আওয়ামী লীগ বনাম আওয়ামী লীগ

0
870
মধ্য পঞ্চাশে শেখ রাসেল ও বাঙালির অধিকার
অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব চেয়ারম্যান, লিভার বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।বিশ্ববিদ্যালয়।

খবর৭১ঃ

সম্প্রীতি বাংলাদেশের সর্বশেষ আনুষ্ঠানিকতাটি ছিল প্রধানমন্ত্রীর জন্মদিন উপলক্ষে জাতীয় প্রেসক্লাবে একটি আলোচনা অনুষ্ঠান আয়োজন। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান। বক্তব্যের শুরুতেই গত বছর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগদানের স্মৃতিচারণ করছিলেন তিনি। সাধারণ পরিষদে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের সময় তার সঙ্গে পরিচয় হয় হন্ডুরাসের ভাইস প্রেসিডেন্টের। কথায় কথায় জানলেন ভদ্রলোকের বক্তব্য ছিল আগের দিন। তিনি শুধু বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য শোনার জন্যই সেদিনের অধিবেশনে এসেছেন। কারণ এই প্রধানমন্ত্রী শুধু বাংলাদেশের মানুষের কথা বলেন না, তিনি বিশ্ব মানবতার কথা বলেন।

সম্প্রীতি বাংলাদেশ আর একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার কারণে ইদানীং আমার এদিক-ওদিক বক্তব্য দেয়া আর শোনার সুযোগ হয় ভালই। প্রায়ই বলি আর বলতে শুনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ছিলেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী। সন্দেহ নেই মোটেও। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর এই স্বীকৃতির কারণ শুধু বিবিসি নামের একটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম পরিচালিত জরিপ নয়। এর কারণ বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ নামক জাতি রাষ্ট্রটির জনক। বাংলাদেশের মতো ‘এক জাতির এক দেশ’-এর এমনি উদাহরণ আমাদের অঞ্চলে তো বটেই, গোটা পৃথিবীতেই বিরল। আর যদি বাঙালী জাতির ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকান, দেখবেন এই জাতি অধ্যুষিত যে কোন ভূখ-ের তিনিই ছিলেন ‘প্রথম স্বাধীন বাঙালী শাসক’। পাল বা সেন রাজারা, নবাব সিরাজউদ্দৌলা অথবা ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিল্জী যার কথাই বলি না কেন, এটি এমন একটি ভূখণ্ড যার হাজার বছরের ইতিহাসে কোন বাঙালী শাসক ছিল না।

বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ নামের যুদ্ধবিধ্বস্ত জাতি রাষ্ট্রটি স্বাধীনতার মাত্র তিন বছরের মাথায় সাত শতাংশ প্রবৃদ্ধির দেশে পরিণত হয়েছিল আর বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের মানচিত্রের সীমানা পেরিয়ে হয়ে উঠেছিলেন বিশ্বমানবের মুক্তির প্রতীক। পঁচাত্তর সালে বাংলাদেশে বাম্পার ফলন হয়েছিল, যার সুফল বাংলাদেশ পেয়েছিল ছিয়াত্তরে। ১৫ আগস্টের অঘটনটা তাই ছিয়াত্তরে ঘটানো অতটা সহজ নাও হতে পারত!

সঙ্গত কারণেই বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ অনেকের কাছেই ছিল অনাকাক্সিক্ষত। অতএব সেদিনকার বিশ্ব রাজনীতির প্রেক্ষাপটে ১৫ আগস্ট পুরোপুরি অসম্ভব ছিল না। তবে যা অসম্ভব ছিল তা হলো পাকিস্তানীরা যা করার দুঃসাহস দেখাতে পারেনি, তা কিনা সংগঠিত হলো একদল বিশ্বাসঘাতক বাঙালীর হাতে!

