সুন্দরগঞ্জ আসন পুণরুদ্ধারে মরিয়া জাপা-আ’লীগ, একই চেষ্টায় বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট

0
478

আবু বক্কর সিদ্দিক, গাইবান্ধা জেলা প্রতিনিধিঃ
জাতীয় সংসদের ২৯, গাইবান্ধার- ১ (সুন্দরগঞ্জ) আসন পুণরুদ্ধারে মরিয়া বর্তমান জাতীয় সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি (জাপা), ক্ষমতাসীন দল আওয়ামীলীগ ও বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের অন্যতম শরীক দল (জামায়াত)। সুন্দরগঞ্জ পৌরসভাসহ উপজেলার ১৫টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত এ নির্বাচনী আসনে বর্তমানে মোট ভোটারের সংখ্যা- ৩ লাখ ৩৮ হাজার ৫’শ ৫৬।
বিভিন্ন তথ্য নির্ভর সূত্রে জানা যায়, চলমান সরকারের মেয়াদ পূর্তীতে দরজা নাড়ছে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ইতোমধ্যে নির্বাচন কমিশন তফসিল ঘোষণার পূর্বাভাসে শুরু হয়েছে আসন্ন নির্বাচনকে ঘিরে নানান জল্পনা- কল্পনা। বিভিন্ন জোট বা দলের মনোনয়ন পত্যাশায় স্থানীয় নেতা- কর্মীরা স্ব- স্ব মনোনয়নে উপর মহলে যেমন দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন। তেমনি ভোটারসহ সাধারণ মানুষের সঙ্গে মতবিনিময়, নির্বাচনী ইস্তেহার প্রকাশ করে নানামুখী উন্নয়নের আশ্বাসও প্রদান করছেন। চলছে সর্বত্রই আসন্ন এ নির্বাচনকে ঘিরে মতপ্রকাশের গুরুত্বসহ মুক্তালোচনা। প্রতীক্ষা শুধু নির্বাচন কমিশন কর্তৃক তফশীল ঘোষণার। নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণার পর শুরু হবে মূল ভোটযুদ্ধ। সম্ভাব্য প্রার্থী ও কর্মী- সমর্থকদের ঘুম নেই। ঘটনাবহুল এ নির্বাচনী আসনটি দেশের অন্যতম আলোচিত ও পরিচিত। জাতীয় সংসদের বিগত নির্বাচনগুলোতে যে ফলাফল হয়েছে। তাতে স্পষ্টভাবে পরিচিত হয়েছে আসনটি জাপা’র শক্ত ঘাটি হিসেবে। তবে, জাতীয় পার্টি গঠন পূর্বে স্বাধীনতা পরবর্তী ১৯৭৩ সালে এ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী শামসুল হক সরকার বিজয়ী হন। এরপরবর্তীতে ১৯৭৯ সালে তিনি হেরে যান মুসলিম লীগ প্রার্থী খন্দকার রেজাউল আলমের নিকট। ১৯৮৬ সালে শুরু হয় জাতীয় পার্টির প্রথম নির্বাচন করার পালা। জাপার প্রথম নির্বাচনে দলের মনোনীত প্রার্থী হাফিজুর রহমান প্রামাণিক পর পর নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে হাফিজুর রহমান প্রামাণিক বিএনপিতে যোগদান করলে ১৯৯৬ সালে জাপা মনোনীত প্রার্থী হিসেবে ওয়াহেদুজ্জামান সরকার বাদশা বিজয়ী হন। এসব নির্বাচনে জাতীয় পার্টি মনোনীত প্রার্থীর সঙ্গে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী জামায়াতের মনোনীত প্রার্থীরা বিপুল ভোটের ব্যবধানে হেরে যান। জাপা মনোনীত প্রার্থীর সঙ্গেই জামায়াত মনোনীত প্রার্থীর চলে আসতে থাকে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা। ঐসব নির্বাচনে আ’লীগের মনোনীত প্রার্থীগণের প্রাপ্ত ভোটের ব্যবধান ছিল নির্বাচিত (জাপা) মনোনীত প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোটের অনেক বিশাল ব্যবধান। আর বিএনপিসহ অন্যান্য দলের মনোনীত প্রার্থীরগণের প্রাপ্ত ভোটে জামানত বাজেয়াপ্তও হয়েছিল। তবে,২০০১ সালে দু’টি প্রধান কারণে ছন্দপতন ঘটে শক্তঘাটি হিসেবে পরিচিত জাপা’র। এর প্রথমটি হলো- ওয়াহেদুজ্জামান সরকার বাদশার বিপক্ষে দলের নেতা- কর্মীদের শক্ত অবস্থান আর দ্বিতীয়টি হলো- বিএনপি- জামায়াতসহ ৪ দলীয় ঐক্য জোটবদ্ধ নির্বাচন। বর্তমান ক্ষমতাসীন দল আ’লীগের সে সময়ের মনোনীত প্রার্থী সৈয়দ আবুল হোসেন খাজার অবস্থান সুদৃঢ় না থাকায় ওয়েহেদুজ্জামান সরকার বাদশা বিদ্রোহী জাপা’র নেতা- কর্মীরাও ৪ দলীয় জোটের (জামায়াত) প্রার্থী মাওলানা আব্দুল আজিজ (বর্তমানে- বিজ্ঞ আন্তর্জাতিক মানবতা বিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুুুুনাল কর্তৃৃৃক মৃত্যুদন্ডাদেশ প্রাপ্ত পলাতক দাগী