আয়োডিন লবণের নামে বিক্রি হচ্ছে শিল্প লবণ

0
380

খবর৭১ঃশিল্পের কাঁচামাল হিসেবে আমদানি করা সোডিয়াম সালফেটকে ভোজ্যলবণ (সোডিয়াম ক্লোরাইড) হিসেবে বিক্রি করে এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।

মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর এ লবণ সাধারণ খাবার লবণের সঙ্গে মিশিয়ে প্যাকেটজাত করে কোটি কোটি মানুষের ঘরে পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। এ শিল্পলবণ (ইন্ডাস্ট্রিয়াল বা গ্লোবাল সল্ট) ভোক্তাদের পেটে যাওয়ায় কিডনি ও লিভারের মারাত্নক ক্ষতি হচ্ছে। অধিক মুনাফা করতে এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে এ লবণ আমদানি করছেন।

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশনের (বিসিক) হিসাব অনুযায়ী, গত অর্থবছরে দেশে প্রায় চার গুণ বেশি শিল্পলবণ আমদানি করা হয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের এক প্রতিবেদনেও বলা হয়, ভোজ্যলবণ আমিদানি-নিষিদ্ধ হওয়ায় শিল্পলবণের আমদানি আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গেছে। নারায়ণগঞ্জের ৩০টি লবণ মিল থেকে দেশে ভোজ্যলবণের চাহিদার প্রায় ৬০ শতাংশ সরবরাহ করা হয়।

এখানকার বিভিন্ন লবণ কারখানার মালিক ও আড়তদারদের একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট শিল্পকারখানায় ব্যবহারের ঘোষণা দিয়ে বিপুল পরিমাণ শিল্পলবণ আমদানি করছে এবং ভোজ্যলবণ হিসেবে ছোট ছোট প্যাকেটে তা বাজারজাত করছে। ফলে দেশের কোটি কোটি মানুষের স্বাস্থ্য চরম ঝুঁকিতে পড়েছে। এ লবণের কারণে মানবদেহে কিডনি ও লিভার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়াসহ নানা ধরনের জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। মোল্লা, পূবালী, এসিআইয়ের মতো নামি ব্র্যান্ডের লবণ মিল মালিকরা বিষয়টি নিয়ে শঙ্কিত বলে জানা গেছে।

সাবান, ডিটারজেন্ট পাউডার ও গার্মেন্ট শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে আমদানি করা সোডিয়াম সালফেট দেখতে খাওয়ার লবণের মতো। তাই অসাধু ব্যবসায়ীরা প্রয়োজনের চেয়ে বেশি পরিমাণ সোডিয়াম সালফেট আমদানি করে এর সঙ্গে সোডিয়াম ক্লোরাইড মিশিয়ে বাজারে বিক্রি করছে। এর মাধ্যমে নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন লবণ কারখানার মালিক ও আড়তদারদের শক্তিশালী সিন্ডিকেট কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এতে বিশাল অঙ্কের রাজস্ব থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে সরকার। স্থানীয় বাজারে অপরিশোধিত লবণের দাম বেশি হওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজার থেকে সোডিয়াম ক্লোরাইডের নামে সোডিয়াম সালফেট আমদানি করা হচ্ছে। শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে বিভিন্ন ধরনের লবণ আমদানিতে ৩৭ শতাংশ শুল্ককর দিতে হয়। এ হারে শুল্ক পরিশোধের পরও প্রতি কেজিতে আমদানি খরচ ৫ টাকা ৬৯ পয়সা হয়। প্রতি কেজি দেশি ভোজ্যলবণ বাজারজাত করা হচ্ছে ২৩ টাকা। আর শিল্প লবণকে ভোজ্যলবণ হিসেবে বাজারজাত করা হচ্ছে ১৫-১৬ টাকা দরে। দাম কম হওয়ায় মফস্বল এলাকার পাইকাররা এ লবণ কিনে নিচ্ছেন।

গত অর্থবছরে চার গুণ বেশি শিল্পলবণ আমদানি : বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশনের (বিসিক) হিসাব অনুযায়ী, দেশে ভোজ্যলবণের চাহিদা ১৬ থেকে ১৭ লাখ টন। আর শিল্পলবণের চাহিদা তিন লাখ ৮৩ হাজার টন। অথচ গত অর্থবছর দেশে শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে ১৪ লাখ ৪০ হাজার ৭৫৮ টন শিল্পলবণ আমদানি হয়েছে। এর মধ্যে সোডিয়াম ক্লোরাইড আট লাখ ৯০ হাজার ১৮০ টন, হোয়াইট সোডিয়াম সালফেট পাঁচ লাখ ২৪ হাজার ৮৪ টন ও সোডিয়াম সালফেটস ২৬ হাজার ৫৩০ টন আমদানি হয়েছে।

রিফাইন ছাড়াই ছোট প্যাকেটে : দেশের অন্যতম লবণের মোকাম নারায়ণগঞ্জের নিতাইগঞ্জ থেকে রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে ভোজ্যলবণ সরবরাহ করা হয়। এখানে প্রায় ৩০টি লবণ মিল রয়েছে। এ ছাড়া আড়তদার রয়েছেন ৩০ জনের মতো। জানা গেছে, দেশি চাষের লবণের রং লালচে হয়। মিলে রিফাইন করার পর এটির রং সাদা হয়। ভ্যাকুয়াম, মেকানিক্যাল ও সনাতন তিন পন্থায় দেশে লবণ পরিশোধন হয়ে থাকে। নারায়ণগঞ্জে দেশি লবণের সিংহভাগ আসে কক্সবাজার থেকে।

