‘সংস্কার প্রস্তাবের আলাপ-আলোচনা যতবেশি দীর্ঘায়িত হবে দেশ ততবেশি সংকটে পড়বে’ বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তিনি বলেন, ‘‘ যদি নির্বাচন প্রক্রিয়া দেরি হয়, যদি সংস্কার সংস্কার করে আমরা সংস্কারের আলোচনা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর করতে থাকি তাহলে স্বৈরাচারৃ যেই স্বৈরাচারকে বাংলাদেশের সকল মানুষ, দল-মত নির্বিশেষে, শ্রেনী-পেশা নির্বিশেষে সকল মানুষ একত্রিত হয়ে এদেশ থেকে বিতাড়িত করে দিয়েছেৃ তাহলে সেই স্বৈরাচার সুযোগ পেয়ে যাবে আবার দেশের মানুষের কাঁধে চেপে বসার। কাজেই যে সকল বিজ্ঞ ব্যাক্তিবর্গ, সমাজের বিজ্ঞ ব্যক্তিবর্গ, সন্মান্বিত ব্যক্তিবর্গ যারা সংস্কারের কথা বলছেন আপনাদের সকলের কাছে রাজনৈতিক দলের অবস্থান থেকে আপনাদের কাছে আহ্বান জানিয়ে বলতে চাই, সংস্কার সংস্কার বক্তব্য রেখে এই আলাপ দয়া করে দীর্ঘায়িত করবেন না। কারণ আপনারা সংস্কারের আলাপ যত দীর্ঘায়িত করবেন দেশ ততবেশি সংকটের মুখে পড়বে, আপনারা সংস্কার আলাপ যত দীর্ঘায়িত করবেন দেশে তত ষড়যন্ত্রকারীরা ষড়যন্ত্র করার সুযোগ পাবে।
রোববার (২ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর কদমতলীতে রাষ্ট্র মেরামতে দলটির এক কর্মশালায় তিনি এসব কথা বলেন। ঢাকা মহানগর দক্ষিনের উদ্যোগে শ্যামপুরের কদমতলীর বালুর মাঠে ‘রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের ৩১ দফা ও জনসম্পৃক্তি’ শীর্ষক প্রশিক্ষন কর্মশালা হয়। এতে লন্ডন থেকে ভার্চুয়ারি যুক্ত হন প্রধান অতিথি তারেক রহমান। এতে মহানগর দক্ষিনের ২৪টি থানার বিএনপিসহ ১১টি অঙ্গসংগঠনের কয়েক হাজার নেতা-কর্মী অংশ নেন। রাজধানীর যানজট, পরিবেশ দুষণ, স্বাস্থ্য সেবা, নারীর ক্ষমতায়সহ বিভিন্ন বিষয়ে কয়েকজন নেতা-কর্মীর প্রশ্নের জবাবও দেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান।
তারেক রহমান বলেন, বহু মানুষ ভোটের অধিকারের আদায়ের জন্য হতাহত হয়েছে। জবাবদিহিতা নিশ্চিতে নির্বাচনের বিকল্প নেই। এর মাধ্যমে সমস্যার জট খুলতে শুরু করবে। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার কাজ যত দ্রুত শুরু হবে, ততো দ্রুত দেশকে রক্ষা করা যাবে। তিনি আরও বলেন, স্বৈরাচারের সামনে একমাত্র বিএনপিই সংস্কারের কথা বলেছিল। আড়াই বছর আগেই এই ৩১ দফা দেয়া হয়েছিল। ৩১ দফার সাথে সরকারের সংস্কার প্রস্তাবনায় খুব বেশি ফারাক নেই। এ সময় ১০ টাকা কেজি চাল দেয়ার মতো মিথ্যা আশ্বাস না দিয়ে বাস্তবতার আলোকে মানুষের ভাগ্যের উন্নয়ন করতে চাব বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
নির্বাচন ছাড়া কোনো ভিন্ন পথ নেই মন্তব্য করে তারেক রহমান বলেন, সংস্কারের প্রস্তাবগেুলো যদি বাস্তবায়ন করতে হয় তাহলে সবচাইতে আগে নির্বাচনই প্রয়োজন। নির্বাচনের মাধ্যমে যাদেরকে জনগণ দায়িত্ব দেবে সংস্কারের কাজ তারাই শুরু করতে পারবে, তাদেরকেই শুরু করতেই হবে। কাজেই যত যাই কথা বলি না কেনো আমরা যদি সংস্কার বাস্তবায়ন যত দেরি করব যে কথাটি আমি এখনই বলেছি, সংস্কারের কাজও যদি শুরু করতে হয় সেটি নির্বাচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নির্বাচিত মানুষের মাধ্যমেই বাস্তবায়নের কাজ শুরু করতে হবে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমেই সংস্কার বাস্তবায়নের কাজ শুরু করতে হবে। কারণ যারা নির্বাচিত হয়্ েআসবে তারা জনগণের কাছে ওয়াদাই করবে যে, তারা সুযোগ পেলে বাস্তবায়ন করবে এই সব সংস্কার।
তিনি বলেন, সংস্কারকে যত দ্রুত বাস্তবায়ন করা যাবে দেশকে দেশের মানুষকে তত দ্রুত আমরা বিপদ থেকে রক্ষা করতে পারব। কাজেই আসুন এই সংস্কারকে বাস্তবায়ন করতে হলে উপায় একটাই যে সংস্কার প্রস্তাব বিএনপি দিয়েছে, যে সংস্কার প্রস্তাব অন্তবর্তীকালীন সরকারের কমিশনগুলো তৈরি করে দিয়েছেৃ যেটাই হোক না কেনো এই সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়ন করতে হয় নির্বাচন ছাড়া আর কোনো রাস্তা নাই। একটিই পথ জনগনের নির্বাচন, জনগণের নির্বাচনের নির্বাচন এবং জনগণের নির্বাচন।
