ঘুমের সমস্যা ও প্রতিকার

0
964
ঘুমের সমস্যা ও প্রতিকার

খবর৭১ঃ

সারাদিনের ক্লান্তি জুড়োতে প্রয়োজন ঘুমের। কিন্তু সেই ঘুমই যখন জীবন থেকে উধাও তখন দেখা দিতে পারে নানা সমস্যা। আসুন জেনে নিন ঘুমের সমস্যা ও প্রতিকার-

ইনসমনিয়া বা নিদ্রাহীনতা কী?

ইনসমনিয়া মানে নিদ্রাহীনতা। বা আরও সহজে বলতে গেলে ঘুমের পরিমাণগত বা গুণগত পরিবর্তন। ঘুম যদি কম হয় তাহলে  ইনসমনিয়া হতে পারে। আবার ঘুম থেকে ওঠার পর যদি এনার্জি না পান, তাহলেও বুঝতে হবে কাঙ্ক্ষিত ঘুম হয় নি। অর্থাৎ, আপনি হয়তো ইনসমনিয়ায় ভুগছেন। ঘুম আমাদের সারাদিনের ক্লান্তি দূর করে। তাই ভাল ঘুম না হলে সকালে ওঠার পর কোনও কাজেই এনার্জি পাবেন না। ঘুম আপনার কর্মক্ষমতা ও শরীরের পারফরমেন্স স্টেটাসকে আবার আগের দিনের জায়গায় ফিরিয়ে আনে। এটি ঘুমের অন্যতম প্রধান কাজ। কোনও কারণে এই কাজটিতে ব্যাঘাত ঘটলে এনার্জির অভাব ঘটে। ফলে, আপনি যতক্ষণই ঘুমোন না কেন, সারাদিনই একটা ঘুম-ঘুম ভাব বা ক্লান্তি থেকেই যায়। এটিও ইনসমনিয়ার লক্ষণ।

ইনসমনিয়া স্লিপ ডিজ়অর্ডারঃ

ইনসমনিয়া এক ধরনের স্লিপ ডিজ়অর্ডার। কিন্তু এছাড়াও ঘুমের নানা রকমের অসুবিধে হতে পারে। তাই, সব ধরনের স্লিপ ডিজ়অর্ডারই ইনসমনিয়া নয়। অনেকেই থাকেন যাঁরা দিনে ঘুমোন, কিন্তু রাতে ঘুমোন না। স্লিপ-ওয়েক সাইকলে ব্যাঘাতের জন্য এরকমটা হতে পারে। রাত জেগে পড়াশোনা করাটা যখন অভ্যেসে পরিণত হয়, তখন রাতে আর ঘুম আসতেই চায় না। আমাদের মস্তিষ্কের মধ্যে এক ধরনের বায়োলজিকাল ক্লক থাকে। সেই ঘড়ি এই অভ্যেসের সঙ্গে সঙ্গে মানিয়ে নেয় বলে সারকেডিয়ান রিদমে পরিবর্তন হয়। এই অভ্যেস যদি দীর্ঘস্থায়ী হয়, তাহলে শরীরের ক্ষতি হওয়া অবশ্যম্ভাবী। এটা এক ধরনের স্লিপ ডিজ়অর্ডার। ঘুমের মধ্যে অনেকে দুঃস্বপ্ন দেখেন। অনেকে আবার ঘুমের ঘোরেই হাঁটাচলা করেন (স্লিপ ওয়াকিং)। ঘুমের মধ্যেই কেউ কেউ হাত-পা নাড়ান (পিরিয়ডিক লেগ মুভমেন্ট ইন স্লিপ)। রেস্টলেস লেগ সিনড্রোমও হতে পারে। কারওর কারওর ঘুমের মধ্যেই এপিলেপ্সিও হতে পারে। এসবই স্লিপ ডিজ়অর্ডারের নানা রূপ।

ঘুমের সমস্যা ও প্রতিকার
ইনসমনিয়া ও স্লিপ ডিজ়অর্ডার।

ইনসমনিয়ার প্রকারভেদঃ

ইনসমনিয়া সাধারণত চার প্রকারের হতে পারেঃ

  • আর্লি ইনসমনিয়ার ক্ষেত্রে ঘুম আসতে সমস্যা হয়।
  • মিডল বা ইন্টারমিটেন্ট ইনসমনিয়ায় সঠিক সময়ে ঘুম এলেও রোগী মাঝরাতে ঘুম ভেঙে উঠে বসে। আবার কিছুক্ষণ ঘুমোনোর পরে ঘুম ভেঙে যায়। অর্থাৎ, মাঝেমাঝেই জেগে যান রোগী। অনেকক্ষেত্রে আবার একবার ঘুম ভেঙে এলে পুনরায় ঘুম আসতেও সমস্যা হয়।
  • টার্মিনাল বা লেট ইনসমনিয়ার ক্ষেত্রে খুব ভোরে ঘুম ভেঙে যায়। ধরুন, আপনি রাত দশটায় ঘুমোতে গেলেন। বিছানায় শুয়েই ঘুমিয়ে পড়লেন। অনেকক্ষণ নিরবচ্ছিন্ন ঘুম হল। কিন্তু ভোররাতে সাড়ে তিনটে কী চারটে নাগাদ জেগে গেলেন। পুনরায় আর ঘুম এলই না।
  • যদি উপরের তিনরকম অসুবিধেই একসঙ্গে দেখা দেয়, তাহলে সেই অবস্থাকে বলে টোটাল ইনসমনিয়া।