আসামী)২০০৮ সালের নির্বাচনে মহাজোটের শরীকদল জাপা মনোনীত প্রার্থী ডাঃ আঃ কাদের খাঁন (কর্ণেল অবঃ) বিপুল ভোটের ব্যবধানে ৪ দলীয় জোট (জামায়াত) প্রার্থী আঃ আজিজকে পরাজিত করলে সুনামের সঙ্গে ফের আসনটি উদ্ধার করতে সক্ষম হয় জাতীয় পার্টি (জাপা)। কর্নেল (অবঃ) ডা. আব্দুল কাদের খাঁন ২০১৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় নিজ বাড়িতে আততায়ীদের গুলিতে নিহত এমপি মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন হত্যা মামলার প্রধান ও একটি অস্ত্র মামলার আসামী হিসেবে বর্তমানে জেল হাজতে রয়েছেন। মঞ্জজুরুল ইসলাম লিটন ২০১৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে (নৌকা) প্রতীকে নির্বাচিত হন। এরপর ২০১৭ সালে অনুষ্ঠিত উপ- নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী গোলাম মোস্তফা বিজয়ী হন। তিনিও সড়ক দূর্ঘটনায় নিহত হলে চলতি বছরের ১৩ মার্চ উপ- নির্বাচনে আ’লীগের মনোনীত প্রার্থী আফরুজা বারীকে পরাজিত করে বিজয়ী হন জাতীয় পার্টির প্রার্থী ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী। এমপি নির্বাচিত হয়েই ব্যারিষ্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী  সুন্দরগঞ্জবাসীর জন্য এ্যাম্বুলেন্স সেবাসহ বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রসংশনীয় ইতিবাচক ভূমিকায় অবস্থান মজবুত করতে পেরেছেন বলে বিভিন্ন মহল তাঁর বিকল্প আর কেউ আসুক; তা মনে করেন না। মনোনয়ন প্রত্যাশীরা এলাকা চষে বেড়াচ্ছেন। নিজেদের পরিচিতি তুলে ধরতে ব্যানার- ফেস্টুনসহ নানাভাবে প্রচার- প্রচারণা চালাচ্ছেন। সম্প্রতি উঠান বৈঠক ও জনসচেতনতামূলক কর্মকান্ড নিয়ে তাঁরা বাড়ি বাড়িও যাচ্ছেন। সব মিলে এ আসনের সর্বত্রই বইছে নির্বাচনী হাওয়া। জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম মেম্বার ও বর্তমান এমপি ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী একক প্রার্থী হিসেবে রয়েছেন নির্বাচনী মাঠে। তরুণ এ এমপির এলাকায় গ্রহণযোগ্যতাও রয়েছে। তিনি শিক্ষাবান্ধব ও সমাজসেবক হিসেবে মানুষের দৃষ্টি কেড়েছেন। সমভ্রান্ত পরিবারের সদস্য হিসেবে আগে থেকেই বিভিন্ন দাতব্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তিনি সম্পৃক্ত। নিজে পার্টির উপজেলা শাখার সভাপতি, পার্টির মধ্যে কোনো অমিল না থাকায় এবারও ভোটের অঙ্কে ভালো অবস্থানে রয়েছেন তিনি। তবে ২০০১ সালে জামায়াত প্রার্থী নির্বাচিত হওয়ায় সাংগঠনিকভাবে এখানে জামায়াত শক্তিশালী অবস্থানে যায়। গোটা উপজেলায় জামায়াতের ব্যাপক প্রভাব বৃদ্ধি পায়। এ কারণেই আন্তর্জাতিক মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ওই দলের কেন্দ্রীয় নেতা দেলওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির আদেশ ঘোষিত হলে গোটা সুন্দরগঞ্জে জামায়াত-শিবিরের ব্যাপক তান্ডব চলে। ওই ঘটনায় সারাদেশে সুন্দরগঞ্জের নাম আলোচনায় আসে। পরবর্তী সময়ে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর তাঁর গুলিতে শিশু সৌরভকে হত্যাচেষ্টায় গ্রেপ্তার হওয়ার ঘটনায় সুন্দরগঞ্জ আরও আলোচনায় উঠে আসে। স্বাধীনতা পরবর্তী ১৯৭৩ সালে দেশের প্রথম সংসদ নির্বাচনে আ.লীগ প্রার্থী শামছুল হক সরকার নির্বাচিত করার পর আর আ.লীগ প্রার্থী এ আসনে বিজয়ী হতে পারেননি। পরবর্তী সময়ে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারী দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হন আ.