জনপ্রতি তেল খাওয়া বেড়েছে পাঁচ কেজি, কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা

0
259

খবর৭১ঃদেশে গত চার বছরের ব্যবধানে জনপ্রতি তেল খাওয়ার পরিমাণ বা খাবার তেলের ভোগ প্রায় পাঁচ কেজি বেড়েছে বলে সরকারি এক গবেষণায় উঠে এসেছে।

গবেষণার ফলাফল বলছে, ২০১৫ সালে মাথাপিছু খাবার তেল ব্যবহারের পরিমাণ যেখানে ছিল ১৩.৮০ কেজি, ২০১৯ সালে তা ৩৬ শতাংশ বেড়ে জনপ্রতি ১৮.৭ কেজিতে দাঁড়িয়েছে।
চলতি সপ্তাহে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ‘তেলজাতীয় ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি’ প্রকল্পের জাতীয় কর্মশালায় এসব তথ্য উপস্থাপন করা হয়।

বিশেষজ্ঞদের মতে, খাবার তেলের ভোগ বেড়ে যাওয়া জনস্বাস্থ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত হতে পারে, তবে এ ধরনের তেলের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ার বিষয়টিকে অবশ্য বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বেশ ইতিবাচকভাবেই দেখছেন পুষ্টিবিদরা।

কারণ তারা মনে করেন যে, বাংলাদেশের নিম্নবিত্ত ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ পুষ্টিজনিত রোগে ভুগছে, তাই তাদের পুষ্টি চাহিদা পূরণে তেল খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

বিশেষ করে বাংলাদেশের অধিকাংশ গর্ভবতী মা, শিশুকে দুধ খাওয়ানো মা, বাড়ন্ত শিশু এবং কিশোর-কিশোরীর ওজন স্বাভাবিকের চাইতে কম বলে সরকারি পরিসংখ্যানে দেখা যায়। ফলে, এই জনগোষ্ঠীর জন্য খাবার তেলের ভোগ খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন পুষ্টিবিদ চৌধুরী তাসনীম হাসিন।

কার জন্য কতটা তেল

পুষ্টি চাহিদা পূরণে যেমন পর্যাপ্ত তেল দরকার, তেমনি যারা স্থূলতা, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ কিংবা রক্তচাপের মতো সমস্যায় ভুগছেন তাদেরকে আবার চিকিৎসকের পরামর্শে মেপে মেপে তেল খেতে হবে।

নিজের স্বাস্থ্য পরিস্থিতি বুঝে পরিমিত পরিমাণে তেল খাওয়া বেশ জরুরি। সেক্ষেত্রে চাহিদা যদি বেশি বা কম থাকে, তাহলে তেল খাওয়ার পরিমাণেও কম-বেশি হবে।

এ নিয়ে একটি হিসাব দিয়েছেন চৌধুরী তাসনীম হাসিন:

* ১-৫ বছর বয়সী শিশুদের জন্য দৈনিক ৩-৪ চা চামচ

* ৬ থেকে ১২ বছর বয়সী শিশুদের জন্য ৭-৮ চা চামচ

* ৪০ বছর বয়স পর্যন্ত দৈনিক ৬-৮ চা চামচ

এরপর ৪০ বছরের ঊর্ধ্বে যাদের বয়স, তাদের ক্ষেত্রে তেল গ্রহণের পরিমাণ তার ওজন বুঝে কিছুটা কমিয়ে আনতে হবে। কারণ দৈনিক চাহিদার তুলনায় বেশি তেল খেলে স্বাস্থ্য-ঝুঁকি থাকে।

কোন তেল ভালো, কোনটা ক্ষতিকর

খাবার তেল ও চর্বি মূলত একই ধরনের পদার্থ। স্বাভাবিক তাপমাত্রায় যা তরল থাকে, সেটা তেল আর যেটা অর্ধ জমাট বা পুরো জমাট বেধে যায় সেটা চর্বি।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এখন সব ধরনেই তেলেই চর্বি বা ফ্যাট থাকে। তেল-চর্বি মানেই যে খারাপ, ব্যাপারটি তেমন না। নির্ভর করছে কী ধরনের তেল খাচ্ছেন এবং সেটা কী পরিমাণে।

