খবর৭১ঃ
চিরুনিতে আটকে যাওয়ার চুলের সংখ্যা কি দিন-দিন বেড়েই চলেছে? বা চুল কি ইদানীং পাতলা হয়ে যাচ্ছে? তাহলে চুল পড়ার সমস্যায় ভুগছেন আপনি। ঘরে বসেই চুল পড়ার সমস্যার সমাধান জেনে নিনঃ
ছোটবেলায় মা বলতেন রাতে চুল বেঁধে শুতে যেতে। কিন্তু বিভিন্ন সিরিয়াল বা সিনেমার নায়িকাদের কোনওদিন চুল বেঁধে শুতে যেতে দেখিনি। ফলে মায়ের বকুনি সত্ত্বেও এলো চুলেই শুতে যেতাম। আবার চুলের সৌন্দর্য রক্ষার্থে প্রতিদিন তেল লাগানোও রীতিমতো এক কাজ ছিল। কিন্তু যত বড় হতে লাগলাম, তেল চুপচুপে চুলে স্কুল-কলেজ যাওয়াও ততই দুর্বিসহ হয়ে উঠতে লাগল। ফলে সে গুড়েও বালি পড়ল। সপ্তাহে দু’দিন শ্যাম্পু আর কন্ডিশনারেই সব যত্নের ইতি টানলাম। এর ওপর চুলে রং, নানাবিধ যন্ত্রের যথেচ্ছ ব্যবহার তো রয়েইছে। চুল আর কী করে। অত্যাচার সহ্য করতে না পেড়ে, একে একে মূর্চ্ছা যেতে লাগল। ভাবছেন হঠাৎ নিজের গল্প কেন শোনাচ্ছি? আসলে চুলের ওপর এতদিন কী কী অত্যাচার হয়েছে সেটা আপনাদের মনে করিয়ে দিতেই নিজের শৈশব টেনে আনলাম। এই ঘটনাগুলো যে শুধু আমার ক্ষেত্রেই ঘটেছে, তা নয়। অনেকেই হয়তো আমার গল্প শুনে নিজের কথা ভাবছেন। তবে একমাত্র এই কারণেই যে চুল পড়ার সূত্রপাত, তা বলছি না। দেখতে গেলে চুল পড়ার অনেক কারণ থাকতে পারে। বংশগতি, শারীরিক সমস্যা, স্ট্রেস, খুশকি, অপুষ্টি, অযত্ন ইত্যাদি নানাবিধ কারণে চুল পড়তে পারে। কিছু সমস্যার সমাধান আমাদের হাতে নেই। তবে অপুষ্টি আর অযত্নের ক্রেডিট তো সম্পূর্ণই নিজের। তাই চুলের এই চিরন্তন সমস্যাকে গোড়া থেকে মিটিয়ে ফেলতে ঘরোয়া সমাধান নিয়ে হাজির সানন্দা। তবে ঘরোয়া সমাধানে যাওয়ার আগে সমস্যাটাকে একটু ভাল করে চিনে নেওয়া প্রয়োজন।
চুল পড়া—সমস্যা না স্বাভাবিক?
দেখুন, চুলের ধর্মই পড়া। তবে তার পরিমাণটা গুরুত্বপূর্ণ। সকালে ঘুম থেকে উঠে বিছানায় চারটে চুলের উপস্থিতি লক্ষ্য করলেন আর অমনি আর্তনাদে সারা বাড়ি কাঁপিয়ে দিলেন, অথচ জানলেনই না যে ওটা আর পাঁচটা সাধারণ ঘটনার মতোই স্বাভাবিক। সাধারণত দিনে ৫০ থেকে ১০০টা চুল পড়া স্বাভাবিক। কারণ প্রতিদিন এই সংখ্যাত চুল যেমন পড়ে, তেমনই নতুন চুলও গজায়। এটাই স্বাভাবিক সাইকেল। তার বেশি সংখ্যক চুল পড়লে অথবা চুলে চিরুনি ছোঁয়ালেই যদি চুল পড়তে থাকে, বা মাথার কোনও একটি নির্দিষ্ট অংশে যদি চুলের ঘনত্ব ক্রমশ কমতে থাকে, তাহলে বুঝবেন সমস্যা রয়েছে। চুলের ডগা ক্রমশ পাতলা হয়ে যাওয়াও চুল পড়ার একটি অন্যতম লক্ষণ। শারীরিক কোনও কারণ বা বংশগতির কারণে চুল পড়লে অবশ্যই কোনও ট্রাইকোলজিস্টের পরামর্শ নিন। খুশকি, অপুষ্টি এবং অযত্নের জন্য তো আমরা রয়েইছি।
খুশকির সমস্যায়ঃ
খুশকিরও নানা কারণ থাকতে পারে। ঘরোয়া সমাধান চাইলে লেবু, টি-ট্রি অয়েলের সাহায্য নিতে পারেন। তবে কোনওটাই সরাসরি চুলে ব্যবহার করবেন না। জলের সাহায্যে পাতলা করে অথবা অন্য কোনও প্যাকে মিশিয়ে চুলে লাগান। উপকার পাওয়া অবধি চালিয়ে যান। মেথি, ভিনিগার, হেনা, টকদই ইত্যাদিও খুশকির প্রতিকারে খুব ভাল কাজ করে।
