কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ওপর ফের ছাত্রলীগের হামলা

0
537

খবর৭১ঃ কৌশল পরিবর্তন করে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর ফের হামলা চালিয়েছে ছাত্রলীগ।

রোববার বিকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতিবাদ সমাবেশ শেষ করে ফেরার পথে এ হামলা চালানো হয়।

সারাদেশে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা-মামলা এবং বিভিন্ন ক্যাম্পাসে ছাত্র-শিক্ষক নিপীড়নের প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে ছাত্র সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছিল।

এদিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হামলাকারী ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে আন্দোলনকারীরা। এ সময় তাদেরকে পাল্টা ধাওয়া দেয় তারা।

এদিকে ৫ দফার আলোকে কোটা সংস্কারের প্রজ্ঞাপন প্রকাশ না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাবার ঘোষণা দিয়েছে শিক্ষার্থীরা। দাবি আদায়ে আগামী ২৫ জুলাই দেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে বিক্ষোভ সমাবেশের ঘোষণা দিয়েছেন তারা।

কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের প্ল্যাটফর্ম ‘বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক বিন ইয়ামিন মোল্লাহ এ ঘোষণা দেন।

অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘শিক্ষার পরিবেশ বিঘ্নিত করার অপপ্রয়াসের বিরুদ্ধে ‘সচেতন শিক্ষক সমাজ’ ব্যানারে মানববন্ধন করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামীপন্থী শিক্ষকরা।

কোটা সংস্কার করা, আন্দোলনে হামলাকারীদের বিচার, আটকৃতদের মুক্তি ও বিভিন্ন ক্যাম্পাসে ছাত্র শিক্ষকদের ওপর হামলার প্রতিবাদে রাজু ভাস্কর্যে বিকাল তিনটায় ছাত্র সমাবেশের ডাক দেয় আন্দোলনকারীরা।

সমাবেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কয়েকশ’ শিক্ষার্থী অংশ নেয়। সমাবেশে শিক্ষার্থীরা নিরাপদ ক্যাম্পাস, কোটা সংস্কার, হামলাকারীদের বিচার ও কোটা আন্দোলনের আটককৃতদের মুক্তির দাবি করেন। এ সময় সামবেশের আশে পাশে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা অবস্থান নেয়।

প্রায় সাড়ে পাঁচটার দিকে পরবর্তী কর্মসূচী ঘোষণা করেন যুগ্ম আহ্বায়ক বিন ইয়ামিন মোল্লা। এ সময় সাধারণ ছাত্র অধিকার পরিষদের যুগ্ম আহবায়ক মো আতাউল্লাহ, সোহরাব হোসেন, রাতুল সরকার উপস্থিত ছিলেন।

এদিকে সমাবেশ শেষে ফেরার পথে আন্দোলনকারীদের ওপর আবার হামলা চালিয়েছে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক আন্দোলনকারীকে মারধর করেন তারা।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, কর্মসূচী শেষ করে আন্দোলনকারীরা টিএসসির পাশে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময় হামলা চালায় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক দিদার মো. নিজামুল হকের নেতৃত্বে জিয়া হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল মাসুদ লিমনসহ বিভিন্ন হল শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা এতে অংশ নেন।

এ সময় ঘটনাস্থলে অন্তত ১৫ জন কেন্দ্রীয় নেতা ও ২০ জনের মতো বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের নেতাকেও দেখা যায়।

অন্যদিকে হামলা শেষে ফেরার পথে আন্দোলনকারীরা সংগঠিত হয়ে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের ধাওয়া দেয়। এ সময় তারা জিয়া হল ছাত্রলীগের কর্মসূচী ও পরিকল্পনা বিষয়ক সম্পাদক হাসিবুল হোসেন শান্তকে অবরুদ্ধ করে এবং কয়েকটি কিল-ঘুষি দেয়। পরে সে ঘটনাস্থল থেকে দৌঁড়ে পালায়।

অন্যদিকে এ সময় কাটাবন এলাকা থেকে আন্দোলনের যুগ্ম আহবায়ক সোহরাব হোসেনকে তুলে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে।

