আর কখনোই বেড়াতে যাওয়ার জেদ ধরবে না পিয়াস

0
554

খবর ৭১:শেষবারের মতো ঘরে ফিরল পিয়াস। দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকা আগুনে হারিয়ে যাওয়া পিয়াস আর কখনোই বেড়াতে যাওয়ার জন্য জেদ ধরবে না বাবা-মায়ের সঙ্গে। মায়ের স্বপ্ন ছিল পিয়াসকে তৈরি করবেন সবচেয়ে বড় এক ডাক্তার। তবে সে স্বপ্নপূরণ হলো না তাদের।

নেপালের কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন বিমানবন্দরে বাংলাদেশের ইউএস-বাংলার বিমান বিধ্বস্ত হওয়ায় নিহত ২৬ বাংলাদেশির মধ্যে পিয়াস রায় একজন। প্রথম পর্যায়ে ২৩ জনের মৃতদেহ বাংলাদেশে পৌঁছালেও পিয়াস রায়সহ বাকি তিনজনের মৃতদেহ আসে বৃহস্পতিবার দুপুরে।

শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে মৃতদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করার পর প্রথমে পিয়াসকে গোপালগঞ্জের শেখ সায়েরা খাতুন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে রাত ১টায় পিয়াসের লাশবাহী কফিনে কলেজের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের পুষ্পার্ঘ্য প্রদান শেষে রওনা দেয়া হয় বরিশালের উদ্দেশে।

রাত ৩টায় বরিশাল নগরীর শীতলাখোলা সংলগ্ন গফুর সড়কস্থ নিজ বাসায় পৌঁছায় পিয়াস রায়ের মৃতদেহ বহনকারী গাড়িটি। এরপরেই শুরু হয় স্বজনদের কান্না আর আহাজারি। শোকবিহ্বল হয়ে পিয়াস রায়ের পাগল প্রায় মা স্কুলশিক্ষিকা পূন্যা রানী রায় বেশ কিছুক্ষণ সময় ছিলেন অচেতন অবস্থায়।

কথা হয় শেখ সায়েরা খাতুন মেডিকেল কলেজের শেষ বর্ষের ছাত্র পিয়াস রায়ের বাবা স্কুলশিক্ষক সুখেন্দু বিকাশ রায়ের সঙ্গে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ছেলে ভালো ডাক্তার হবে, মানুষের সেবা করবে। এই স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গেল, যা হারিয়েছি তা কেউ ফিরিয়ে দিতে পারবে না। সরকারের কাছে কিছু চাওয়া পাওয়ার নেই। দ্বিতীয় কাউকে যেন এভাবে তার সন্তানকে হারাতে না হয় এটাই কামনা করি।

শুক্রবার সকাল সাড়ে ৭টায় পিয়াসের মৃতদেহ নেয়া হয় তার স্কুলজীবন কাটানো বরিশাল জিলা স্কুল প্রাঙ্গণে। সেখানে তার কফিনে শ্রদ্ধা জানান পিয়াসের সহপাঠী ও শিক্ষকরা।

পিয়াসকে দেখতে ঢাকা থেকে ছুটে আসা বন্ধু ইভান জানান, পড়াশোনায় অনেক মেধাবী ছিল পিয়াস। সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও চলাচল ছিল। তাছাড়া পিয়াসের সঙ্গে ছোট বড় নয়। সবার সঙ্গেই ছিল খুবই ভালো সম্পর্ক।

২০১০ সালে এই স্কুল থেকে আমাদের সঙ্গেই পিয়াস এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। সে সময় সে বরিশাল বোর্ডে প্রথম স্থান অধিকার করেন। কটু কথা ওর মুখ থেকে মনে হয় আমরা কখনো শুনিনি।

পিয়াস রায়ের আরেক বন্ধু শাহরোখ বলেন, গতবছর ইফতার পার্টি করেছিলাম। পিয়াস নিরামিষভোজী হওয়ায় নিজের জন্য একটি দোকান থেকে পায়েস আনতে গিয়ে দোকানদার ভুল করে তাকে হালিম দিয়ে দেয়। এই নিয়ে বেশ মজাও হয়েছিল পিয়াসের সঙ্গে। ওই ইফতার পার্টির পর এই দিনে সব বন্ধুরা আবার এক জায়গায় মিলিত হয়েছি। তবে সেটা কোনো আনন্দের সংবাদে নয়, প্রিয় বন্ধু পিয়াসের মৃত্যু আমাদের এক জায়গায় একত্র করতে বাধ্য করেছে।

পিয়াসের আরেক বন্ধু খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রনিকস কমিউনিকেশন অনুষদের শেষ বর্ষের ছাত্র এসএম শোয়েব জানান, আমরা পিয়াসের জন্য দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এখানে এসেছি। পিয়াসের মতো বন্ধু জোটা আসলেই কষ্টসাধ্য বিষয়।

এদিকে পিয়াসের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করে বরিশাল জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা সাবিনা ইয়াসমিন কান্নাজড়িত কণ্ঠ নিয়ে বলেন, আমার ছাত্র ছিল পিয়াস। এসএসসিতে বোর্ডে ১ম স্থান অধিকারী তিনি। ওর মতো মেধাবী ছাত্র হারিয়ে আমাদের যে ক্ষতি হয়েছে তা বলার মতো নয়। পিয়াসের মৃত্যু অকল্পনীয়। ওর মৃত্যুযাত্রা এখানে আসবে সেটা কখনো ভাবিনি।

জিলা স্কুল প্রাঙ্গণে পিয়াসকে দেখতে আসা বরিশাল মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান মু. জিয়াউল হক শোক প্রকাশ করে জানান, এই আকস্মিক দুর্ঘটনায় পিয়াসের মৃত্যু খুবই দুঃখজনক। তার কাছ থেকে আমাদের অনেক প্রত্যাশা ছিল। এটা একটা অপূরণীয় ক্ষতি।

বরিশাল জিলা স্কুল প্রাঙ্গণে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে সকাল ৯টায় পিয়াস রায়ের মৃতদেহ লাশবাহী গাড়িতে করে নেয়া হয়ে বরিশাল মহাশ্মশানে। সেখানে ধর্মীয় আচার পালন ও বরিশাল জেলা প্রশাসক মো. হাবিবুর রহমানের শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে পিয়াসের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া বেলা ১১টায় শুরু হয়ে দুপুর দেড়টার দিকে শেষ হয়। পিয়াস রায়ের বাবা সুখেন্দু বিকাশ রায় ছেলের মুখাগ্নি করেন।

বরিশাল মহাশ্মশান রক্ষা সমিতির সাধারণ সম্পাদক কিশোর কুমার দে জানান, ত্রুটিবিহীনভাবে পিয়াস রায়ের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়েছে। আমরা এই মহাশ্মশানে তার স্মরণে তৈরি করা মঠের জন্য ভালো একটি জায়গা ইতিমধ্যেই নির্ধারণ করে দিয়েছি।

প্রসঙ্গত, অবকাশকালীন ছুটি কাটাতে পাঁচ দিনের জন্য নেপালে গিয়েছিলেন পিয়াস রায়। গত ১১ মার্চ কাঠমান্ডুর উদ্দেশে বরিশাল ত্যাগ করেছিলেন পিয়াস। তবে পাঁচ দিন পর নয়, ১২ দিন পর সে ফিরল তার প্রিয় শহরে কফিনবন্দি হয়ে।

খবর ৭১/ ই:

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here