এই কদিন আগেই ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে হারিয়ে গেছে আরেকটি ছাব্বিশ সেপ্টেম্বর। প্রায় অনুচ্চারিত আর ভুলে থাকা এই তারিখটি এ বছর কিছুটা আলোচনায়। এটি বাংলাদেশের ক্যালেন্ডারে একটি অন্যতম কালো দিবস। এই দিনেই খন্দকার মোশতাক আহমেদ ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচারের পথ রুদ্ধ করে দিয়েছিল। ১৯৯৬ সালে জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর জাতীয় সংসদে ইনডেমনিটি রিপিল বিলটি পাস হয়। ফলে অপসারিত হয় ১৫ আগস্টের খুনীদের বিচারের পথে আইনী বাধা। তারপর দীর্ঘ আইনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে খুনীদের বিচারের আওতায় আনা হয়। তাদের কারও কারও সাজা কার্যকর হয়েছে, অনেকে এখনও পলাতক। পলাতকদের কাউকে কাউকে দেশে ফিরিয়ে এনে শাস্তির মুখোমুখি করার প্রক্রিয়াটিও চলমান। তাই বলে কিন্তু এমনটি মনে করার কোন কারণ নেই যে, বাঙালী জাতি ১৫ আগস্টের রাতে শুধু সেনাবাহিনীর কিছু বিপথগামী কর্মকর্তার এ্যাডভেঞ্চারের খেসারত দিয়েছিল। ১৫ আগস্টের নেপথ্যের কুশীলবদের তালিকা অনেক দীর্ঘ। এতে আছে যেমন দেশের অনেকের নাম, নাম থাকতে বাধ্য অনেক বিদেশীরও। এটি তো এখন স্পষ্ট যে, জেনারেল জিয়া, খন্দকার মোশতাকসহ অনেকেই জড়িত ছিল এই নির্মম হত্যাকা-ের নেপথ্যে। ইদানীং জোর দাবি উঠছে একটি কমিশন গঠনের মাধ্যমে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের নেপথ্যের কুশীলবদের চিহ্নিত করে প্রয়োজনে মরণোত্তর বিচারের আওতায় আনার। সম্প্রীতি বাংলাদেশের সাম্প্রতিক একটি অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে আইনমন্ত্রী জাতিকে আশ্বস্ত করেছেন যে, এই কমিশন গঠন এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। আমি নিশ্চিত এই কমিশন গঠিত হবে, চিহ্নিত হবে অন্ধকারের খলনায়করা এবং বিচারও হবে তাদের। আমার ভ্রƒ অবশ্য কুঞ্চিত অন্য কারণে। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকা-ের সঙ্গে সরাসরি বা নেপথ্যে সংশ্লিষ্ট যে লোকগুলোকে আমরা আজ চিনি, একটু মোটাদাগে ভেবে দেখুন তো, তারা কারা? এরা কেউ কেউ ছিল মুক্তিযোদ্ধা, কেউ কেউ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছিল একেবারে পারিবারিক পর্যায়ে, তো কেউ আবার ছিল ঐ পরিবারেরই কোন সদস্যের সহকর্মী। এমনকি প্রবাসী সরকারের কোন কোন কর্মকর্তা আর মন্ত্রীর নামও আমরা দেখছি এই কুলাঙ্গারতমদের তালিকায়। ১৫ আগস্টের যারা নেপথ্যের খলনায়ক তারা জানত বাঙালীকে দিয়ে আর যাই করানো যাক না কেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা সম্ভব হবে না। তাই বাঙালী জাতির ইতিহাসে সবচাইতে কালো অধ্যায়টি লেখায় তারা কাজে লাগিয়েছিল আমাদের মধ্যে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকা তাদের ইমপ্লান্টদের।