আন্দোলনকারীরা জানান, সমাবেশ শেষে আন্দোলনের যুগ্ম আহবায়ক সোহরাব হোসেন, রাতুল সরকার ও নিয়াজী একটি সিএনজি করে চলে যায়। আরেকটি ট্যাক্সি ক্যাবে করে যান আতাউল্লাহ ও বিন ইয়ামিন মোল্লা। এ সময় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা মোটরসাইকেল নিয়ে সিএনজি ও ট্যাক্সি ক্যাবের পিছু নেয়।

একপর্যায়ে রাজধানীর কাঁটাবন এলাকায় সিএনজি থামিয়ে সোহরাব, রাতুল ও নিয়াজীকে মারধর করেন তারা। এসময় নিয়াজী ও রাতুল পালিয়ে গেলেও সোহরাবকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা মোটরসাইকেলে করে তুলে নিয়ে যায়।

এ সময় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের কর্মসূচী ও পরিকল্পনা বিষয়ক উপ-সম্পাদক মুরাদ হায়দার টিপু, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সাইদুর রহমান উজ্জ্বল, জহুরুল হক হল শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আমির হামজাসহ আটদশ জনকে মারধর করতে দেখা যায়।

মারধরের সময় সেখানে কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যরা এগিয়ে এসে সোহরাবকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে জানতে চাইলে নিউমার্কেট থানায় নিয়ে যাওয়ার কথা জানান। তবে নিউমার্কেট থানায় গিয়ে খোঁজ নিলে সোহরাবকে পাওয়া যায়নি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাইদুর রমান উজ্জ্বল বলেন, কোটা আন্দোলন হয়েছে ক্যাম্পাসে। আমি বাইক নিয়ে বাটা সিগন্যালের দিকে গেলে এক সিনজির চালকের সঙ্গে ঝামেলা হয়। কিন্তু সিনজিতে থাকা তিনজনের সঙ্গে কোনো কথা হয়নি।

এর আগে সমাবেশে বিন ইয়ামিন মোল্লা বলেন, কোটা সংষ্কার আন্দোলন সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলন। অথচ এই আন্দোলনকে বাধাঁগ্রস্থ করে একটি কুচক্রী মহল প্রোপাগান্ডা চালাচ্ছে। শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করলেও আমাদের ওপর হামলা চালানো হচ্ছে। হামলা চালিয়ে আবার আমাদেরকেই আটক করে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করা হচ্ছে। তবে যতদিন পর্যন্ত দাবি আদায় না হবে ততদিন এই আন্দোলন ও কর্মসূচী চলবে।

এদিকে ছাত্র সমাবেশে ‘বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ’র যুগ্ম-আহ্বায়ক বিন ইয়ামিন মোল্লা বলেন, কোটা আন্দোলনকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার জন্য বিভিন্ন ধরনের প্রোপাগান্ডা চালানো হয়েছে। এসবের বাস্তব কোন ভিত্তি নেই। এ আন্দোলন যৌক্তিক। কিন্তু এখানে হামলা চালিয়ে ব্যাক্তিগত বিরোধ তৈরি করা হচ্ছে। যেটি কোনভাবে কাম্য নয়।

তিনি বলেন, আটককৃতদের মুক্তি, নিরাপদ ক্যাম্পাস ও হামলাকারীদের বিচার না হওয়া পর্যন্ত কর্মসূচী চলমান থাকবে। আগামী ২৫ জুলাই বেলা ১১ টায় সারাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল কর্মসূচী পালন করার আহ্বান জানাচ্ছি।

সমাবেশে বক্তব্য রাখেন কোটা সংস্কার অন্দোলনের যুগ্ম-আহ্বায়ক রাশেদ খানের মা সালেহা বেগম। তিনি বলেন, আমার বাবা সাধারণ ছাত্র। সে কোন রাজনীতি করে নাই। সে একটা চাকরির জন্য আন্দোলনে গিয়েছিল। তিনি প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বলেন, সে আপনার পক্ষের লোক। সে অনেক কষ্টে আছে। আমি আপনার কাছে আমার বাবাকে ভিক্ষা চাচ্ছি। আমি আমার বাবাকে ছাড়া থাকতে পারব না। আমি আমার বাবার মুক্তি চাই।