অপুষ্টির প্রতিকারেঃ
চুলের পুষ্টি সম্পূর্ণ না হলে তো চুল পড়বেই। পুষ্টি ছাড়া তো যে কোনও কিছুই দুর্বল হয়ে পড়বে। ফলে চুলের গোড়ায় গলদ থাকলে, তাকে তো সেখানেই সমাধান করতে হবে। ঘরোয়া নানা উপাদান চুল শক্ত করতে অব্যর্থ। সেরকমই কিছু উপাদানের হদিশ দেব আজ।
নারকেলের দুধ: হেয়ার ব্রাশের সাহায্যে নারকেলের দুধ স্ক্যাল্পে লাগাতে পারেন। চুলে তোয়ালে জড়িয়ে ২০ মিনিট অপেক্ষা করুন। বাড়িতে নারকেলের দুধ বানানোর প্রক্রিয়া মোটামুটি সব গৃহিনীদেরই বাঁ হাতের খেল। আর ঝঞ্ঝাটও নেই। ২০ মিনিট পড়ে চুল ধুয়ে নিন। এরপর শ্যাম্পু করে নিলেই হবে। নারকেলের দুধ চুলের গোড়ায় আর্দ্রতা জোগায়। এছাড়া এই দুধে ভইটামিন ই, ফ্যাট, প্রোটিন, এসেনশিয়াল ফ্যাটি অ্যাসিডের মতো নানা উপকারী উপাদান মজুত রয়েছে যা চুল পড়া বা চুল ভেঙে যাওয়ার সমস্যায় কাজে আসবে। এতে চুল মজবুত হওয়ার পাশাপাশি চকচকে এবং মসৃণও হয়।
আমলকি: চুলের যত্নে আমলকির ব্যবহার সকলেই জানেন। এই কারণে ডায়েটেও অনেকেই আমলকি রাখেন। সেটা নিঃসন্দেহে ভাল। তবে চুলের গোড়াতেও সরাসরি আমলকির ব্যবহার চটজলদি চুল পড়া কমাতে সাহায্য করবে। শুকনো আমলকি নারকেল তেলে ফুটতে দিন। তেল যতক্ষণ না কালো হচ্ছে, ততক্ষণ তেল ফুটতে দিন। এই তেল ভালভাবে পুরো চুল তথা স্ক্যাল্পে মাসাজ করুন। ২০ মিনিট অপেক্ষা করে শ্যাম্পু করে নিন। অথবা আমলকির রস এবং আমলা পাউডার (শুকনো আমলকি গুঁড়ো করে নিন) সমপরিমাণে নিয়ে মিশিয়ে চুলে লাগান। এতে সামান্য লেবুর রসও মেশাতে পারেন। পুরো চুলে লাগিয়ে শুকিয়ে যাওয়া অবধি অপেক্ষা করুন। এরপর ধুয়ে শ্যাম্পু করে নিন।
জবাফুল: এই উপাদানের কথাও সকলেই জানেন। চুল মজবুত করতে সেই প্রাচীনকাল থেকেই জবাফুল ব্যবহৃত হয়ে আসছে। জবাফুলে রয়েছে ভিটামিন সি, ফসফরাস, রাইবোফ্ল্যাভিন এবং নানাবিধ এসনশিয়াল নিউট্রিয়েন্ট যা চুল মজবুত এবং মসৃণ করে। পাশাপাশি চুলের গোড়ায় জমে থাকা টক্সিন দূর করতে এবং রক্ত সঞ্চালন ভাল করে নতুন চুলের বৃদ্ধিতেও সাহায্য করে। নারকেল তেলে জবাফুল দিয়ে ফুটিয়ে নিন। ফুল পুরো ভাজা ভাজা হয়ে এলে, ছেঁকে বোতলে ভরে রেখে দিন। এই তেল ব্যবহার করতে পারেন। অথবা কয়েকটা জবাফুল বেটে তাতে খানিকটা তিলতেল অথবা নারকেল তেল মিশিয়ে নিন। এটি স্ক্যাল্পে এবং চুলে লাগিয়ে রাখুন কয়েক ঘণ্টা। সপ্তাহে দু’বার এই পদ্ধতি ব্যবহার করে দেখতে পারেন।
কারিপাতা: রান্নায় ফোড়ন হিসেবে তো ব্যবহার করেছেন। তবে চুল পড়া রোধ করতে এই ভূমিকা জানেন কি? চুল পড়া কমাতে এই পাতা দারুণ কার্যকরী। কারিপাতা ব্যবহার করে বানিয়ে ফেলতে পারেন হেয়ার টনিক। বেশ কিছু কারিপাতা তেলে ফুটিয়ে নিন। সেই তেল ব্যবহার করুন। মাসাজ করতে ভুলবেন না। সপ্তাহে দু’বার অন্তত এই তেল ব্যবহার করবেন।
