোদাই করা সেই মূর্তির সঙ্গে ছেলেমেয়ে নন, ছিলেন জয়া আর বিজয়া নামে দুই সঙ্গিনী। সে প্রায় ৪০০ বছর আগের কথা। বেহালার সাবর্ণ রায় চৌধুরীর পূজা: কলকাতার প্রথাগত দুর্গা পূজার পথিকৃৎ কিন্তু প্রায় ৪০০ বছরের পুরনো বেহালা সাবর্ণ রায় চৌধুরীদের এই পূজা। ১৬১০ সালে এই পূজার সূত্রপাত করেন বড়িশার জমিদার লক্ষ্মীনারায়ণ রায় মজুমদার। এই পূজা আজো চলছে শুরুর সময়কার আচার পদ্ধতি অনুসারেই। পূজার বোধন হয় কৃষ্ণপক্ষের নবমী তিথিতে, অর্থাৎ মহানবমীর ১৫ দিন আগের তিথিতে। দেবী মূর্তির রূপ ও রংয়ের কোনো পরিবর্তন নেই। রূপে মূর্তিও তৈরি হয় সেই পুরনো আমলের কাঠামোর ওপর। আটচালা মুপেই হয় কুমারী পূজা। শোভাবাজারের রাজবাড়ির পূজা: ১৭ ৫৭ সালে লর্ড ক্লাইভের পলাশী জয়ের পরে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির অফিসারদের আপ্যায়নের জন্যই রাজা নবকৃষ্ণদেব এই পূজার আয়োজন করেন। রথের দিনে কাঠামো পূজা করে মূর্তি বানানো শুরু হয়। বোধন হয় নবমীর ১৫ দিন আগে। পূজায় বসত বাছাই করা বাইজিদের নাচের আসর। সন্ধিপূজায় কামান ছোঁড়া হতো। গোরাদের ব্যান্ড বাজিয়ে মহাসমারোহে জোড়া নৌকায় ভাসান হতো দশমীতে। তারপর উড়িয়ে দেওয়া হতো কৈলাশের উদ্দেশ্যে নীলকণ্ঠ পাখি। হাটখোলার দত্তবাড়ির পূজা: পূজায় শোভাবাজার বাড়ির সঙ্গে বরাবরের টক্কর দিত হাটখোলার দত্তরা। নিমতলা স্ট্রিটে জগৎরাম দত্ত এই পূজার প্রচলন করেন। পরে পূজার দায়িত্ব নেন ঈশ্বর দেব প্রসাদ। সিংহের মুখ হতো ঘোড়ার মতো। চালচিত্রের উপরে রাধাকৃষ্ণ আর নিচে নিশুম্ভ যুদ্ধের বর্ণনা আঁকা। মাথায় থাকত দুটি টিয়া। রিপু বলির নামে ফল, সবজি বলি হতো। বাইজি থেকে সপুত্র মহিলা সব কিছুতেই ছিল টেক্কা দেওয়ার লড়াই। লড়াই চলত ভাসানের মিছিল বা ঘাটের লড়াই নিয়ে। ভাসানে উড়ত দুইটি নীলকণ্ঠ।লাহাবাড়ির পূজা: ঈশ্বর প্রাণকৃষ্ণ লাহা প্রায় ২০০ বছর আগে এই পূজা শুরু করেন। কথিত আছে স্বপ্নে পারিবারিক দেবী জয়া জয়া মায়ের নির্দেশেই পূজা আরম্ভ হয়। এই পূজা লাহা বাড়ির পূজা নামে বিখ্যাত। এদের দুর্গা শিবনেত্র। শিবের কোলে তার অধীষ্ঠান। রিপু বলি এদেরও হয়। পূজা শুরু হয় সপ্তমীতে নাটমন্দিরে জয়া জয়া মা-এর অধীষ্ঠানের পরে। দশমীতে যখন মা বেরিয়ে যান তারপর থেকে মূল ফটক বন্ধ থাকে। বিসর্জনের পরে একজন বাইরে থেকে চেঁচিয়ে ৩ বার মা কে ডাকেন, মা ভিতরে থেকে গেছেন কী না জানতে। নিশ্চিত হলে তবে দরজা খোলে। ছাতুবাবু-লাটুবাবুর পূজা: ১৭৮০ সালে থেকেই রামদুলাল দে সরকার তার বিডন স্ট্রিটের বাড়িতে যে পূজার প্রচলন করেন তাই পরে ছাতুবাবু-লাটুবাবুর পূজা নামে খ্যাত। এদের ঠাকুরদালান গঙ্গামাটির তৈরি, এদেরও রথের দিনে কাঠামো পূজা হয়। এখানে অসুরসহ মা-দুর্গা এবং তার সন্তানদের সাজানো হয় মঠচুবড়ি আর্টে। সিংহ ঘোটকাকৃতি। লক্ষ্মী- সরস্বতী পূজিত হন জয়া-বিজয়া রূপে। আর থাকেন শিব, রাম, হনুমান। প্রতিপদ থেকে ষষ্ঠি পর্যন্ত ঘট পূজা করা হয়। সপ্তমীতে কলা বোউ স্নান করিয়ে মূর্তিপূজা শুরু। শুরুর দুই বছর পরে এক অষ্টমীতে বলির জন্য আনা ছাগশিশু রামদুলালের পায়ের ফাঁকে বাঁচার জন্য আশ্রয় নেয়। এই ঘটনার পরে প্রাণি বলি বন্ধ হয়ে যায়। আখ ও চালকুমড়ো বলি হয়। পাথুরিয়াঘাটার পূজা: পাথুরিয়াঘাটায় প্রায় ১৬৫ বছরের পুরনো দুর্গা পূজার সূত্রপাত রামলোচন ঘোষের হাতে। ৩ চালার ঠাকুর আর ঘোড়া মুখের সিংহ এই পূজায়। ষষ্ঠী ও নবমীতে কুমারী পূজা ছাড়া সধবা পূজাও হয়। এদের শিল্পী ও ঢাকিরাও আসত পরিবারের মধ্যে থেকেই। ৭০-৮০ বছর হলো এখানে বলি বন্ধ। হাওড়া পন্ডিত মহাশয়ের বাড়ির পূজা: হাওড়া পন্ডিত সমাজের সভাপতি মুরারী মোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে পূজা শুরু হয় ৩৫০ বছর আগে। মা এখানে কন্যারূপে পূজিত হন। বাড়ির মেয়েরা পূজার বৈদ্যের জন্য মুড়কি, নাড়ু তৈরি করেন। সারা বছর বাড়িতে যা রান্না হয় সপ্তমী থেকে নবমী সেই সমস্ত পদ রান্না করে মায়ের ভোগ নিবেদন করা হয়। অষ্টমীর দিন সন্ধি পূজার পর একটি থালায় সমান করে সিঁদুর দিয়ে চৌকির ওপর মূল বেদীর তলায় একটি কাঠির সাহায্যে রাখা হয়। দশমীর দিন ওই থালায় মায়ের হাত, পা কিংবা পদ্মের চিহ্ন পাওয়া যায়।

খবর ৭১/ ই:

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here