স্লিপ অ্যাপনিয়াঃ

ঘুমের মধ্যে হঠাৎ করে নিঃশ্বাসের কষ্ট হলে সেই অবস্থাকে ডাক্তারি পরিভাষায় বলে অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া। এই অবস্থায় রোগীর মনে হয় যে তাঁর নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। দশ সেকেন্ড থেকে এক মিনিট পর্যন্ত দম বন্ধ হতে পারে। শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা কমে গেলে এরকম হয়। ফলে, স্বভাবতই ঘুম ভেঙে যায়। যাঁরা ওবিস অর্থাৎ অত্যধিক মোটা, তাঁদেরই সাধারণত এই সমস্যা হয়।

ঘুমের সমস্যা ও প্রতিকার
স্লিপ অ্যাপনিয়া।

ঘুম না হওয়ার কারণ

ঘুম হল একটি শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া। মানসিক স্ট্রেস শর্ট টার্ম স্লিপ ডিজ়অর্ডারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ। একটা বিষয় মাথায় রাখতে হবে। আপনার ঘুমের প্যাটার্নে যে কোনও পরিবর্তনই কিন্তু স্লিপ ডিজ়অর্ডার নয়। ধরুন, আপনি গতকাল দু’ঘণ্টা ঘুমোলেন। কিন্তু পরেরদিন সকালে উঠে অন্যদিনের মতোই উদ্যমী হয়ে কাজ করছেন। আপনার রোজকার কাজে যদি ব্যাঘাত না ঘটে তাহলে অত চিন্তিত হওয়ার দরকার নেই। অনেক বছর পরে যদি এক রাতে আপনি স্বপ্ন দেখেন, তাহলেও ভাববেন না যে আপনার ঘুমের সমস্যা হচ্ছে। যদি এর প্রভাব আপনার কাজে পরে বা দীর্ঘদিন ধরে এরকম হতে পারে, তখনই তা স্লিপ ডিজ়অর্ডারের পর্যায়ে পড়তে পারে। জেটল্যাগের ফলে আমাদের বায়োলজিকাল ক্লকে পরিবর্তন হয়। ফলে, ঘুমের সময়েও ব্যাঘাত ঘটে। যাঁরা নাইট শিফটে কাজ করেন বা অন্য কোনও কারণে রাত জাগেন, তাঁদেরও ঘুমের সময়ের ঠিক থাকে না। ফলে সারকেডিয়ান রিদম ঘেঁটে যায়। আবার ওবিসিটির ফলে স্লিপ অ্যাপনিয়া হতে পারে। শরীরের কোনও অংশে ব্যথা হলেও ঘুমের ব্যাঘাত হতে পারে। স্ট্রেস ছাড়া জীবনযাত্রাও ইনসমনিয়ার জন্য দায়ী। রেস্টলেস লেগ সিনড্রোম অনেকের জিনগত কারণে হয়। আবার কিছু ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ফলেও এই সমস্যা হতে পারে। মহিলাদের ক্ষেত্রে মেনোপজ়ের পরে বা প্রেগনেন্সির সময়ে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটতে পারে। ঘুমের পরিবেশও বড় ফ্যাক্টর। অনেকে টি.ভি চালিয়ে ঘুমোতে পছন্দ করেন। আবার অনেকে কোনও শব্দ হলে ঘুমোতেই পারেন না। খুব গরম বা ঠান্ডা লাগলেও ঘুম আসতে চায় না। পাশের মানুষটির নাক ডাকা বা অত্যধিক জিনিসে ঠাসা বিছানাতে শুলেও ঘুম আসে না। কিছু কিছু সর্দিকাশির ওষুধ, স্টেরয়েড, ব্লাড প্রেশারের ওষুধ বা ইনহেলার অনেকসময় রাতে জাগিয়ে রাখে। ডিপ্রেশন, অ্যাংজ়াইটি, বাইপোলার ডিজ়অর্ডার, নেশা বা আসক্তি, অবসেসিভ কমপালসিভ ডিজ়অর্ডারের মতো সমস্যা থাকলেও স্লিপ ডিজ়অর্ডার হয়।