লীগ প্রার্থী প্রয়াত মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন। তিনি নিহত হওয়ার পর শূন্য আসনে উপ- নির্বাচনে বিজয়ী হন আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী প্রয়াত সংসদ সদস্য গোলাম মোস্তফা আহমেদ। সড়ক দূর্ঘটনায় তারও মৃত্যু হলে আবার শূন্য হয় এই   আসন  । পুনরায় উপ-নির্বাচনে এমপি লিটনের বড় বোন আনন্দ গ্রুপ অব কোম্পানিজ অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আফরুজা বারীকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দেওয়া হয়। জাতীয় পার্টির প্রার্থী ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে বিপুল ভোটে পরাজিত করে বিজয়ী হন। আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আসনটিতে আওয়ামী লীগের হাফ ডজন সম্ভাব্য প্রার্থী দলের মনোনয়ন পেতে এখন থেকেই জেলা ও কেন্দ্রীয় পর্যায় দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন। তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন- নিহত সংসদ সদস্য মঞ্জুরুল ইসলাম লিটনের স্ত্রী জেলা মহিলা আ.লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক খুরশীদ জাহান স্মৃতি। তিনি স্বামীর সহচর হিসেবে রাজনৈতিক অঙ্গণে আলোচনায় রয়েছেন। অপরদিকে, সাবেক এমপি লিটনের বড় বোন আনন্দ গ্রুপ অব কোম্পানিজ অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আফরুজা বারীও আ.লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী। ছোট ভাই মঞ্জুরুল ইসলাম লিটনের খুনীদের সঠিক বিচার ও দ্রুত রায় কার্যকর করার প্রতিশ্রুতি দেন এমপি লিটনের ভোটারদেরকে। স্বামী ও ভাইয়ের অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করতে দলীয় মনোনয়ন পেতে আগ্রহী দু’জনই। এছাড়াও পৌর মেয়র উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি আব্দুল্লাহ আল মামুন, উপজেলা আ’লীগের যুগ্ম- আহবায়ক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘ভালোবাসি সুন্দরগঞ্জ’র প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি রেজাউল আলম রেজা ও হাফিজা বেগম কাকলী দলের মনোনয়ন পেতে আগ্রহী। তবে মহাজোট হিসেবে নির্বাচনে গেলে অনেক হিসাব- নিকাশই পাল্টে যেতে পারে বলে মনে করছেন স্থানীয় ভোটার ও রাজনীতিকরা। এ আসনে বিএনপি কখনই শক্তিশালী অবস্থানে ছিল না। এখনো সাংগঠনিকভাবে দুর্বল। ফলে, বিএনপি অনেকটাই জোট নির্ভর। তবে নির্বাচনী হাওয়া উঠায় নড়েচড়ে উঠেছেন দলের নেতাকর্মীরা। তারা দল গোছাতে এখন ব্যস্ত। ২০ দলের জোটই নির্ধারণ করবে কোন দলের প্রার্থী এখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে। তারপরও বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীরা দলীয় পর্যায়ে তৎপরতা শুরু করেছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি বর্তমানে জেলা সহ-সভাপতি ও সাবেক পিপি অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর আলম জিন্নাহ্ ও বর্তমান উপজেলা সভাপতি, হরিপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মোজাহারুল ইসলাম। তারা সাংগঠনিক তৎপরতার পাশাপাশি জনসংযোগও চালিয়ে যাচ্ছেন। বর্তমানে সুন্দরগঞ্জে জামায়াত- শিবিরের তান্ডবের ঘটনায় মামলা ও গ্রেপ্তার আতঙ্কে জামায়াত এখানে এখন কোণঠাসা প্রায়।নেতাকর্মীদের প্রকাশ্যে কোনো কার্যক্রম নেই। তাদের অধিকাংশই রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে। তবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে ডামাডোল শুরু হওয়ায় সুন্দরগঞ্জে জামায়াতের নেতাকর্মীদের মধ্যে তার কিছুটা প্রভাব পড়েছে। তবে তাদের কার্যক্রম একেবারে নীরবে। তারা নিজস্ব প্রার্থী হিসেবে সুন্দরগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান সহকারী অধ্যাপক মাজেদুর রহমানসহ একাধিক নাম মাঠে ময়দানে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। ২০ দলীয় জোটের প্রার্থী হিসেবে মাজেদুর রহমানকেই তারা প্রত্যাশা করছেন। তবে, আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মূল নির্বাচনী লড়াই হবে জাতীয় পার্টি (জাপা) মনোনীত প্রার্থীর সঙ্গে।
খবর৭১/ইঃ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here