খবর৭১ঃ নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাত খুন ও পুরান ঢাকার দর্জি বিশ্বজিৎ দাস হত্যা মামলা সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে চূড়ান্ত নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে।
ঘটনার পাঁচ বছর পর সাত খুন এবং সাত বছর পর বিশ্বজিৎ হত্যা মামলা বিচারের দুটি ধাপ পেরিয়েছে। মামলা দুটি এখন হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আসামিদের করা আপিল শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। নিহতদের পরিবারের সদস্যদের দাবি, উচ্চ আদালতের রায় যেন দ্রুত কার্যকর করা হয়। ২০১৮ সালের ১৯ নভেম্বর এ দুই মামলায় ১৫৬৪ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ করেন হাইকোর্ট।
২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড থেকে অপহৃত হন নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম, আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাতজন। তিন দিন পর শীতলক্ষ্যা নদীতে একে একে ভেসে উঠে ছয়টি লাশ। পরদিন মেলে আরেকটি লাশ। নিহত অন্যরা হলেন- নজরুলের বন্ধু মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম, লিটন, গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলম ও চন্দন সরকারের গাড়িচালক মো. ইব্রাহীম। আলোচিত এ মামলায় ২০১৬ সালের ১৬ জানুয়ারি নিম্ন আদালতের দেয়া রায়ে ২৬ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং নয়জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেয়া হয়। এ মামলার ৩৫ আসামির মধ্যে ২৩ জন কারাগারে আছেন। তাদের মধ্যে ১৭ জন র্যাবের সদস্য।
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, সাত খুন ও বিশ্বজিৎ হত্যা মামলা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। আপিল বিভাগে দ্রুত শুনানির কোনো সুযোগ নেই। তিনি বলেন, আসামিরা আপিল করেছেন এখন সিরিয়াল অনুযায়ী কার্যতালিকায় আসবে। আদালতের নির্দেশে মামলার সারসংক্ষেপ জমা দেয়া হবে। এরপর শুনানি অনুষ্ঠিত হবে।
মামলার শুরু থেকে র্যাবের সাবেক আট সদস্যসহ ১২ আসামি পলাতক। বিচারিক আদালতের রায়ের পর আসামিদের মৃত্যুদণ্ড অনুমোদনের জন্য মামলাটি হাইকোর্টে যায়। এ ছাড়া রায়ের বিরুদ্ধে ২৮ জন আসামি হাইকোর্টে আপিল করেন।
আসামিদের ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন) এবং আপিলের ওপর চূড়ান্ত শুনানি শেষে হাইকোর্ট ২০১৭ সালের ২২ আগস্ট সাত খুন মামলায় ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে রায় দেন হাইকোর্ট। বিচারিক আদালতের দেয়া রায়ে ১১ আসামির মৃত্যুদণ্ড পরিবর্তন করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়।
হাইকোর্টের রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, র্যাব একটি এলিট ফোর্স এবং মানুষের জানমাল রক্ষার জন্য তারা নানা রকম কাজ করছে। কিছু ব্যক্তির জন্য সামগ্রিকভাবে বাহিনীটিকে দায়ী করা যায় না। তাদের ভাবমূর্তি নষ্টেরও কারণ নেই। কিছু অপরাধীকে বিচারের আওতায় আনা এবং তাদের দণ্ড দেয়া হয়েছে। আদালত বলেন, এ ধরনের অপরাধ করে আসামিরা ছাড়া পেলে বিচার বিভাগের প্রতি জনগণ আস্থাহীন হয়ে পড়বে।
সাত খুনের ঘটনায় স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতা ও একটি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তা ও সদস্যদের সরাসরি জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠায় শুরু থেকে এ মামলার ভবিষ্যৎ নিয়ে জনমনে সংশয় ও সন্দেহ দেখা দেয়। মামলার রায়ে সেই সংশয় দূর হয়। এ ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে নাম আসে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা নূর হোসেনের। সবকিছু মিলিয়ে এ খুনের ঘটনা একটি চরম সংবেদনশীল ও আলোচিত বিষয়ে পরিণত হয়।
