বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ শুনে মৃত্যু ভয় উপেক্ষা করেই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ!

0
262

উজ্জ্বল রায়, নড়াইল জেলা প্রতিনিধিঃ নড়াইল ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্র মৃত্যু ভয় উপেক্ষা করেই যুদ্ধে অংশগ্রহণ: বীরমুক্তিযোদ্ধা সাইফুর রহমান হিলু গ্রামের বাড়ি নড়াইলের দিঘলিয়া ইউনিয়নের ৮নং কুমড়ি গ্রামে। বর্তমানে জেলা আওয়ামী লীগের মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক সম্পাদক এবং জেলা পরিষদের সদস্য। বর্তমানে তিনি সামাজিক ও উন্নয়নমূলক কর্মকা- নিয়ে সময় অতিবাহিত করছেন। এই বীরযোদ্ধা মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ ও বর্তমান সময়ে চিন্তা চেতনা নিয়ে একান্ত কথা বলেছেন। সাইফুর রহমান হিলু বলেন, ১৯৭১ সালে যখন মুক্তিযুদ্ধের ডামাডোল বাজতে শুরু করে। আমি তখন নড়াইল ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্র। আমি তখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী প্রগতিশীল ছাত্র রাজনীতিতে বিশ্বাস করতাম। বঙ্গবন্ধুর ৭মার্চো সময় আমি ঢাকায় বেড়াতে গিয়েছিলাম। রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭মার্চের ভাষণ শুনি। ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম’ ভাষণে উজ্জীবিত হয়ে নড়াইলে ফিরে আসি। তখন স্বাধীনতাকামীদের নিয়ে ২৭ মার্চ বেলা ১১টার দিকে নড়াইল ট্রেজারীর একটি কক্ষ ভেঙ্গে আমরা অস্ত্র নিয়ে যাই। এরপর ছাত্র, জনতা, কৃষক সবাই সম্মিলিতভাবে আমরা যশোরের ক্যান্টনমেন্টের দিকে ধাবিত হয়। যশোর থাকাকালীণ সময়ে যশোর শহরের থেকে পাকহানাদার বাহিনী আমাদের উপর বোম্বিং শুরু করে। আমাদের ট্রেনিং না থাকার কারনে আমরা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে তেমন সক্ষম হয়নি। তখন আমরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যাই। তখন আমাদের প্রশিক্ষণের প্রয়োজন অনুধাবন হলো। তদানীন্তন ছাত্র নেতা তোফালে আহম্মেদের নির্দেশে আমরা ভারতে প্রশিক্ষণের জন্য যাই। আমাদেরকে ভারতের টালিখোলা থেকে শিয়ালদাহ স্টেশনে নেয়া হয় আমাদেরকে । ওই প্রদেশের দেড়াদুনের জাকার্তা নামক স্থানে আমাদের নেয়া হয় এবং সেখানে ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করা হয়। সেখান থেকে ট্রেনিং নিয়ে দেশে আসি। দেশে আসার পথে আমাদের এই যশোর অঞ্চলে শুধু যে পাক বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করতে হয়েছে তা নয়। এখানে তৎকালীণ পূর্বপাকিস্তান কমিউনিষ্ট পার্টি যাদেরকে নকশাল নামে মানুষ চেনে, তাদের সঙ্গেও যুদ্ধ করতে হয়েছে। মাগুরার পুলুম নামক স্থানে নকশালদের সাথে আমাদের যুদ্ধ করতে হয়। আমরা সেখানে নকশালদের ফাঁদে পড়ে, আমাদের সেই সময়ের যে নেতৃত্ব সেই নেতৃত্বে ভুল বোঝাবুঝির কারনে আমরা ফাঁদে পড়ি এবং সেখানে আমাদেরকে নিরস্ত্র করা হয়। এরপরে আবারও ভারতের ব্যারাকপুরে যাই। সেখান থেকে পুনরায় অস্ত্র নিয়ে দেশে ফিরে আমরা পুনরায় সম্মুখ যুদ্ধে অবর্তীণ হই। ওই সময়ে আমরা নড়াইলের বিভিন্ন এলাকায় অবস্থান করতে থাকি। নড়াইল থানার অর্ন্তগত বাঁশগ্রাম ইউনিয়নের চাঁনপুর গ্রামের বিলের ভিতরে একটি ক্যাম্প গড়ে তুলি। মূলত তখন নড়াইল থানা এলাকায় মুজিব বাহিনীর কমান্ডারের দায়িত্বে ছিলেন শরীফ হুমায়ুন কবীর। ৮ ডিসেম্বর নড়াইলের লোহাগড়া থানা হানাদার মুক্ত হয়। শরীফ হুমায়ন কবীরের বাহিনী ও শামসুর রহমানের আরেকটি বাহিনী একত্রে মিলে ৯ ডিসেম্বর নড়াইলকে মুক্ত করার জন্য আক্রমন করি এবং ১০ ডিসেম্বর সকাল ১১টায় নড়াইল মুক্ত করি। ১৬ ডিসেম্বর সারাদেশের মতো আমরা বিজয় দিবস