বাংলাদেশ-সেভেন সিস্টার্স রেল সংযোগ প্রকল্প স্থগিত করল ভারত

0
33

বাংলাদেশে প্রায় ৫ হাজার কোটি রুপির রেলওয়ে সংযোগ প্রকল্পের অর্থায়ন ও নির্মাণ কাজ স্থগিত করেছে ভারত। এর মাধ্যমে রেলপথের মাধ্যমে বাংলাদেশ হয়ে ভারতের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে তাদের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোকে (সেভেন সিস্টার্স) যুক্ত করার পরিকল্পনা বড় ধরনের ধাক্কা খেল।

রোববার (২০ এপ্রিল) ভারতীয় সংবাদমাধ্যম বিজনেস লাইনের এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানানো হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রায় পাঁচ হাজার কোটি রুপির অর্থায়ন ও নির্মাণ কাজ স্থগিতের মাধ্যমে তিনটি চলমান প্রকল্প বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আরও পাঁচটি প্রকল্পের সমীক্ষার কাজও স্থগিত করা হয়েছে। এই প্রকল্পগুলো বাংলাদেশ অতিক্রমকারী রুটের মাধ্যমে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে মূল ভূখণ্ডের সাথে সংযুক্ত করার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বাধা সৃষ্টি করবে।

প্রতিবেদনে ভারত সরকারের এই সিদ্ধান্তের কারণ হিসেবে ‘শ্রমিকদের নিরাপত্তা’ এবং ‘রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা’র কথা উল্লেখ করা হয়েছে। একটি সূত্রের বরাতে সংবাদমাধ্যমটি এ সংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্য জানিয়েছে।

নতুন পরিকল্পনা অনুযায়ী, ভারত তাদের নিজস্ব রেল নেটওয়ার্ক শক্তিশালী করার লক্ষ্যে বাংলাদেশকে বাদ দিয়ে নেপাল ও ভুটানের মাধ্যমে মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে সেভেন সিস্টার্সকে যুক্ত করার কথা বিবেচনা করছে।

বিজনেস লাইনকে একটি সূত্র জানিয়েছে, নেপাল ও ভুটানের মাধ্যমে এই সংযোগ স্থাপনে ৩ হাজার ৫০০ থেকে ৪ হাজার কোটি রুপি খরচ হতে পারে বলে নয়াদিল্লি ধারণা করছে।

বাংলাদেশের রেল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ভারতের স্থলবেষ্টিত উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর সংযোগ স্থাপনের জন্য স্থগিত হওয়া প্রকল্পগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এগুলো সরু ‘শিলিগুড়ি করিডোর’ বা ‘চিকেনস নেক’-এর ওপর নির্ভরতা কমানোর জন্য তৈরি করা হয়েছিল, যা এই অঞ্চলটিকে ভারতের মূল ভূখণ্ডের সাথে একমাত্র সংযোগ স্থাপনকারী পথ।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেছেন, ‘এই মুহূর্তে বাংলাদেশে কোনো নির্মাণ সামগ্রী বা অন্য কোনো উপকরণ আমরা পাঠাচ্ছি না। প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সংযোগকারী রুটের অর্থায়ন এখন বন্ধ আছে। এটি পুনরায় শুরু করতে হলে প্রথমে বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রয়োজন। তবে পরিকল্পনা অনুযায়ী ভারত অংশে প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে।’

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার। এর আগে, ২০২৪ সালে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ১২.৯ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য সম্পর্ক ছিল, যা উভয় দেশের আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সম্পর্কের ভিত্তি স্থাপন করেছে।

স্থগিত হওয়া প্রকল্পসমূহ:

যে তিনটি ভারত-সহায়তা প্রকল্প বর্তমানে স্থগিত করা হয়েছে সেগুলো হলো:

১. আখাউড়া-আগরতলা ক্রস-বর্ডার রেল সংযোগ এবং খুলাবুড়া-সাহাবাজপুর রেল লাইন স্থাপন। এই প্রকল্পের আওতায় বাংলাদেশে ৬.৭৮ কিলোমিটার ডুয়েলগেজ রেললাইন এবং ত্রিপুরায় ৫.৪৬ কিলোমিটারসহ মোট ১২.২৪ কিলোমিটার রেল সংযোগ স্থাপনের কাজ চলছিল। ভারত সরকার এই প্রকল্পে প্রায় ৪০০ কোটি রুপি অনুদান সহায়তা প্রদান করছিল। খুলাবুড়া-সাহাবাজপুর রেললাইন এই প্রকল্পেরই অংশ, যার লক্ষ্য ছিল বিদ্যমান বাণিজ্য রুট ব্যবহার করার পাশাপাশি নতুন ট্র্যাক স্থাপনের মাধ্যমে আসামের সাথে সংযোগ উন্নত করা।

২. খুলনা – মংলা বন্দর রেল লাইন। ৩ হাজার ৩০০ কোটি রুপি ব্যয়ের এই প্রকল্পটি রেয়াতি লাইন অফ ক্রেডিট-এর অধীনে বাস্তবায়িত হচ্ছিল। এই প্রকল্পের মাধ্যমে মংলা বন্দর এবং খুলনার বিদ্যমান রেল নেটওয়ার্কের মধ্যে প্রায় ৬৫ কিলোমিটার ব্রডগেজ রেলপথ নির্মাণের কথা ছিল। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বন্দর মংলা ব্রডগেজ রেলওয়ে নেটওয়ার্কের সাথে যুক্ত হতো। চুক্তি অনুযায়ী, মংলায় একটি টার্মিনালের পরিচালন অধিকারও রয়েছে ভারতের।

৩. ঢাকা-টঙ্গী-জয়দেবপুর রেল সম্প্রসারণ প্রকল্প। ১৬০০ কোটি রুপি ভারতীয় সহায়তার এই প্রকল্পটি ২০২৭ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা ছিল। প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছর পর্যন্ত প্রকল্পটির বাস্তবায়ন ৫০ শতাংশের কম হয়েছে।

এছাড়াও, অন্য একটি সূত্র জানিয়েছে যে আরও পাঁচটি আলাদা স্থানে যে স্থান জরিপের কাজ চলছিল, সেগুলোও স্থগিত করা হয়েছে।

ভারতের বিকল্প কৌশল:

প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, ভারত তাদের অভ্যন্তরীণ ও বিকল্প আঞ্চলিক কৌশল পরিবর্তন করছে। দেশটির সরকার ক্ষমতা ও নির্ভরযোগ্যতা বাড়ানোর জন্য উত্তর প্রদেশ ও বিহারে রেললাইন দ্বিগুণ থেকে চারগুণ করার সম্ভাব্যতা যাচাই করছে। রেলওয়ের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, ‘এ জন্য জরিপ চালানো হচ্ছে।’

একই সাথে, ভারত-নেপাল রেল চুক্তি এবং ভুটানের উত্তর-পূর্বে নৈকট্যের মতো বিদ্যমান চুক্তিগুলোকে কাজে লাগিয়ে নয়াদিল্লি, ভুটান ও নেপালের মধ্য দিয়ে রেল সংযোগ স্থাপনের বিকল্প পথ খুঁজছে। এই রুটগুলো বাস্তবায়নের দিক থেকে কিছুটা জটিল হলেও, এই পরিকল্পনা সফল হলে বাংলাদেশের উপর নির্ভরতা কমবে।

উদাহরণস্বরূপ, প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে ভারত ও নেপালের মধ্যে উন্নত সংযোগের পূর্ববর্তী পরিকল্পনায় বিরাটনগর-নিউ মালের মধ্যে ১৯০ কিলোমিটার নতুন লাইন নির্মাণ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এছাড়াও, গালগালিয়া-ভদ্রপুর-কাজলি বাজার সেকশনে আরও ১২.৫ কিলোমিটার নতুন লাইন নির্মাণের বিষয়টিও বিবেচনা করা হচ্ছে।

পশ্চিমবঙ্গের ‘চিকেনস নেক’ অঞ্চলে সংযোগ উন্নত করার লক্ষ্যে কুমেদপুর-আম্বারি ফালাকাটা অংশে ১৭০ কিলোমিটার নতুন রেললাইন নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী, বাংলা এবং বিহারের মধ্যে সংযোগ বৃদ্ধি করতে আরও ২৫ কিলোমিটার নতুন লাইন স্থাপন করা হবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here