বঙ্গবন্ধু উত্তর জমানায় এই প্রথম বাংলাদেশ আবার সাত শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধির দেশ। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা, যোগ্য পিতার যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে আবারও বাংলাদেশের মানচিত্রকে ছাপিয়ে গেছেন। শেখ হাসিনা এখন ডিপ্লোম্যাট ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদকন্যা। তিনি এখন বিশ্ব মানবের মুক্তির দিশারী। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে একটি জাতি রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের এই যে আবার জেগে ওঠা, সঙ্গত কারণেই এটি আবারও অনেকেরই মাথা ব্যথার কারণ। কাজেই নেপথ্যের কুশীলবরা আবারও সক্রিয়। পরিবর্তিত বৈশ্বিক এবং অভ্যন্তরীণ প্রেক্ষাপটে আরেকটি ১৫ আগস্টের প্রত্যাশা যে দুরাশা তা সম্ভবত এই সব দুর্বৃত্তরাও আরও বেশি ভাল করে জানে। তাই এবারও তারা বঙ্গবন্ধুর প্রাণের সংগঠন আওয়ামী লীগকে জনবিচ্ছিন্ন করার চেষ্টায় আবারও বেছে নিয়েছে একদল ইমপ্লান্টকে। বেশি দূর যেতে হবে না। এই যে সাম্প্রতিক ‘ক্যাসিনো কা-’ কিংবা বুয়েটে যে সাম্প্রতিকতম নিন্দনীয় ঘটনাটি, লক্ষ্য করে দেখুন, প্রতিটি ক্ষেত্রেই যাদের নাম উঠে আসছে তাদের গায়ে আওয়ামী লীগেরই সিল। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাঝে ‘কাউয়া তত্ত্ব’ উপস্থাপন করে ফেসবুকে ট্রলের শিকার হয়েছিলেন। সেদিন যারা তাকে নিয়ে ট্রল করেছিলেন, আজকে কি তারা নিজেদের অপরিণামদর্শিতায় লজ্জিত হন না?

মোটা দাগে হয়তো আজ আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগই। বাস্তবে কিন্তু তা নয়। এই সংগঠনকে ভেতর থেকে দেখার আমার যে তিন দশকের অভিজ্ঞতা, তা থেকে আমি বিশ্বাস করি, আওয়ামী লীগ যেখানে ছিল সেখানেই আছে। আওয়ামী লীগে ইদানীং ইমপ্লান্টদের সমাহার। এরা এসেছে নানা ঘরানা থেকে। লম্বা সেই তালিকায় বিএনপি, জামায়াত, জঙ্গী, বিভ্রান্ত বাম কিংবা ভ্রষ্ট আওয়ামী লীগÑকে নেই? এরা ‘আওয়ামী লীগের ছাতা’ মাথায় ধরে একেক জন একেকটা দোকান দিয়ে বসেছে। এরা আওয়ামী লীগকে বিক্রি করছে, আবার কিনছেও। এরা জনমানসে আওয়ামী লীগকে বানাচ্ছে আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ। এরা দল বেঁধে নেমেছে বাংলাদেশ আর আওয়ামী লীগের উড়তে থাকা ঘুড়ির নাটাইয়ের সুতা কেটে দেয়ার অশুভ চেষ্টায়।

দেশে মাত্র বিশ থেকে বাইশ লক্ষ মানুষ কর দেন। তাতেই সিঙ্গাপুর আর নিউজিল্যান্ডের জিডিপি আমাদের পেছনে। একবার ভাবুন তো, দেশের বিশ থেকে বাইশ শতাংশ মানুষ যদি কর দিত, তাহলে কোথায় দাঁড়াত দেশটা? শতভাগ করদাতার দেশ জাপানকে ছুয়ে দেখা কি এতটুকু বাতুলতা মনে হতো? আমরা এসব নিয়ে ভাবি না, ভাবলেও গায়ে মাখি না। এসব নিয়ে ভাবে বেশি তারাই, যারা একটি ১৫ আগস্ট ঘটিয়ে এদেশকে পিছিয়ে দিয়েছিল একশটি বছর। আমাদের আশার বাতিঘর এখন শেখ হাসিনাই। তিনি যেমন আমাদের ২০৪১-এ একটি উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখাচ্ছেন, তেমনি পাশাপাশি সেই উন্নয়নকে টেকসই আর ধারাবাহিক করার উদ্যোগও তিনি নিয়েছেন। তাই দলের ভেতর দলীয় নামধারীদের দমনে তিনি আজ খড়গহস্ত। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ বনাম আওয়ামী লীগের এই লড়াইয়ে শেষমেশ যে আওয়ামী লীগই জিতবে, অগ্নিস্লানে যে সূচি হবেই ধরা, তা নিয়ে স্বস্তি পেতে আমার এতটুকু অস্বস্তি নেই।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here