আমরা যে তেল-চর্বি খেয়ে থাকি, এর মধ্যে কিছু তেল স্যাচুরেটেড এবং কিছু পলি-আনস্যাচুরেটেড। সে হিসেবে খাওয়ার তেল দুই রকম হয়ে থাকে।

১. অ্যানিম্যাল ফ্যাট বা প্রাণীজ তেল

২. ভেজিটেবল ওয়েল বা উদ্ভিজ্জ তেল

প্রাণীজ তেল: যে তেল-চর্বি প্রাণী থেকে আসে যেমন গরু, খাসির চর্বি, ঘি, মাখন, ডালডা ইত্যাদি প্রাণীজ ফ্যাট। এগুলোকে স্যাচ্যুরেটেড ফ্যাটও বলা হয়।

উদ্ভিজ্জ তেল: গাছ, ফুল বা শস্য থেকে যে তেল আসে সেটা উদ্ভিজ্জ তেল। একে পলি-আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটও বলা হয়।

বাংলাদেশের বাজারে প্রচলিত বিভিন্ন উদ্ভিজ্জ তেলের মধ্যে রয়েছে সয়াবিন তেল, সরিষার তেল, ক্যানোলা তেল, জলপাই তেল, রাইস ব্র্যান তেল, সূর্যমুখী তেল, ভুট্টার তেল ইত্যাদি।

তেল খাওয়ার উপকার

খাবারের তেলে রয়েছে মানবদেহের জন্য প্রয়োজনীয় ক্যালোরি, ফ্যাটি অ্যাসিড, ভিটামিনস ও অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট – যা শরীরের নানা ধরনের পুষ্টি স্বল্পতা পূরণ করে থাকে।

ক্যালোরি – আমরা প্রতিদিন যা খাই, তার মধ্যে তেল থেকে সবচেয়ে উচ্চহারে ক্যালোরি পাওয়া যায় বলে জানিয়েছেন চৌধুরী তাসনীম হাসিন। আর এটাই মানব দেহে শক্তি যোগায় বলে তিনি বলেন।

যেমন, এক গ্রাম তেল থেকে ৯ কিলোক্যালোরি শক্তি পাওয়া যায় যেখানে কিনা আমিষ ও শর্করা থেকে পাওয়া যায় চার কিলোক্যালোরি।

সুতরাং দৈনিক শক্তির চাহিদার বড় অংশই পূরণ করছে তেল, জানান মিস চৌধুরী।

ভালো কোলেস্টেরল – ভালো তেল রক্তের এইচডিএল অর্থাৎ শরীরের জন্য উপকারী ভালো কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়ায়।

কারও শরীরে আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট বা খারাপ কোলেস্টেরল এলডিএল বেশি থাকলে সেটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে উদ্ভিজ্জ তেল। এটা হৃদরোগ ও রক্তচাপে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা কমিয়ে দেয়, আর লিভার সচল রাখে।

তাই পলি-আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটযুক্ত উদ্ভিজ্জ তেল খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ।

এক গবেষণায় দেখা গেছে, যে তেলে স্যাচুরেটেড ফ্যাট ৩৫ শতাংশের নিচে এবং আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট ৫০ শতাংশের ওপরে থাকে, সেই তেল প্রতিদিন খাওয়ার জন্য ভালো।

ফ্যাটি অ্যাসিড – উদ্ভিজ্জ তেলে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ফ্যাটি অ্যাসিড, যা ক্যান্সার প্রতিরোধে সাহায্য করে, ত্বক ভালো রাখে, শরীরে বয়সের ছাপ দেরিতে পড়ে এবং চর্মরোগ দূর করে।

যে তেলে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিডের মাত্রা যতো বেশি সেই তেলকে ততো ভালো হিসেবে বর্ণনা করছেন পুষ্টিবিদ মিস চৌধুরী।

তিনি জানান, উদ্ভিজ্জ ভোজ্য তেল স্বাস্থ্যের জন্য ভালো, কিন্তু প্রাণীজ তেল ক্ষতিকর।