নিহতদের পরিবারের সদস্যরা রায় কার্যকরের অপেক্ষায় সময় পার করছেন। নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি জানান, ঘটনার পর থেকে আমরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ি। আমার ছেলে অসুস্থ। আমি নিজেও অসুস্থ। আদালতের প্রতি যথেষ্ট আস্থা আছে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, রায় বাস্তবায়ন দেখতে আর কতদিন অপেক্ষা করতে হবে। হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছেন সাজাপ্রাপ্ত ১৩ আসামি।
তাদের মধ্যে ১০ জন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত এবং তিনজন যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি রয়েছে। র্যাব-১১-এর সাবেক কোম্পানি কমান্ডার মেজর (অব.) আরিফ হোসেন আপিল করেছেন বলে জানান তার আইনজীবী এসএম শাহজাহান। তিনি বলেন, আপিলের পর আদালতের নির্দেশে সারসংক্ষেপ জমা দেয়ার পর শুনানির জন্য তালিকায় আসবে। কবে নাগাদ শুনানি হবে তা বলতে পারছি না। এটা সম্পূর্ণ আদালতের এখতিয়ার।
২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলের অবরোধ কর্মসূচি চলার সময় ঢাকার ভিক্টোরিয়া পার্কের সামনে দিনে-দুপুরে বিশ্বজিৎ দাস খুন হন। অনেকগুলো টিভি ক্যামেরার সামনে ওই ঘটনা ঘটে।
এ নির্মম হত্যার দৃশ্য সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হলে ব্যাপক তোলপাড় শুরু হয়। হত্যার এক বছর পর ঢাকার দ্রুত বিচার টাইব্যুনাল ২১ জনের মধ্যে আটজনকে মৃত্যুদণ্ড এবং ১৩ জনকে যাবজ্জীবন সাজা দেন। ২০১৭ সালের ৬ আগস্ট মামলায় ডেথ রেফারেন্স এবং আসামিদের আপিলের ওপর শুনানি শেষে বিচারপতি মো. রুহুল কুদ্দুস ও বিচারপতি ভীষ্মদেব চক্রবর্তীর হাইকোর্ট বেঞ্চ দু’জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। চারজনের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন ও দু’জনকে খালাস দেন।
এছাড়া বিচারিক আদালতে যাবজ্জীবন সাজা পাওয়া আপিলকারী দু’জনকে খালাস দেয়া হয়। বিচারিক আদালতের সাজা কেন কী কারণে পুরোপুরি বহাল রাখা যায়নি, তার পূর্ণ ব্যাখ্যা ও পর্যালোচনা পূর্ণাঙ্গ রায়ে তুলে ধরেন হাইকোর্ট। রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেন, এ ভূখণ্ডে গৌরবোজ্জ্বল ছাত্র রাজনীতির বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের ইতিহাস রয়েছে। কিন্তু ছাত্র রাজনীতির নামে কিছু যুবক অপরাধ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। তাদের কারণে ছাত্র রাজনীতি মারাত্মকভাবে কলঙ্কিত হচ্ছে। হাইকোর্টের রায়ের পর আসামিদের কেউ কেউ আপিল করেন। সেটি এখনও কার্যতালিকায় আসেনি।
২০০৬ সাল থেকে ঢাকার শাঁখারী বাজারে বড় ভাইয়ের ‘নিউ আমন্ত্রণ টেইলার্সে’ দর্জির কাজ করতেন বিশ্বজিৎ। তাদের বাড়ি শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার ভোজেশ্বর দাস পাড়ায়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিশ্বজিতের এক আত্মীয় জানান, ঘটনার পর থেকে তারা সব সময় আতঙ্কের মধ্যে আছেন। তিনি বলেন, আদালতের প্রতি আমাদের আস্থা আছে এবং আশা করি আপিল বিভাগের রায়েও আসামিরা শাস্তি পাবে।
সাত খুন মামলায় র্যাব-১১ এর সাবেক কোম্পানি কমান্ডার মেজর (অব.) আরিফ হোসেন ও বিশ্বজিৎ হত্যা মামলার এক আসামির আইনজীবী ছিলেন এসএম শাহজাহান। তিনি বলেন, খালাস চেয়ে আসামিদের পক্ষে আপিল করা হয়েছে। আদালতের নির্দেশে সারসংক্ষেপ জমা দেয়ার পর শুনানির জন্য তালিকায় আসবে। কবে নাগাদ শুনানি হবে তা বলতে পারছি না। এটা সম্পূর্ণ আদালতের এখতিয়ার।
ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল জাহিদ সারোয়ার কাজল যুগান্তরকে বলেন, আপিল বিভাগে মামলার চূড়ান্ত বিচার হবে। আপিল বিভাগে রায় বহাল থাকলে সত্যায়িত কপি যাবে সংশ্লিষ্ট বিচারিক আদালতে। এ ক্ষেত্রে আসামিরা রিভিউ (পুনর্বিবেচনা) আবেদন না করলে রায় কার্যকরের জন্য বিচারিক আদালত অনুলিপি কারাগারে পাঠাবেন। এরপর কারা কর্তৃপক্ষ জেলকোড অনুযায়ী রায় কার্যকর করবেন। তবে আসামিরা রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করার সুযোগ পাবে।