মেয়াদ ও ব্যয় দুটোই বাড়ছে পদ্মা সেতু প্রকল্পে

0
609
মেয়াদ ও ব্যয় দুটোই বাড়ছে পদ্মা সেতু প্রকল্পের
নির্মাণাধীন পদ্মা সেতু। ছবিঃ সংগৃহীত।

খবর৭১ঃ

সেতু বিভাগের হিসাবে, জুন পর্যন্ত পদ্মা সেতুর কাজের সার্বিক অগ্রগতি ৭১ শতাংশ। এর মধ্যে মূল সেতুর কাজ হয়েছে ৮১ শতাংশ। নদীশাসনের কাজ এগিয়েছে ৫৯ শতাংশ। মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তে সংযোগ সড়ক ও অবকাঠামো নির্মাণের কাজ শেষ হয়েছে। এই অগ্রগতি গত সাড়ে চার বছরের। কাজ শেষ করার সময়সীমা এ বছরের ডিসেম্বর। সে হিসাবে, বাকি ২৯ শতাংশ কাজ শেষ করতে হবে সাত মাসে, যা অসম্ভব বলে মনে করছেন সেতু বিভাগের কর্মকর্তারা।

পদ্মা সেতু প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় আবারও বাড়ছে। এ দফায় ব্যয় বাড়তে পারে ১ হাজার কোটি টাকা। আর মেয়াদ বাড়ানো হবে এক না দুই বছর, তা পর্যালোচনা করছে প্রকল্প কর্তৃপক্ষ। মূল সেতুর কাজের গতি ভালো। তবে নদীশাসনের কাজের গতি খুবই মন্থর। তাই ঠিকাদারেরা প্রকল্পের মেয়াদ আরও অন্তত দুই বছর বাড়ানোর পক্ষে। সরকার অবশ্য একবারে এক বছরের বেশি বাড়াতে চায় না।

মূল সেতু নির্মাণের কাজ করছে চীনের চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি। আর চীনেরই সিনো হাইড্রো করপোরেশন করছে নদীশাসনের কাজ। তাদের সঙ্গে চুক্তি হয় ২০১৪ সালের শেষের দিকে। চার বছরের মধ্যে কাজ শেষ করতে সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। সে অনুযায়ী, গত বছর ডিসেম্বরেই সেতু যানবাহন চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল সরকার। পরে সময় এক বছর বাড়ানো হয়।

সেতু বিভাগ সূত্র জানায়, মূল সেতু ও নদীশাসনের কাজের সময়সীমা বাড়ানো নিয়ে ঠিকাদার ও সেতু বিভাগের মধ্যে প্রতিনিয়তই চিঠি চালাচালি হচ্ছে। চায়না মেজর ব্রিজ গত বছরের শেষের দিকে ২০২১ সালের জুনে মূল সেতুর কাজ শেষ করার কর্মপরিকল্পনা দেয়। তবে সেতু বিভাগ তা অনুমোদন করেনি। তারা গত মে মাসের মধ্যেই কাজ শেষ করার সময়সীমা বেঁধে দেয়। অন্যদিকে সিনো হাইড্রো করপোরেশন ২০২১ সালের জুলাইয়ের মধ্যে নদীশাসনের কাজ শেষ করার সময়সীমা দাবি করে। কর্তৃপক্ষ শর্ত সাপেক্ষে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত সময় বাড়ায়।

সাধারণত ঠিকাদারেরা প্রথমে প্রকল্পের সময় ও ব্যয় বৃদ্ধির দাবি করে। তা পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হয়ে প্রকল্প কর্তৃপক্ষের কাছে যায়। শেষ পর্যন্ত চূড়ান্ত অনুমোদন দেয় পরিকল্পনা কমিশন। এখন পর্যন্ত সময় ও ব্যয় কী পরিমাণ বাড়ানো হবে, এই আলোচনা সেতু বিভাগ পর্যন্তই আছে। পরিকল্পনা কমিশনে উঠবে ডিসেম্বরের আগে।

মেয়াদ ও ব্যয় দুটোই বাড়ছে পদ্মা সেতু প্রকল্পের

বাড়ছে প্রকল্পের ব্যয়

প্রকল্পের মেয়াদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ব্যয়ও বেড়েছে। দুই দফা প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) সংশোধনের পর ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ইতিমধ্যে বেশ কিছু খাতে ব্যয় বেড়ে গেছে। আরও নতুন ব্যয়ের খাত যুক্ত হয়েছে।

প্রকল্প সূত্র বলছে, বাজেটে ঠিকাদারের ভ্যাট ও আয়কর ৪ শতাংশ বেড়েছে। বিদেশি পরামর্শকদের ভ্যাট ও কর বেড়েছে ১০ শতাংশ। দেশীয় পরামর্শকদের ভ্যাট ও কর বেড়েছে ২ শতাংশ। এই তিন খাতে ভ্যাট ও কর বাবদ ব্যয় বৃদ্ধির পরিমাণ ৬৮৬ কোটি টাকা। চুক্তির অতিরিক্ত কাজ করার দাবিতে ইতিমধ্যে মূল সেতু ও নদীশাসনের ঠিকাদার প্রায় ১৬০ কোটি টাকার বাড়তি বিল দাবি করেছে। সেটা আরও বাড়তে পারে। জাজিরা প্রান্তে ফেরিঘাট সরাতে ২০০ কোটি টাকা লাগতে পারে।

