নড়াইলে অর্থের বিনিময়েও মিলছে না শ্রমিক শ্রমিক সংকট ও কালবৈশাখীর তান্ডবে ফসলহানির শঙ্কায় কৃষকরা

0
270

উজ্জ্বল রায়, নড়াইল জেলা প্রতিনিধি:দিন-রাত হাড়ভাঙ্গা খাটুনির ফলে কৃষকের ঘরে গোলা ভরা ধান আসে। কিন্তু চিরন্তন এই সত্য যেন এবার শঙ্কার মধ্যে রয়েছে। অনেক কষ্টে সৃষ্টে ফসল ফলালেও তা ঘরে তুলতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন নড়াইলের কৃষকেরা। কারণ বাড়তি পারিশ্রমিক দিয়েও মেলানো সম্ভব হচ্ছে না কাঙ্খিত শ্রমিক। আর এর ফলে নিজ হাতে ফলানো সোনার ফসলকে অনেক কৃষকই গলার কাটা মনে করছেন। শ্রমিক সংকটের সুযোগে পৌর শহরসহ বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলের অধিকাংশ চা দোকানি, ভ্যানচালক এমনকি গরিব শিক্ষার্থীরাও ধান কেটে বাড়তি রোজগার করছেন। নড়াইল জেলা অনলাইন মিডিয়া ক্লাবের সভাপতি উজ্জ্বল রায় ও সাধারণ সম্পাদক মোঃ হিমেল মোল্যা পরিদর্শন করে দেখতে পান, ধান পেকে যাওয়া এবং আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ক্ষেত থেকে ঘরে তোলার জন্য রাতদিন সময় পার করছেন চাষিরা। ধানকাটা মৌসুমের শুরুতে বাজার দর কিছুটা হলেও ভালো থাকায় চাষিরা আশার আলো দেখতে শুরু করেন। কিন্তু সে আশার আলো দেখতে না দেখতেই হঠাৎ করেই যেন ম্লান হয়ে পড়েছে। ধানকাটার শেষ পর্যায়ে বর্তমান শ্রমিকের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। তারপরও কিছু সংখ্যক পাওয়া গেলেও মজুরি দ্বিগুণ দিয়ে ধান ঘরে তুলতে বাধ্য হচ্ছেন। এদিকে দূর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে ন্যায্য মূল্য না পাওয়ায় লোকসানের মুখে পড়েছেন বর্গাচাষীরা। লোকসানের বোঝা কাঁধে পড়ায় সোনালী হাসির পরিবর্তে চরম হতাশায় নড়াইলের চাষীরা। কেউ গোয়ালের গরু, কেউ হাঁস-মুরগী বিক্রি করে আবার কেউ বিভিন্ন এনজিও সংস্থা থেকে আবার কিছু কৃষক সুদের উপর টাকা নিয়ে ধান চাষ করেন। প্রথম দিকে আবহাওয়া অনুকুলে থাকায় এবং তেমন কোন রোগবালাই না হওয়ায় জমিতে এবছর খুব ভাল ধান হয়েছিল। ঠিক যে সময় কৃষকরা ধান কেটে ঘড়ে তুলবে সেই সময়েই নেমে আসে দূর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া। ভারী বৃষ্টিপাত, দমকা হাওয়ার সাথে পরতে থাকে শিলাবৃষ্টি। এতে নড়াইলের কৃষকরা চরম আতংক আর উৎকণ্ঠার মধ্য দিয়ে ধান ঘড়ে তুলতে থাকে। ঝড়ো হাওয়া আর বৃষ্টির কারণে অধিকাংশ জমির ধান মাটিতে পড়ে পানিতে একাকার হয়ে যায়। এছাড়াও ভারি বৃষ্টিপাতের কারণে এলাকার প্রায় শতাধিক হেক্টর জমির পাকা ধান পানির নিচে তলে যায়। এতে কৃষকরা আরো বেকায়দায় পড়ে যান। ধানগুলো ভিজা থাকার কারণে বাজারে ন্যায্য মূল্যে বিক্রি করতে পারছেন না কৃষকরা। এতে ধান বিক্রি করে জমির মালিকরা কিছু লাভবান হলেও লোকসানের মুখে পড়েছেন বর্গাচাষীরা। বর্গাচাষিদের সোনালী স্বপ্নের পরিবর্তে ঋণের বোঝা ঘাড়ে চাপায় তারা বর্তমানে চরম হতাশা ও দিশেহারা হয়ে পরেছেন। বুধবার (৯ মে) সরেজমিনে নড়াইলের বিভিন্ন উপজেলা ঘুরে দেখা গেছে, কৃষকের স্বপ্ন যেন গুড়েবালি হয়েছে কালবৈশাখী ঝড়ে। ধান পরিপুষ্ট হয়ে পাকার আগেই মাটিতে পড়ে যাওয়ায় ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ফলে বাধ্য হয়েই ধান কাটতে হচ্ছে কৃষকদের। সময়ের আগে ধান কাটার ফলে ফলন বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন তারা। আবহাওয়ার এ অবস্থায় একই সঙ্গে মাঠে ফসল কাটা শ্রমিকেরও সংকট দেখা দিয়েছে। ফলে বাধ্য হয়ে বেশি দামে শ্রমিক দিয়ে ধান কাটতে হচ্ছে কৃষকদের। নড়াইল সদর উপজেলার চাঁচড়া গ্রামের কৃষক জাবের মোল্যা ও বাহিরগ্রামের মনিরুল শেখ জানান, এ উপজেলার বেশির ভাগ জমিতে আগাম জাতের ধানের চাষ করা হয়েছে। ধান কাটতে এখনো ১০/১৫ দিন বাকি। বৃষ্টি ও বাতাসের কারণে ধানগাছ মাটিতে শুয়ে পড়েছে। এতে ফলন বিপর্যয়সহ প্রতি বিঘায় প্রায় চার/পাঁচ মণ ধান কম হবে। এতে লোকসানের আশঙ্কা করছেন কৃষকেরা। মিরাপাড়া গ্রামের চাষি কুমুদ হালদার জানান, বাজার দর ভালো হলে কী হবে- ক্ষেত থেকে ধান ঘরে তুলতে শ্রমিকের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। আর যা পাওয়া যাচ্ছে তা আবার দ্বিগুণ হারে মজুরি দিয়ে কাজ করাতে হচ্ছে। আরাজি কলিমন গ্রামের কৃষক সলেমান কাজী জানান, সকাল ৮টা থেকে বেলা সাড়ে ১২টা পর্যন্ত একজন শ্রমিককে দিতে হচ্ছে ৫০০-৬০০ টাকা। আবার বিকাল ৩টা থেকে ৫টা পর্যন্ত দিতে হচ্ছে ৩০০ টাকা। শ্রমিক সংকটের কারণে পৌর শহরসহ বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলে বিশেষ করে অধিকাংশ চায়ের দোকানদার, ভ্যানচালক এমনকি গরিব শিক্ষার্থীরাও বাড়তি রোজগারের আশায় ধানকাটার কাজ করছেন। পৌর শহরের দক্ষিণমাথার চা দোকানি সিরাজুল ইসলাম জানান, সারা দিন চা বিক্রি করে ৫০০ টাকা রোজগার করা সম্ভব হচ্ছে না। অথচ ৭-৮ ঘণ্টা ধান কেটে ৮০০-৯০০ টাকা রোজগার করা যাচ্ছে। অপরদিকে নড়াইলে ধান কাটা, ঝাড়া ও মাড়াই শুরু হওয়ায় নড়াইল জেলার তুলারামপুর, মাইজপাড়া, চাঁচুড়ী, বাঁশগ্রামসহ বিভিন্ন এলাকায় প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বসে শ্রম বাজার। প্রতিদিন এখানে বসে কৃষক মজুরের এই হাট, চলে পুরো ধানের মৌসুম ধরে। এ সময় শ্রম বাজারে ক্ষেত মালিক ও শ্রমিকদের মধ্যে বেচাকেনার ধুম পড়ে। ক্রেতা মিললে চলে দর কষাকষি, বনিবনা হলে পেয়ে যান কাজ। এ বছর ধানের আবাদ বেশী হওয়ায় চাহিদা অনুযায়ী স্থানীয় শ্রমিক না পাওয়া জমজমাট এ শ্রম বাজার। গত বছরের তুলনায় এ বছর শ্রমিকের মূল্য বেশী দিতে হচ্ছে ক্ষেত মালিকদের। সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, এ বছর প্রয়োজনের তুলনায় ধান কাটার জন্য শ্রমিক (কামলা) পাওয়া যাচ্ছে না। নড়াইলের অসংখ্য ধান ক্ষেত মালিককে তাদের কষ্টের উৎপাদিত পাকাধান দ্রুত ঘরে তোলার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। কেউ কেউ আবার নগদ টাকা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এই ধান কাটার শ্রমিক। ধান কাটা, বাঁধা, মাড়াই করা বাবদ বিঘা প্রতি ৩৫০০-৫০০০ টাকা, আবার কেউ কেউ ৫০০-৭০০ টাকা দিন প্রতি চুক্তিতে বিক্রি হচ্ছে। তুলারামপুর কামলারহাটে ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে শ্রমের এই বাজার। তবে এ হাটে বাহিরের শ্রমিক কিনতে এসে প্রতিযোগিতা করে অন্যের তুলনায় বেশী টাকা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তাদের ধান কাটার শ্রমিক। লবণাক্ততার কারণে ধান চাষ কম হওয়ায় এবং কাজ না থাকায় সাতক্ষীরা ও খুলনা জেলার বিভিন্ন অঞ্চলের শ্রমিকরা এ হাটে শ্রম বিক্রি করতে আসে। সাতক্ষীরা জেলার কালিগঞ্জের শ্রমিক কুদ্দুস শেখ জানান, লবণাক্ততার কারণে আমাদের এলাকায় ধান চাষ কম হয়েছে। তাই এ সময় কোনো কাজ থাকে না। এই অবসর সময়ে কিছু বাড়তি টাকা উপার্জন করতে মৌসুম ভিত্তিক শ্রমিক হিসাবে আমরা নাভারণ কামলারহাটে বিক্রির জন্য এসেছি। নড়াইলের বনগ্রাম এলাকার শ্রমিক কিনতে আসা কৃষক ছমির মোল্যা বলেন, এলাকায় শ্রমিক কম থাকায় এবং স্থানীয়রা বিভিন্ন মালিকের নিকট থেকে কাজ হাতে নেওয়ায় সঠিক সময়ে কাজ করতে পারে না। তাই অন্য জায়গা থেকে শ্রমিক আনলে ঝড়-বৃষ্টিতে ধান কম ভেজে, সময়মত তা গুছানো হয়ে যায়। নড়াইল সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা এ প্রতিবেদক উজ্জ্বল রায়কে জানান, এ বছর নড়াইল সদর উপজেলার অনেক জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে এবং খুবই বাম্পার ফলন হয়েছে। যা গত বছরের তুলনায় অনেক বেশি বেশী। এমতবস্থায় আমাদের শ্রমিকের কৃত্রিম সংকট দেখা দিয়েছে। যার জন্য বাইরের থেকে শ্রমিক আনতে হচ্ছে ধান কাটার জন্য।
খবর ৭১/ ই:

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here