পেঁয়াজ: চুল পড়া কমাতে তথা নতুন চুল গজাতে পেঁয়াজ অব্যর্থ। পেঁয়াজে উচ্চ পরিমাণে সালফার থাকায় তা রক্ত সঞ্চালন সঠিক রাখে। এছাড়া পেঁয়াজের নানাবিধ অ্যান্টি-ব্যাক্টেরিয়াল ক্ষমতাও বর্তমান যা স্ক্যাল্পের বিভিন্ন ইনফেকশন কমাতে সাহায্য করে। পেঁয়াজ গ্রেট করে রস বের করে নিন। এই রসে তুলে ভিজিয়ে স্ক্যাল্পে লাগাতে পারেন। চুলের গোড়া থেকে ডগা অবধি পুরো অংশ ভালভাবে লাগান। আধঘণ্টা এভাবে রেখে দিন। এরপর শুধু চুল ধুয়ে নিন অথবা শ্যাম্পু করে নিন। এছাড়া অন্যভাবেও পেঁয়াজ ব্যবহার করতে পারেন। ২ টেবলচামচ পেঁয়াজের রসে ১ চা-চামচ মধু এবং ১ চা-চামচ গোলাপজল মিশিয়ে নিন। এই মিশ্রণ চুলে লাগিয়ে ৪০ মিনিট রেখে দিন। সপ্তাহে একদিন চুলে পেঁয়াজের রস ব্যবহার করতে পারেন। তবে পেঁয়াজের রস লাগানোর সময় খেয়াল রাখবেন যেন চোখে বা অন্য কোনও আভ্যন্তরীন অঙ্গে তা না লাগে। যদি লেগে যায় অথবা কোনও জ্বালাভাব অনুভূত হয়, সেক্ষেত্রে সঙ্গে সঙ্গে জল দিয়ে ভালভাবে ধুয়ে ফেলুন।
নিত্যদিনের যত্নঃ
অপুষ্টি এবং খুশকি এই দুই সমস্যা বাদ দিলে বাকি থাকে যত্ন। চলুন, চুলের যত্ন অর্থাৎ প্রতিদিন চুলের জন্য ঠিক কী কী করণীয়, জেনে নেওয়া যাক।
- প্রতিদিন চুল আঁচড়ানোর দিকে নজর দিন। এতে স্ক্যাল্পে রক্ত সঞ্চালন ভাল হবে। দিনে অন্তত ২-৩ বার চুল আঁচড়ান। তবে ভিজে চুলে চিরুনি লাগাবেন না। একান্তই প্রয়োজন হলে বড় দাঁড়ার চিরুনি ব্যবহার করুন। কাঠের চিরুনি ব্যবহার করতে চেষ্টা করুন।
- শ্যাম্পু এবং কন্ডিশনার সপ্তাহে তিনবার ব্যবহার করলেই যথেষ্ট। প্রত্যেকবার শ্যাম্পু ব্যবহারের পর কন্ডিশনার ব্যবহার করতে ভুলবেন না।
- শ্যাম্পুর পর হেয়ার সিরামের ব্যবহারও গুরুত্বপূর্ণ। এতে চুলে জট পড়বে না, ফলে চুল আঁচড়াতে গেলে অযথা চুল পড়াও বন্ধ হবে।
- যেদিন শ্যাম্পু করবেন, তার আগেরদিন রাতে হট অয়েল মাসাজ করতে পারেন। ওপরে বলা যে কোনও একটি তেল মাসাজ করে গরম তোয়ালে জড়িয়ে রাখুন।
- চুল লম্বা হলে রাতে বেঁধে শুতে যাওয়াই শ্রেয়। ভালভাবে চুল আঁচড়ে পরিপাটি করে বেঁধে নিন। বিনুনি করতে না চাইলে পনিটেল বেঁধে শুতে যান।
- মাসে অন্তত একবার সামান্য বেকিং সোডা ব্যবহার করে স্ক্যাল্প হালকা হাতে ঘষুন। এতে স্ক্যাল্পে জমে থাকা পদার্থ দূর হবে।
- চুলে রং করলে ভাল ব্র্যান্ডের প্রডাক্ট ব্যবহার করুন এবং সঠিক যত্ন নিন। এছাড়া কোনও হিটিং টুলস ব্যবহার করলেও আগে হিট প্রোটেকট্যান্ট ব্যবহার করুন।
- হেয়ার স্প্রে, স্টাইলিং মুজ় যতটা সম্ভব কম ব্যবহার করুন। ব্যবহার করলে, তা ভালভাবে পরিষ্কার করাও প্রয়োজন। চুল ধুয়ে অল্প ভিনিগারে আরও একবার চুল ধুয়ে নিতে পারেন।
- মাসে একবার অথবা দু’মাসে একবার হেয়ার স্পা করান। এতে চুল ভাল থাকবে। চুল পড়াও বন্ধ হবে।