ভিটামিন শোষণ – শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় ভিটামিন ‘এ’, ‘ডি’, ‘ই’, ‘কে’ ফ্যাট সলিবল। অর্থাৎ এই ভিটামিনগুলো লিভারে শোষণ হতে তেলের প্রয়োজন।

এজন্যই বলা হয় শাকসবজি বা অন্যান্য খাবারের প্রয়োজনীয় পুষ্টিগুণ পেতে হলে অবশ্যই সেগুলো তেল দিয়ে রান্না করতে হবে।

অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট – তেলে থাকা ভিটামিন-ই অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে থাকে, যা ত্বক, হাড়, দাঁত ও চোখের জন্য বেশ উপকারী।

প্রোটিন – তেলের প্রোটিন মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করে। হরমোনের ভারসাম্য রক্ষা করতেও তেলের প্রয়োজন।

তেল খাওয়ার ক্ষতিকর দিক

খারাপ কোলেস্টেরল – প্রাণীজ তেলে থাকা স্যাচুরেটেড ফ্যাট খুব সহজে রক্তে এলডিএল বা খারাপ কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় এবং এই চর্বি সহজে শরীর থেকে বেরোতে পারে না। ফলে হৃদরোগ, রক্তচাপ, ডায়বেটিস ও স্থূলতার ঝুঁকি বাড়ে।

এছাড়া বাংলাদেশে শহুরে নাগরিকদের মধ্যে ভাজা-পোড়া, ডুবো তেলে ভাজা ফাস্ট ফুড খাবার খাওয়ার প্রবণতা রয়েছে। এগুলোতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে স্যাচ্যুরেটেড ফ্যাট।

এজন্য পুষ্টিবিদরা বলছেন, যেসব তেলে স্যাচ্যুরেটেড ফ্যাটের মাত্রা বেশি, সেগুলো পরিহার করা ভালো।

ট্রান্স ফ্যাট – আবার কেউ উদ্ভিজ্জ তেলেই যদি ডুবো তেলে ভেজে কিছু খান কিংবা একই তেল বার বার ব্যবহার করেন, তাহলে সেই ভেজিটেবল তেল ভেঙ্গে ট্রান্স ফ্যাটে রূপ নেয়, যা শরীরের জন্য খুব ক্ষতিকর।

কায়িক শ্রম – যারা শহরের বাসিন্দা, কায়িক পরিশ্রম কম করেন, স্থূলতায় ভুগছেন, তাদের ক্ষেত্রে এই তেলের প্রভাব ক্ষতিকর হতে পারে।

যারা স্থূলতা, হৃদরোগ, রক্তচাপে ভুগছেন তাদের জন্য যেকোনো ধরনের তেলের পরিমাণই কমিয়ে আনতে হবে।

ব্রিটেনের জাতীয় স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের ৩০ গ্রাম এবং প্রাপ্ত বয়স্ক নারীদের ২০ গ্রামের বেশি স্যাচুরেটেড ফ্যাট খাওয়া ঠিক নয়। শিশুদের ক্ষেত্রে এই হার আরও কম।

এছাড়া ট্রান্স ফ্যাট খাওয়ার মাত্রাও ৫ গ্রামের নিচে নামিয়ে আনতে হবে।

তেল খেতে সতর্কতা

তবে তেলের ক্ষেত্রে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, তেলের স্মোক পয়েন্ট। অর্থাৎ যে তাপমাত্রায় তেল পুড়ে ফ্যাটগুলো ভেঙে যায়, তা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।

তাই কতক্ষণ ধরে রান্না হচ্ছে, সেটা বেশ জরুরি। যেমন, আজকাল অনেকেই স্বাস্থ্য সচেতনতায় অলিভ অয়েল বা জলপাই তেল খাচ্ছেন। কিন্তু অলিভ অয়েলের স্মোক পয়েন্ট অনেক কম হওয়ায় ভাজাপোড়ার ক্ষেত্রে এই তেল উল্টো ফল দিতে পারে।

চৌধুরী তাসনীম হাসিনের মতে, অলিভ অয়েল দিয়ে ১৭ মিনিটের বেশি সময় ধরে রান্না করা ঠিক নয়।

