আমিসহ আমরা কেউ বিশ্বাসই করছিল না যে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে

0
662

নিজস্ব প্রতিনিধি, গোপালগঞ্জ : গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া উপজেলায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধি সৌধের পাশের একটি বাড়িতে থাকেন কাজী ইদ্রিস আলী। বয়স এখন প্রায় ৭৮ বছর। সংসারে স্ত্রী, তিন ছেলে ও দুই মেয়ে। বড় ছেলে ও দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। সাত বছর আগে টুঙ্গিপাড়া শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব সরকারি হাসপাতালের চাকরির মেয়াদ শেষ হয়েছে। কোনো রকমে চালিয়ে নিচ্ছেন সংসার। যে ১৮ জন বঙ্গবন্ধুকে দাফন করছেন তার মধ্যে কাজী ইদ্রিস আলী একজন। সে দি ছিল শুক্রবার। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সকালে ওয়ারলেসের মাধ্যমে প্রথমে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার খবর শোনেন তিনি। বারবার ওয়ারলেসে বলা হয়, এক স্বৈরশাসক সরকারের পতন হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার খবর টুঙ্গিপাড়ায় ছড়িয়ে পড়লে হতভম্ব হয়ে পড়ে টুঙ্গিপাড়াবাসী। কেউ যেন বিশ্বাসই করছিলেন না। অশ্রু সজল চোখে এ ভাবেই কথাগুলো বলছিলেন কাজী ইদ্রিস আলী।
টুঙ্গিপাড়া ছিল অপরিচিত একটি গ্রাম। বনেদি পরিবারের বসবাস ছিল হাতে গোনা মাত্র দুই/একটি। তার মধ্যে একটি বনেদি পরিবারের নাম শেখ পরিবার। এই পরিবারের উত্তরসূরি শেখ হামিদ। শেখ হামিদের একমাত্র পুত্র শেখ লুৎফর রহমান। ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ শেখ লুৎফর রহমান ও তার স্ত্রী শেখ সায়রা খাতুনের ঘরে জন্ম নেয় একটি শিশু। বাবা-মা নাম রাখেন ‘খোকা’। আদরের এই খোকাই হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, পরবর্তীকালে জাতির পিতা এবং সমগ্র বাঙালির প্রিয় মানুষ ও মুক্তিদাতা।
সেই থেকে গোপালগঞ্জ একটি ঐতিহাসিক জনপদ। রাজনৈতিক গুরুত্বে ও লোকজ-সাংস্কৃতিক সমাবেশে গোপালগঞ্জ হচ্ছে ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান। মধুমতি বিধৌত এ জনপদের রয়েছে সুপ্রাচীন ঐতিহ্য। গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া এখন ইতিহাসের এক অম্লান পাদপিঠ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্মস্থানও টুঙ্গিপাড়া। এখানে রয়েছে জাতির পিতার সমাধি সৌধ ও কমপ্লেক্স। এটি একটি দর্শনীয় ও পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে ইতোমধ্যে দেশবাসীর কাছে পরিগণিত হয়েছে। প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে হাজার হাজার দর্শনার্থী আসেন এখানে। ঘুরে ঘুরে দেখেন জাতির পিতার সমাধি ও আশপাশ এলাকা।
১৯৭১ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে স্বাধীনতা যুদ্ধ করে বীর বাঙালি। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে পাক হানাদারের কাছ থেকে লাল-সবুজের পতাকা ছিনিয়ে আনে। যুদ্ধবিধস্ত বাংলাদেশে যখন পুনঃগঠনের কাজ শুরুর করেন ঠিক সে সময়ে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে জাতির পিতাকে স্বপরিবারে নির্মম ভাবে হত্যা করে বিপথগামী একদল সেনাসদস্য। এরপর তার লাশ নিয়ে আসা হয় গোপলগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায়। দাফন করা হয় মা-বাবার কবরের পাশে।
ইদ্রিস আলী বলেন, একটি হেলিকপ্টারে করে বঙ্গবন্ধুর লাশ নিয়ে আসে সেনাবাহিনী। এরপর থানার এক পুলিশ কর্মকর্তা দাফনের জন্য আমাকেসহ ১৮ জনকে নিয়ে যান। পরে হেলিকপ্টার থেকে খোলা মাঠে (বর্তমানে সমাধিসৌধ কমপ্লেক্স) বঙ্গবন্ধুর লাশবাহী কফিন নামানো হয়। এ সময় তারা তখনি লাশ দাফনের কথা বলেন। তখন কফিন খোলার জন্য মিস্ত্রি আব্দুল হামিদকে ডাকা হলেও তিনি বাড়িতে না থাকায় দায়িত্ব পড়ে তার ছেলে শেখ আইয়ুব আলীর ওপর। আইয়ুব আলী এসে কফিন খোলেন। কফিনে বঙ্গবন্ধুর লাশ ছিল সাদা কাপড় দিয়ে ঢাকা। কাপড় সরিয়ে দেখা যায় চশমাটি ছিল ডান পাশে ভাঙা অবস্থায়। গুলিতে বুক ঝাঁঝরা হয়েছিল। পাশের একটি পুকুর থেকে পানি এনে রক্ত ধোয়া হয়।
দ্রুত দাফন করার কথা বললেও গোসল না করিয়ে ও জানাজা না পড়িয়ে দাফন করতে অস্বীকার করেন মৌলভী সাহেব। তখন তারা দ্রুত করার কথা বলেন। পরে পাশের একটি দোকান থেকে ৫৭০ সাবান এনে গোসল করানো হয়। এরপর রিলিফের একটি সাদা কাপড় দিয়ে পরানো হয় কাফন। বঙ্গবন্ধুর জানাজাতে অংশ নেন মাত্র ৩০ জন। সে সব ঘটনা এখন মনে পড়লে কষ্ট পাই। বঙ্গবন্ধুকে যখন হত্যা করা হয় ও দাফন করা হয় তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছিলেন বিদেশে।
যখন বঙ্গবন্ধুর লাশ টুঙ্গিপাড়ায় আনা হয় তখন পরিস্থিতি কেমন ছিল, এমন প্রশ্নের জবাবে ইদ্রিস আলী বলেন, অনেক প্রভাবশালী লোকজন ভয়ে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায়। পুরো এলাকায় আতঙ্ক ও ভীতি ছড়িয়ে পড়ে।
বঙ্গবন্ধুর বিচারের রায় সম্পূর্ণ কার্যকর না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, একজন দেশপ্রেমিক, দেশের স্থপতিকে হত্যা করা হয়েছে। এখনো তার পলাতক খুনিদের দেশে এনে বিচারের রায় কার্যকর করা হয়নি। দ্রুত পলাতক খুনিদের দেশে এনে রায় কার্যকরের দাবি জানান তিনি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here