তারেক বলেন, আমি মনে করি, নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের কাছে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা যায়ৃ এটা সকলকে অনুধাবন করতে হবে। কোনো কোনো ব্যক্তি বলেন যে, নির্বাচন হলেই কি সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে? আমি বলি, সাথে সাথে সব সমস্যার সমাধান হবে না। কিন্তু নির্বাচন হলে নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের ভোটের মাধ্যমে, জনগণের রায়ের মাধ্যমে যেই দল যেই ব্যক্তি বা যারা দেশ পরিচালনার সুযোগ পাবে তখন সমস্যার যে জট, সমস্যার যে গিট্টু সেগুলো আস্তে আস্তে খোলা যাবে। নেতা-কর্মীদের প্রতি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, আসুন আজকের এই কর্মশালার মাধ্যমে আমার দলের নেতাকর্মী এখানে যারা উপস্থিত আছেন সকলে মিলে আজকে আমরা প্রতিজ্ঞা গ্রহন করি যে, বাংলাদেশের মানুষ ইনশাল্লাহ আমাদেরকে সেই সুযোগ দিলে রাষ্ট্র পরিচালনা আমরা প্রত্যেকে যে যার অবস্থান থেকে যেই সংস্কারের ওয়াদা আমরা জনগণের সামনে দিয়েছি আমাদের প্রত্যেকের অবস্থান থেকে সেই ওয়াদা সর্বোচ্চ পুরনে চেষ্টা করব ইনশাল্লাহ।
তারেক রহমান বলেন, বিএনপি রাজনীতির উদ্দেশ্য হলো বাংলাদেশের জন্য, বাংলাদেশে মানুষের জন্য। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান যখন দায়িত্বভার গ্রহণ করে কতগুলো পরিবর্তন এনেছিলেন তার মধ্যে একটি দুইটি যদি পরিবর্তন আমরা আলোচনা করি। দেশের আইন-শৃঙ্খলা উন্নয়ন ৭৪ সালে দুর্ভিক্ষে বহু মানুষ মারা গিয়েছিল। শহীদ জিয়াউর রহমানের সময় খাল খননের ফলে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছিল যাতে করে খাদ্যের অভাবে আর মানুষ মারা যেতে হয়নি। পরবর্তীতে স্বৈরাচার জোর করে ক্ষমতা দখল করেছিল। আন্দোলন করে স্বৈরাচারী এরশাদকে হটিয়েছে জনগণ। জনগণের ভোটে বিএনপি ৯১ তে ক্ষমতায় দায়িত্ব পেয়ে অনেক সংস্কার করেছে। বেগম খালেদা জিয়ার সরকার নারীদের বিষয়ে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছিল। বেকারদের কর্মসংস্থান হয়েছিল।
তিনি বলেন, বিএনপির লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য হচ্ছে দেশ ও মানুষের সেবা করা। যখন দেশের মানুষ ১৫টি বছর যাবত স্বৈরাচারীর বিরুদ্ধে লড়াই করেছে ভোটের জন্য, বাক স্বাধীনতা অর্জন করার জন্য, অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য। মানুষের চাহিদা, দেশের উন্নয়নের বিষয় বিবেচনায় রেখে বিএনপি প্রথমে ২৭ দফা ঘোষণা করেছিলাম। বর্তমানে অনেক মানুষকে দেখছি তার পরবর্তীতে বিএনপি যাদেরকে নিয়ে স্বৈরাচারীর আন্দোলনে কাজ করেছে তাদেরকে নিয়ে আমরা ৩১ দফা প্রণয়ন করেছি। যারা সংস্কার সংস্কার করছেন প্রতিদিন । এই মানুষগুলোকে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে কথা বলতে দেখিনি। আজকে যারা সংস্কারের কথা বলছেন তাদেরকে আমরা আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ জানাই। অথচ দুই আড়াই বছর আগে বিএনপি বলেছিল সংস্কারের কথা। কারণ আমরা জানতাম স্বৈরাচারের পতন হবে। আমরা আগস্টের ৫ তারিখ সেটা হবে হয়তো সেটা জানতাম না।