ঘুমের সমস্যা ও প্রতিকার
ঘুম না হওয়ার কারণ।

ডিপ্রেশনে ঘুম আসতে দেরি হয় বা ভোররাতে ঘুম ভেঙে যায়। অ্যাংজ়াইটিতে কিন্তু ঘুম আসতে দেরি হয় না। মাঝেমাঝে ঘুম ভেঙে যায়। বাইপোলার ডিজ়অর্ডারে রাতে তিন ঘণ্টা বা তার কম ঘুম হয়। কিন্তু তার এনার্জি থাকে বেশি। ঘুম না হওয়ার ফলে যদি আপনার শারীরিক বা মানসিক সমস্যা হয়, মনোসংযোগে বিঘ্ন ঘটে, গাড়ি চালাতে অসুবিধে হয়—তাহলে ডাক্তারের কাছে যাওয়া প্রয়োজন। এক-আধদিন ঘুম না হলে বা পিরিয়ডের আগে-পরে ঘুম না হলে ঘুমের ওষুধ খাবেন না। সন্তান জন্মের পরেও প্রথম দু’-তিন বছর ঘুমের ব্যাঘাত ঘটবে। তা নিয়েও চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই।
চিকিৎসা সমাধান

ইনসমনিয়ার সমাধানে স্লিপ হাইজিন মেনে চলা জরুরি। ঘুমের ব্যাঘাতের কারণটা সবার আগে খুঁজে বের করা প্রয়োজন। কারণ, স্লিপ ডিজ়অর্ডার সবক্ষেত্রেই অন্য কোনও অসুখের দোসর। ডিপ্রেশনের জন্য ঘুম না এলে একজন রোগী যদি অ্যালপ্রাজ়োলাম জাতীয় ওষুধ খান, তাহলে সাময়িকভাবে সমস্যাটাকে ধামাচাপা হয়তো দেওয়া যাবে। কিন্তু ডিপ্রেশনের চিকিৎসা এক্ষেত্রে হবে না। আবার ঘুমের সমস্যা পরে আরও বেড়ে যেতে পারে। ওষুধের উপর নির্ভরশীলতাও আজীবন থেকে যায়। রাত জাগার ফলে ব্লাড শুগার বাড়তে পারে গ্রোথ হরমোন সিক্রেশন কমতে পারে, ওজন বাড়তে পারে। ফলে, যাঁরা নাইট শিফটে কাজ করেন, তাঁদের দিনের বেলা এক্সারসাইজ় করা প্রয়োজন। ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। খাওয়াদাওয়ার দিকেও নজর দিতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে, ডায়াবিটিস যেন না বাড়ে। কিছু কিছু ঘুমের ওষুধ হ্যাবিট ফর্মিং। অর্থাৎ এগুলো খেলে আসক্তি জন্মায়। অ্যালপ্রাজ়োলাম জাতীয় ওষুধ একবার শুরু করলে হঠাৎ ছেড়ে দেওয়া খুব মুশকিল। হঠাৎ করে একদিন এই ওষুধ খাওয়া বাদ দিলে কনভালশন হতে পারে। নন-বেনজ়োডায়াজ়েপিন জাতীয় ওষুধের  কয়েকটাতে অতটা নির্ভরশীলতা জন্মায় না। ডাক্তারের পরামর্শ মতো জ়েড গ্রুপের কোনও ওষুধ খেতে পারেন। র‌্যামেলটিয়ন জাতীয় ওষুধ নির্দিষ্ট ডোজ়ে খেতে পারেন ঘুমের আধঘণ্টা আগে। তবে এক্ষেত্রেও ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন। যাঁরা অনেকদিন ধরে ঘুমের ওষুধ খেয়ে খেয়ে অভ্যস্ত, তাঁদের অভ্যেস ছাড়ানোর জন্য অনেকসময় অ্যান্টি এপিলেপ্টিক ড্রাগ দেওয়া হয়।

যাঁদের আর্লি ইনসমনিয়া আছে বা ঘুমোতে গেলে ঘুম না এলে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ুন। ঘুমের আগে টিভি দেখা, ল্যাপটপে কাজ করা বাদ দিন। বিছানার পাশে বসে গান শুনতে পারেন। বা বই পারতে পারেন। যদি খুব অস্বস্তি লাগে, তাহলে একবার স্নান করে নিতে পারেন। ঘুম না আসা পর্যন্ত বিছানায় যাবেন না। বিছানায় বসে টিভি দেখা, অফিসের কাজ করা বাদ দিন। রাতে ঘুম দুপুরে ঘুমোনোর তুলনায় অনেক বেশি জরুরি। চেষ্টা করুন রোজ একই সময়ে শুতে যেতে আর একই সময়ে ঘুম থেকে উঠতে। সকালে হালকা এক্সারসাইজ় করুন। তবে ঘুমোতে যাওয়ার আগে কোনওমতেই এক্সারসাইজ় করবেন না। খোলা হাওয়া আর সূর্যের আলোর নীচে রোজ কিছুক্ষণ কাটানো প্রয়োজন। সন্ধের পরে ক্যাফেন বা অ্যালকোহল যতটা পারবেন এড়িয়ে চলুন। পেটপুরে খেয়ে বা খালি পেটে ঘুমোতে যাবেন না।

ঘুমের সমস্যা ও প্রতিকার

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here