পালন করি। যুদ্ধকালীণ সময়ে আমাদের বেশ কিছু সহকর্মীকে হারাতে হয়েছে। তাদের সেই রক্তের ঋণ আমরা কোনদিন শোধ করতে পারবো না। এছাড়াও যুদ্ধকালীণ সময়ে অনেক আত্মীয় স্বজন মারা গেছে। যাদেরকে একনজর দেখার মতো সুযোগ হয়নি। যুদ্ধে যাবার সময় পরিবারের থেকে কোন বাধা দেওয়া হয়েছিলো কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে সাইফুর রহমান হিলু বলেন, আমরা যারা বাঙ্গালী। আমাদের পারিবারিক একটা বন্ধন বেশ বড়। এই পারিবাকির বন্ধন থেকে যুদ্ধে যাওয়াটা বেশ কষ্টের কাজ। যেমন মা বাবার কাছে তেমনি সেই যোদ্ধার কাছে। আমার পরিবারের কাছে বাঁধা পেলেও শেষ পর্যন্ত আমি যেতে পারি এবং আমার পরিবার পরে যখন আমি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দেশে ফেরত আসি এবং দেশের স্বাধীনতা যখন অর্জিত হয়, আমরা যখন একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হই তখন আমার পরিবার খুশি হয়। যুদ্ধে যাওয়ার পর আর ফিরতে পারবো কিনা এমন আশংকা মনের মাঝে থাকলেও দেশের জন্য মনটা শক্ত দৃঢ় অবস্থানে ছিল। তখন পাকবাহিনীর কাছ থেকে দেশকে মুক্ত করার যে আকাঙ্খা তা প্রবল হয়ে ওঠে। একজন দেশপ্রেমিক, একজন স্বাধীনতাকামী যোদ্ধা, সচেতন মানুষ, সে যখন দেশের প্রতি ভালবাসার অটুট নিয়ে সে যখন এগোয়। তখন তার মৃত্যু হতে পারে এইটাকে সে মনে করে না। কারন সে মনে করে আমার স্বাধীনতাই আমার মুল লক্ষ। সে ক্ষেত্রে কোন ত্যাগ ছাড়া কোন অর্জনই সক্ষম হয় না। কাজেই সেক্ষেত্রে ত্যাগের ক্ষেত্রে মানষিকতা যদি দৃঢ় থাকে তাহলে কোন ব্যক্তির পক্ষে ত্যাগস্বীকার করা মোটেও কঠিন কাজ নয়। আমার ক্ষেত্রেও যুদ্ধে গিয়ে মৃত্যুবরণ করবো কিনা এমন কিছু ভেবে দেখিনি। তখন দেশকে স্বাধীন করার স্বপ্নটাই মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। বীরমুক্তিযোদ্ধা সাইফুর রহমান হিলু বলেন, দেশ স্বাধীনের পর মুক্তিযোদ্ধাদের তেমন মুল্যায়ন করা হয়নি। অনেকে মুক্তিযোদ্ধা অনাহারে-অর্ধাহারে জীবন কাটিয়েছে। জীবনযুদ্ধে অনেক ভ্যান চালিয়ে, শ্রম বিক্রি করে সংসার চালিয়েছে। বর্তমান সরকার আমাদের ভাতা বৃদ্ধি করায় পরিবার-পরিজন নিয়ে ভালই আছি। সন্তানরা মুক্তিযোদ্ধার কোটায় চাকরি পেয়েছে। আমিসহ আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের আর অস্বচ্ছল বলা যাবে না। অপর এক প্রশ্নের জবাবে সাইফুর রহমান হিলু বলেন, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে আমাদের দেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধ্বংস করার চক্রান্ত চলে আসছে। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে নির্মমভাবে হত্যা করা হলো। এরপর স্বাধীনতা বিরোধীরা দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায় এসেছে। জাকারদের গাড়ীতে জাতীয় পতাকা ওড়ানো হয়েছে। বর্তমানে সময়েও অনেক মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা দেশে ভাল কোন সুযোগ সুবিধা পাচ্ছে না। কিন্তু অনেক স্বাধীনতা বিরোধীদের সন্তানরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভাল অবস্থানে রয়েছে। সরকারী প্রদত্ত অনেক সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছে। এসব বিষয়গুলি সরকারের নজর দেয়া প্রয়োজন। তবে আমার বিশ্বাস, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ এগিয়ে চলেছে। মুক্তিযোদ্ধারাও আগের তুলনায় অনেক সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে। একটি সুখী সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ গড়তে এদেশের মুক্তিযোদ্ধারা ও তাদের পরবর্তী প্রজন্ম কাজ করে যাবেন।
খবর৭১/ইঃ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here