কর্মসভায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন আমরা আনতে চাই। দলের ভিতরে আমরা পরিবর্তন আনার চেষ্টা করছি। জনগণ যদি আমাদের সুযোগ দেয় তাহলে আমরা সার্বিকভাবে সেটা করব। সেজন্য আমরা দলমত নির্বিশেষে সহযোগিতা চাই। একই সাথে শুধু রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন আনলে সবকিছু হয়ে যাবে না। দ্রব্যমূল্য লাগামহীনগতি টেনে ধরতে হবে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে জনগণের কষ্ট হচ্ছে। দ্রব্যমূল্য লাগামহীনগতি টেনে ধরতে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশে বহু নারী- পুরুষ বেকার রয়েছেন। শুধু উচ্চকক্ষ করলে সমাধান হবে না। মানুষের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। কৃষকদের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে হবে। শুধু বই খাতা দিলেই হবে না শুধু বিল্ডিং করে দিলেই হবে না। শিক্ষার্থীদের সুশিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। অনেকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে যান। আমরা যদি রোগীদের দেশের মধ্যে চিকিৎসা সেবা দিতে চাই তাহলে চিকিৎসার উন্নয়ন ঘটাতে হবে, ওষুধ পত্রের দাম কমাতে হবে।
তারেক রহমান বলেন, যানজটের সমস্যা একটা ভয়ানক। প্রত্যেকটি মানুষকে যানজটের যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়। এই যানজটকে সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসতে হবে। কাজেই আমাদের উপায় বের করতে হবে। ধুলাবালিতে বায়ু দূষণ ঢাকা বিশ্বের শীর্ষ। দিল্লির সাথে বায়ু দূষণে কম্পিটিশন চলছে। কোনদিন দিল্লি এক নম্বরে ঢাকা দ্বিতীয়, কোনদিন ঢাকা প্রথম দিল্লি দ্বিতীয়। আমি রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে বুঝি জবাবদিহিতা না থাকলে কোন রাষ্ট্র টিকিয়ে রাখা সম্ভব না। আমাদের সংসারেও কিন্তু জবাবদিহিতা থাকে। জবাবদিহিতা ছিলনা বলেই দেশের সম্পত্তি লুটপাট করে বিদেশে পাচার করতে পেরেছে শেখ হাসিনা ও তার দোসরা। যদি সত্যিকার অর্থে মানুষের ভোটে নির্বাচন হতো, ওয়ার্ড কমিশনার নির্বাচন হতো, মানুষের ভোটে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরশনে নির্বাচিত মেয়র হতো তাহলে এসব সমস্যা থাকতো না। আপনারা যে মানুষটিকে নির্বাচন করতেন তিনি সব কিছু দেখতেন আপনাদের সমস্যা থাকতো না। কারন নিবাচিত ব্যাক্তি চিন্তা করতো মানুষের সমস্যার সমাধানের চেষ্টা যদি না করি তাহলে যখন আবার ভোট হবে তখন আমি হেরে যাব। ১৭ বছরে বিএনপিসহ বিরোধী দলের অসংখ্য নেতাকর্মী শহীদ হয়েছেন। গুম খুন হয়েছেন, সারাদেশে দলের লক্ষ লক্ষ মানুষ নির্যাতিত হয়েছে অধিকারের আদায়ের জন্য। জবাবদিহিতা হচ্ছে নির্বাচন, সেটা জাতীয় নির্বাচনই হোক, আর স্থানীয় সরকার নির্বাচনই হোক। একটা নির্দিষ্ট সময়ে নির্বাচন হতে হতে হবে। দশ টাকার কথা বলে ৭০ কেজি টাকা ধরে চাল খাওয়ানো হলে ৫ আগস্ট এর মত অবস্থা হবে। আমরা যদি দেশের ভাগ্য পরিবর্তন করতে চাই, জনগণের ভাগ্য পরিবর্তন করতে চাই, তাহলে অবশ্যই নির্বাচন প্রক্রিয়ার মধ্যে যেতে হবে। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্যে যেতে হবে। যত দ্রুত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নির্বাচিত সরকারের কাছে দায়িত্ব দিতে পারব তত দেশকে ধ্বংস হওয়া থেকে রক্ষা করতে পারব। নির্বাচন হলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে তা আমরা বলিনি। কিন্তু যারা নির্বাচিত হবেন তারা জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য হবেন। নির্বাচিত সরকার হলে সমস্যার জট আস্তে আস্তে খুলতে শুরু করবে। ভোটের অধিকারের জন্য বহু মানুষ জীবন দিয়েছেন, পঙ্গুত্ববরণ করেছেন ভোটের অধিকারের জন্য। লক্ষ লক্ষ মানুষ গত ১৭ বছরে বাংলাদেশে বাংলাদেশের বিভিন্নভাবে নির্যাতিত হয়েছে।
ঢাকা মহানগর দক্ষিন বিএনপির আহ্বায়ক রফিকুল আলম মজনুর সভাপতিত্বে ও সদস্য সচিব তানভীর আহমেদ রবিনের সঞ্চালনায় কর্মশালায় আরো বক্তব্য রাখেন, বিএনপির বানিজ্য বিষয়ক সম্পাদক আলহ্বাজ সালাহউদ্দিন আহমেদ, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা মাহাদী আমিন প্রমুখ।