কিন্তু বাংলাদেশে প্রচলিত বেশিরভাগ খাবার রান্না করতে এর চাইতে অনেক বেশি সময় লাগে, ফলে তেল তার কার্যকারিতা হারায়। তাই অলিভ অয়েল খেতে হলে সেটা খাবারে সরাসরি মিশিয়ে খেতে হবে – যেমন সালাদের ড্রেসিংয়ে কিংবা খাবার অল্প আঁচে দ্রুত রান্না করে ফেলতে হবে। এক্ষেত্রে বেশি সময় ধরে রান্নার জন্য উপযোগী হল অন্যান্য ভার্জিন বা রিফাইন্ড তেল। এগুলোর স্মোক পয়েন্ট তুলনামূলক বেশি থাকে। সয়াবিন তেল বা বাজারে প্রচলিত অন্যান্য তেল রান্নার সময় সহজে ভেঙে যায় না।

সম্প্রতি রান্নার জন্য নারিকেল তেলকে বলা হয়েছিল সুপার ফুড। তবে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় এই তেলকে ‘খাঁটি বিষ’ হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়েছে। কারণ নারকেল তেলের ৯০ শতাংশই স্যাচ্যুরেটেড ফ্যাট। আবার পোড়া তেল শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকারক।

কারণ বার বার তেল পুড়লে নতুন বিক্রিয়ায় রাসায়নিক গঠন পরিবর্তিত হয়ে ইউরিক অ্যাসিডসহ বহু বিষাক্ত উপাদান তৈরি হয়, যা থেকে হার্টের ক্ষতি হতে পারে।

তাই পুষ্টিবিদরা বলছেন, পরিমিত তেলে ভাজা খাবার খেতে হবে। অনেক তাপে অনেকক্ষণ ধরে রান্না করা এড়িয়ে যেতে হবে।

ব্রিটেনের ডি মন্টফোর্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের লেস্টার স্কুল অফ ফার্মাসি এক গবেষণা চালিয়ে দেখেছে যে উচ্চ তাপমাত্রায় (১৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার বেশি) রান্না করলে তেলচর্বিতে থাকা অনুর গঠন বদলে যায়।

বাতাসের অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া করে বা অক্সিডেশন হয়। সেখান থেকে উৎপন্ন হয় অ্যালডিহাইডস এবং লিপিড পার অক্সাইড।

অ্যালডিহাইডস নিঃশ্বাস বা খাবারের সাথে অল্প পরিমাণে গ্রহণ করলেও সেটা হৃদরোগ ও ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।

গবেষকদের মতে, সূর্যমুখী তেল ও ভুট্টার তেলে উচ্চতাপে রান্না করলে অনেক বেশি হারে অ্যালডিহাইডস উৎপন্ন হয়। তবে অল্প তাপে অল্প সময়ের জন্য রান্না করলে আতঙ্কের কিছু নেই বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। আবার মাখন প্রাণীজ ফ্যাট হলেও এতে অ্যালডিহাইডস উৎপন্নের মাত্রা অনেক কম।

এক্ষেত্রে গবেষকরা পরামর্শ দিয়েছেন, সম্ভব হলে টিস্যু বা শোষক কাগজ দিয়ে ভালো ভাবে ভাজা খাবারের তেল ছেকে খেতে হবে। তরকারির ওপরে তেলের আস্তর তুলে ফেলে দেয়া যেতে পারে। বাজারে প্রচলিত বিভিন্ন ব্র্যান্ডের নানা ধরনের উদ্ভিজ্জ তেল পাওয়া যায় যেগুলোর মধ্যে আকাশ পাতাল কোন পার্থক্য নেই বলছেন চৌধুরী তাসনীম হাসিন।

একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ তেলে চর্বির পরিমাণ এক হলেও ক্যালোরি ও ফ্যাটি অ্যাসিডে হালকা তারতম্য হয়। যা অন্য খাবার দিয়ে পূরণ করে নেয়া সম্ভব। তাই মিস চৌধুরীর মতে, কোন তেল খাচ্ছেন সেটার চাইতে জরুরি হল, কতটুক খাচ্ছেন, কীভাবে খাচ্ছেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here