এ সময় শিক্ষার্থীরা নিরাপদ ক্যাম্পাসের দাবিতে বিভিন্ন ধরনের প্ল্যাকার্ড প্রদর্শন করেন।

‘শিক্ষার পরিবেশ বিঘ্নিত করার অপপ্রয়াসের’ প্রতিবাদে আওয়ামীপন্থী শিক্ষকদের মানববন্ধন: এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘শিক্ষার পরিবেশ বিঘ্নিত করার অপপ্রয়াসের’ প্রতিবাদে মানববন্ধন করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামীপন্থী শিক্ষকবৃন্দ।

রোববার বেলা ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের প্রধান ফটকের সামনে ‘সচেতন শিক্ষক সমাজ’ এর ব্যানারে তারা এ মানববন্ধনে অংশ নেয়। এতে বিভিন্ন বিভাগের প্রায় শতাধিক শিক্ষক অংশ নেন।

মানববন্ধনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল বলেন, কোটা আন্দোলনের নামে ও নিপীড়নের নামে মুক্তিযুদ্ধের ওপর আঘাত কোনভাবেই বরদাস্ত করা হবে না।

তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুকে আঘাত করা মানে এদেশের জাতির অস্তিত্বের ওপর আঘাত করা, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর আঘাত করা, স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত করা। আইয়ুব ইয়াহিয়া যে কাজটি করেনি, রাজাকার যে কাজটি সাহস করে নাই, আজকে তিনি তার যৌবনে মুক্তিযুদ্ধে যান নাই, তিনি আজকে বঙ্গবন্ধুকে এখানে দাঁড়িয়ে আঘাত করছেন, আয়োজকরা ক্ষান্ত থাকছেন, তারা কথা বলেছেন না।

ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল বলেন, সামনে যাদের বসিয়ে রাখা হচ্ছে তারা আবার হাততালি দিচ্ছেন। স্বাধীনতার ৪৭ বছর পরে এই চিত্র আমাদের দেখতে হচ্ছে। এটা কোনভাবেই আমরা বরদাস্ত করবো না। কোটার নামে নিপীড়নের নামের মুক্তিযুদ্ধের ওপর আঘাত এটা কোন ভাবেই বরদাস্ত করার সুযোগ নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে বলতে চাই এ বিষয়ে ব্যাবস্থা নিন।

‘শেখ হাসিনা কি মুক্তিযুদ্ধ করেছে? শেখ মুজিব কি মুক্তিযুদ্ধ করেছে?’- আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক আকমল হোসেনের এমন বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থ এন্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেস অনুষদের ডিন ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য অধ্যাপক মাকসুদ কামাল তার শাস্তি দাবি করেন।

কোটা সংস্কার আন্দোলনের বিষয়ে তিনি বলেন, কোটা আন্দোলনের সময়ে আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির পক্ষ থেকে আন্দোলনরত ছাত্রদের কাছে গিয়ে সংহতি প্রকাশ করেছি। আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ওপর আস্থা রাখতে বলেছি। অন্যান্য বিষয়ের মতো মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে কোটা বিষয়ে একটি যৌক্তিক ও আইনি সমাধান হবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।

তিনি বলেন, সেটি হয়তো সময়ের ব্যাপার। আমরা যখন শিক্ষক আন্দোলন করছিলাম, আমাদেরও দেড় বছর ধরে কাজটি করতে হয়েছে, তার একটি যৌক্তিক এবং সম্মানজনক সমাধানও হয়েছিল। তাদের এই বিষয়টিরও সম্মানজনক সমাধান হবে।

বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. সৌমিত্র শেখরের সঞ্চালনায় এতে উপস্থিত ছিলেন সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম, বিজয় একাত্তর হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. শফিউল আলম ভূইয়া, কবি সুফিয়া কামাল হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. সাবিতা রিজওয়ানা রহমান, শামসুন্নাহার হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড, সুপ্রিয়া সাহা, শিক্ষক সমিতির যুগ্ম সম্পাদক অধ্যাপক ড. তাজিন আজিজ চৌধুরী, শিক্ষক সমিতির কোষাধ্যক্ষ ও একাউন্টিং এন্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন আহমেদ, অধ্যাপক বজলুল হক খন্দকার সহ বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকগণ।
খবর৭১/এসঃ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here