মেধাবী হেলাল কী পারবে দারিদ্রের বাঁধা টপকে স্বপ্ন পূরণ করতে ?

0
276

শেরপুর থেকে আবু হানিফ :
অনেক কষ্ট-যাতনা, টানাপোড়েনের মধ্যেও এবারের এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়ে স্বপ্নের সিঁড়ি বেয়ে এগিয়ে চলেছে হেলাল উদ্দিন। তৃতীয় শ্রেনীতে পড়াকালীণ সময়ে বাবা-মা’র ছাড়াছাড়ি (বিবাহ-বিচ্ছেদ) তাকে দমাতে পারেনি। নানা’র কাছে থেকে চালিয়ে গেছে পড়ালেখা। পঞ্চম এবং অস্টম শ্রেনীতেও সে টেলেন্টপুলে বৃত্তিসহ জিপিএ-৫ পেয়েছিলো। সেই বৃত্তির টাকাতেই চলেছে তার লেখাপড়া। শেরপুরে নালিতাবাড়ী উপজেলার সীমান্তবর্তী পোড়াগাঁও আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হওয়া হেলাল উদ্দিনের স্বপ্ন বড় হয়ে প্রকৌশলী হবে। প্রকৌশলী হয়ে সৎভাবে, দেশের জন্য, মানুষের জন্য কাজ করবে। এতদিন নানা বাড়ীতে থেকে খেয়ে-না খেয়ে দাঁতে দাঁত চেপে হেলাল লেখাপড়া চালিয়ে গেলেও এখন কলেজে ভর্তি হওয়া নিয়ে মাথায় ভর করেছে দারুণ দুশ্চিন্তা। স্কুল পর্যায়ে পড়তে কোন আর্থের প্রয়োজন হয়নি। কিন্তু কলেজে ভর্তি, শহরে থাকা-খাওয়া সহ লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া তার জন্য কঠিন। মেধাবী হেলাল কী পারবে দারিদ্রের বাঁধা টপকে স্বপ্ন পূরণ করতে?
দরিদ্র মেধাবী হেলাল উদ্দিনের সাথে কথা বলে জানা যায়, তার বাবা-মা বেঁচে থাকলেও সে তাদের ¯েœহ-ভালোবাসা বঞ্চিত। বাবা তার কোন খোঁজখবরই নেয়না। মা বছরে হঠাৎ কোনসময় যোগাযোগ রাখলেও সেভাবে খোঁজখবর নেয়না। সে যখন তৃতীয় শ্রেনীর ছাত্র তখন থেকেই তার বাবা-মা’র মাঝে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। তারপর থেকেই সে নানা-নানীর সাথে নানাবাড়ীতে থাকে। বাবার বাড়ী বরিশাল বিভাগের ভোলায় হলেও সেখানে কখনো তার যাওয়া হয়নি। ঢাকার মীরপুরে পল্লবীর একটি গার্মেন্টসে চাকুরীর সুবাদে তার বাবা-মা’র পরিচয় সূত্রে বিয়ে হয়েছিলো। ২০১১ সালে তাদের বিচ্ছেদ ঘটে। বাবা ওমর ফারুক পরে অন্যত্র বিয়ে করেছেন। মা হেলেনা আক্তারও অন্য আরেকজনকে বিয়ে করে নারায়নগঞ্জে সংসার পেতেছেন। নানা হযরত আলীর বাড়ী ভিটা ছাড়া অন্য কোন আবাদী জমি নেই। কিছু জমি বর্গা চাষ করেন। মামা মিরাজ আলম গাজীপুরে একটি গার্মেন্টসে শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। সেই মামার আয় থেকে দেয়া কিছু টাকা, আর বর্গাচাষের আয় থেকেই চলে তার নানার সংসার। মাছ-মাংস ওভাবে খাওয়া হতো না, দুধ-ডিমও মিলতো না। সকালে না খেয়েও কখনো কখনো স্কুলে যেতে হয়েছে। খালাতো আরেক ভাইয়ের সাথে ছোট একটি টেবিলে বলে পড়াশুনা করতে হয়েছে। নানা-নারীর সাথে ঘুমুতে হতো ছোট একটি ভাঙাচোড়া চৌকিতে। কুপিবাতির আলোয় চলতো লেখাপড়া। বছরখানেক হলো নানাবাড়ীতে বিদ্যুতের সংযোগ লাগায় যা কিছুটা আলো বেড়েছে। কিন্তু তারপরও নানা তাকে লেখাপড়ার সাহস যুগিয়েছেন, উৎসাহ দিয়েছেন। কখনো তাকে মনোবল হারাতে দেননি। সর্বদা আগলে রেখেছেন। সেই নানাই তার মা-বাবা। নানা তাকে মা-বাবার মতো আদর করেছেন, শাসন করেছেন। তার কারণেই সে আজ এমন চমকপ্রদ ফলাফল করতে পেয়েছেন বলে জানান হেলাল উদ্দিন।