নারায়ণগঞ্জের মিলগুলোতে সনাতন পদ্ধতিতে লবণ পরিশোধন করা হয়। এ ছাড়া এসিআই সল্ট লিমিটেড, ইউনাইটেড সল্ট ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, পূবালী ভ্যাকুয়াম ইভ্যাপোরেটড সল্ট প্ল্যান্ট, ডায়না ইন্টারন্যাশনাল প্রাইভেট লিমিটেড ও মোল্লা সল্ট (ট্রিপল রিফাইনড) ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, ক্রিস্টাল, মধুমতি, মুসকানসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ভ্যাকুয়াম ও মেকানিক্যাল পদ্ধতিতে লবণ পরিশোধন করে। নিতাইগঞ্জ ও আশপাশের এলাকায় গড়ে ওঠা বেশিরভাগ মিলে পরিশোধনের আধুনিক মেশিনারিজ নেই।

রাতের আঁধারে চলে প্যাকেটজাতকরণ : লোকচক্ষু ও প্রশাসনকে ফাঁকি দিতে গভীর রাত থেকে ভোর পর্যন্ত শিল্পলবণকে ছোট আকারের প্যাকেটে ভরা হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছু লবণ মিল মালিক ও আড়তদাররা জানান, বাংলাদেশ লবণ মিল মালিক সমিতির সহসভাপতি ও শাহে মদিনা সল্ট ইন্ডাস্ট্রিজের মালিক দুলাল সাহা এ সিন্ডিকেটের অন্যতম হোতা। এ ছাড়া আলীগঞ্জের আজমেরি সল্ট ভাড়া নেয়া চট্টগ্রামের বাসিন্দা জাহিদ, ফতুল্লার কাশীপুর সল্ট ইন্ডাস্ট্রিজের মালিক সোহাগ, উত্তরা সল্ট ইন্ডাস্ট্রিজের ছোট দুলাল, নারায়ণগঞ্জ সল্ট ইন্ডাস্ট্রিজের মালিক মো. মাইনউদ্দিন আহাম্মেদ, আলী সল্ট ইন্ডাস্ট্রিজের মালিক মো. রফিক, হারুন ট্রেডার্সের মো. বাবুল, কোয়ালিটি সল্টের মালিক কমল সাহা, সপ্তডিঙ্গা সল্ট ইন্ডাস্ট্রিজের মোহন বাবু, খাজা গরীবে নেওয়াজ সল্ট ইন্ডাস্ট্রিজের মালিক কামাল দেওয়ান, আলীগঞ্জের আজমেরী সল্টের জাহিদসহ এক ডজন মিল মালিক ও ব্যবসায়ী এ সিন্ডিকেটের সদস্য।

মিল মালিক ও আড়তদাররা : বাংলাদেশ লবণ মিল মালিক সমিতির সাবেক সভাপতি পরিতোষ কান্তি সাহা জানান, বিসিকের হিসাবে দেশে শিল্পলবণের চাহিদা পৌনে চার লাখ টন। অথচ গত অর্থবছরে প্রায় ১৫ লাখ টন আমদানি হয়েছে। বাড়তি এ লবণ বাজারে ভোজ্যলবণ হিসেবে বিক্রি করছে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী। চীন থেকে এ লবণ আনা হচ্ছে। এসিড দিয়ে পরিশোধন করা এ লবণ মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। এ লবণের বাজারজাত বন্ধে তিনি সরকারকে উদ্যোগ নেয়ার দাবি জানান।

নারায়ণগঞ্জ লবণ আড়তদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক সাইদুর হক লিপন জানান, চট্টগ্রামের একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেটের মাধ্যমে প্রতিদিন ২০-২৫টি ট্রাকভর্তি শিল্পলবণ আসছে। পরিশোধন না করেই বস্তা খোলার পরপরই ছোট ছোট প্যাকেটে ভরে তা বাজারজাত করা হয়। ফলে পরিশোধনের খরচ বেঁচে যায়। খুচরা বাজারে ভোজ্যলবণের চাইতে এটি কেজি প্রতি ১০ থেকে ১২ টাকা কমে বিক্রি করা যায়। এসব লবণ সাধারণত জামালপুর, দিনাজপুর, রংপুরসহ বিভিন্ন মফস্বল এলাকায় সরবরাহ করা হয়। এ বিষয়ে জানতে শাহে মদিনা সল্ট ইন্ডাস্ট্রিজের মালিক দুলাল সাহার মোবাইল ফোনে কল করা হলে তিনি অভিযোগ অস্বীকার করেন এবং নিরিবিলি কথা বলতে চান। কোয়ালিটি সল্টের মালিক কমল সাহার মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।

মানবদেহের জন্য মারাত্মক বিষ : নারায়ণগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা মো. এহসানুল হক জানান, যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব হেলথ অ্যান্ড হিউম্যান সার্ভিসেসের তথ্য অনুযায়ী, সোডিয়াম সালফেট খেলে মানুষ ডায়রিয়া ও গ্যাস্ট্রিকসহ নানা রোগে আক্রান্ত হয়। এক পরীক্ষায় দেখা গেছে, ১৫ দিন সোডিয়াম সালফেট মিশ্রিত পানি খাওয়ানোর পর এক-তৃতীয়াংশ মুরগি মারা গেছে। শিল্পলবণ খেলে মানবদেহে কিডনি, লিভারসহ নানা অঙ্গে জটিল রোগ হতে পারে।

নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) সেলিম রেজা জানান, অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত আছে। এ বিষয়ে শিগগির জোরালো অভিযান পরিচালনা করা হবে।
খবর৭১/ইঃ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here