বছর বছর পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি পেলে ঠিকাদারকে বাড়তি টাকা দিতে হয়। এ জন্য পদ্মা সেতু প্রকল্পে সাড়ে চার শ কোটি টাকা ধরা আছে। তবে প্রকল্পের মেয়াদ যেভাবে বাড়ছে, তাতে এই টাকায় কুলাবে না বলে মনে করছেন প্রকল্প কর্মকর্তারা। নদীর তলদেশের মাটির জটিলতার কারণে মাঝনদীতে ১৪টি খুঁটির (পিলার) নিচে একটি করে পাইল বেশি বসানো হয়েছে। যুক্তরাজ্যের একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করে খুঁটি সমস্যার সমাধান এবং সেই অনুযায়ী নকশা সংশোধন করা হয়েছে। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ও বাড়তি পাইলের খরচ আগে ধরা ছিল না। প্রকল্পের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, পদ্মা সেতু প্রকল্পে কয়েক শ উপকরণ (আইটেম) লাগবে। এখন পর্যন্ত কোনো উপকরণের দামে বড় পরিবর্তন হয়নি। এর মধ্যে ভ্যাট–কর ও বাড়তি কাজের কারণে গত এক বছরেই প্রকল্পের ব্যয় প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা বেড়ে গেছে। সময় যত যাবে নতুন নতুন ব্যয় যুক্ত হওয়া অস্বাভাবিক নয়।

২০০৭ সালে একনেকে ১০ হাজার ১৬১ কোটি ৭৫ লাখ টাকার প্রকল্প অনুমোদিত হয়। ২০১১ সালে ব্যয় বাড়িয়ে করা হয় ২০ হাজার ৫০৭ কোটি ২০ লাখ টাকা। ২০১৬ সালে ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি হয়ে যায়। ২০১৮ সালে বাড়তি যুক্ত হয় আরও ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। গত মে পর্যন্ত মোট খরচ হয়েছে ১৯ হাজার ১৫৩ কোটি টাকা।

মেয়াদ ও ব্যয় দুটোই বাড়ছে পদ্মা সেতু প্রকল্পের

মূল সেতুর কাজ এগোচ্ছে, আছে চ্যালেঞ্জঃ

মূল সেতু দৃশ্যমান করতে একের পর এক স্প্যান বসছে। এখন পর্যন্ত খুঁটির ওপর ১৩টি স্টিলের কাঠামো (স্প্যান) বসেছে। প্রতিটির দৈর্ঘ্য ১৫০ মিটার। সে হিসাবে এখন পর্যন্ত সেতু দৃশ্যমান হয়েছে প্রায় ২ কিলোমিটার। পদ্মা সেতুর মোট দৈর্ঘ্য ৯ দশমিক ৩০ কিলোমিটার। এর মধ্যে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার পানিতে, যা ৪১টি স্প্যান দিয়ে যুক্ত হবে। বাকিটা ডাঙায়, রড–কংক্রিট দিয়ে তৈরি হবে। যা ভায়াডাক্ট নামে পরিচিত।

পদ্মা সেতু দ্বিতলবিশিষ্ট। নিচতলায় অর্থাৎ স্টিলের স্প্যানের ভেতর দিয়ে রেল চলবে। মিটারগেজ ও ব্রডগেজ দুই ধরনের ট্রেনই চলতে পারবে। আর ওপর দিয়ে চলবে যানবাহন। এ জন্য স্টিলের কাঠামোর ওপরে কংক্রিটের স্ল্যাব বসাতে হবে। ওপরের এই অংশ চওড়ায় ২২ মিটার, চার লেনের সড়কের সমান। এ ছাড়া সেতু দিয়ে ৭৬০ মিলিমিটার ব্যসের গ্যাসের পাইপলাইন বসানোর কথা রয়েছে। ১৫০ মিলিমিটার ব্যসের ফাইবার অপটিক ও টেলিফোন লাইনের পাইপের ব্যবস্থা রয়েছে।

নদীশাসনে অত্যধিক সময় লাগছেঃ 

ঠিকাদারের সঙ্গে চুক্তি অনুসারে, নদীশাসনের অংশ হিসেবে প্রায় ৬ কোটি ঘনমিটার খনন (ড্রেজিং) করার কথা। তবে মে পর্যন্ত হয়েছে ৩ কোটি ঘনমিটারের কম। ২ কোটি ১১ লাখের বেশি বিভিন্ন আকারের জিও ব্যাগ বসানোর কথা। এখন পর্যন্ত জিও ব্যাগ বসানো হয়েছে ৫৮ লাখের কিছু বেশি। নদীর তলদেশে ফেলা এবং পাড়ে বসানোর কথা ১ কোটি ৩৩ লাখ কংক্রিটের ব্লক। এখন পর্যন্ত ৩৫ লাখের কম ব্লক ফেলা ও বসানো হয়েছে। ১০ লাখের বেশি ঘনমিটার পাথ নদীতে ফেলার কথা রয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত ব্যবহার হয়েছে ৩ লাখেরও কম।

পদ্মা সেতু প্রকল্পের বিশেষজ্ঞ দলের প্রধান অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেন, ২০২০ সালের মধ্যে মূল সেতুর কাজ শেষ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। নদীশাসনের কাজ হয়তো এক বছর বেশি লাগবে। ফলে নদীশাসন সম্পূর্ণ না করেও সেতু চালু করা সম্ভব। এটা নিয়ে তাঁরা উদ্বিগ্ন নন।

মূল সেতুর ঠিকাদারও তো ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত সময় চেয়েছে। তাহলে ২০২০ সালে কীভাবে সেতু চালু করা যাবে? এমন প্রশ্নে জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেন, ২০২০ সালের ডিসেম্বরের পর ঠিকাদারদের আর সময় দেওয়া হবে না।

মেয়াদ ও ব্যয় দুটোই বাড়ছে পদ্মা সেতু প্রকল্পের

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here