একইসাথে শাহীন মিয়া নামে এক সেনাসদস্যের কথা স্মরণ করে হেলাল বলেন, অস্টম শ্রেনীর পর পড়াশোনা বাদ দিতে চেয়েছিলাম। গার্মেন্টসে চলে যেতে চেয়েছিলাম। শাহীন সাহেব তখন ‘মেন্টাল সাপোর্ট’ (মানসিক সহযোগিতা) দিয়েছেন। খাতা-কলম দিয়ে সহায়তা করেছেন। এসএসসি পরীক্ষার আগে নন্নী শার্ক আইডিয়াল একাডেমীতে কোচিংয়ের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। তাছাড়া স্কুল কর্তৃপক্ষ পড়াশোনাকালে আমার কোন বেতন-ভাতা, ফিস নেননি। যার কারণে আমার পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়েছে।
‘কষ্ট লাগে বাবা-মা নাই। ভাগ্যে আমার এমন কেন। জেদ চাপে, আমাকে বড় হতে হবে। বাবা-মা’কে দেখিয়ে দিতে হবে। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। বাবা-মা’র ছাড়াছাড়ি উচিত নয়। যারা এরকম করে, তাদের সন্তানরা খুব কষ্ট পায়।’ নানাবাড়ীর আঙিনায় বসে কথাগুলো বলার সময় চোখে পানি ছলছল করছিলো হেলালের। সে জানায়, আমার লেখাপড়ার জন্য কেউ এগিয়ে এলে ভালো হবে। আসলে ‘হেল্প’ (সহায়তা) ছাড়া আমার পক্ষে উচ্চ শিক্ষা সম্ভব নয়।
হেলাল উদ্দিনের নানা হযরত আলী বলেন, আমারতো বাড়ীভিটা ছাড়া আর কিছু নাই। পুলায় (ছেলে) গার্মেন্টসে কাম কইরা মাসে মাসে কিছু ট্যাহা পাডায়, ওই ট্যাহাতেই কোনমতে সংসারডা চলে। এতদিন বাড়ীতে থাইক্কা, কোনমতে খাইয়া-না খাইয়া হেলালের লেহাপড়াডা চলছে। অহনতো তারে কলেজে ভর্তি অওয়ন নাগবো, শহরে থাহুন নাগবো, ট্যাহা পামু কই। খুব চিন্তার মইদ্যে আছি। কেউ তার লেহাপড়াডার সাহায্য করলে খুব বালা অইতো। ছোরাডার (ছেলেটার) মুনের আশাডা পুরা অইতো।
শিক্ষা সহায়তাদানকারী দরিদ্র-অসহায় শিক্ষার্থী সংস্থার (ডপস) প্রতিষ্ঠাতা সেনাসদস্য শাহীন মিয়া বিএসপি জানান, হেলালের জীবনটা অনেক কষ্টের, অনেক সংগ্রামের। তার স্বপ্ন আছে, ইচ্ছা-একাগ্রতা-অধ্যবসায় আছে। উচ্চ শিক্ষার জন্য একটু সহায়তা পেলে তার জীবনটা বদলে যেতে পারে। আমরা সহযোগিতা দিয়ে তাকে মাধ্যমিক পর্যন্ত নিয়ে এসেছি। বিশ্বাস করি, কলেজে পড়াশোনার ক্ষেত্রে সহায়তা পেলে সে ভালো ফলাফল করতে পারবে এবং তার স্বপ্নপূরণে আরো একধাপ এগিয়ে যাবে। পোড়াগাঁও আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুল হামিদ বলেন, হেলাল খুবই মেধাবী। সবসময় ১/২-এর মধ্যেই তার রোল নম্বর থাকতো। আমরা তাকে বিনামূল্যে পড়িয়েছি। আমার বিশ্বাস সহযোগিতা পেলে হেলাল নিজের লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে। তার লক্ষ্য পূরণে বিত্তবানদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানাচ্ছি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here