নিরাপদ নগর নিয়ে যুবনারীদের ভাবনা

0
228

রেনেকা আহমেদ অন্তু: আমাদের দেশে হরহামেশাই নারীদের পাবলিক কিংবা ওপেন স্পেসে নানা বৈষম্যের শিকার হতে হয়। নারীরা নিজেদের পেশাগত কাজের তাগিদে প্রায়শই পাবলিক স্পেসে যাচ্ছেন, তবে সেখানেও তাকে রোজ হতে হচ্ছে নানা সমস্যার শিকার। কখনো মৌখিকভাবে নারীরা হ্যারাসমেন্টের শিকার হচ্ছেন, কখনো বা হচ্ছেন শারীরিকভাবে। কখনো বা অনেক নারী মেনেই নিতে বাধ্য হচ্ছেন যে- “পাবলিক স্পেসে তো একটু ইভটিজিং ও মৌখিক যৌনসন্ত্রাসের শিকার তো হতেই হয়।” যৌন নির্যাতন নিয়ে আদালতের নির্দেশনা থাকলেও, নেই কোন সুস্পষ্ট পলিসি। নগরের মানুষের মধ্যকার জেন্ডার ভিত্তিক অসমতা এবং এবিষয়ে যুবনারীদের ভাবনা জানতেই সাহসী কন্যা, সেফার সিটিস কাম্পেইনের অংশ হিসেবে ভার্চুয়াল (জুমে) গোলটেবিল আলোচনার আয়োজন করে। আলোচনাটির সঞ্চালনায় ছিলেন- রেনেকা আহমেদ অন্তু এবং আলোচক হিসেবে যুক্ত ছিল রাজধানীর বিভিন্ন পাবলিক স্পেস নিয়মিত ব্যবহার করা পনেরজন (১৬-৩০ বছরের) যুবনারী। এদের মধ্যে চারজন ছিলেন কিশোরী এবং এগারজন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী।

নারীর স্বাধীনতা

আলোচনায় “নগরের ওপেন স্পেসে নারীদের প্রবেশাধিকারের কথা” জানতে চাওয়া হয়। জানতে চাওয়া হয়- “এসব সুবিধাভোগে কি নারীদের কেবল নিজেদের জেন্ডার পরিচয়ের জন্য কোনো বিশেষ সমস্যা পোহাতে হয় কিনা?” আলোচকরা এক এক করে বিভিন্ন পাব্লিক/ ওপেন স্পেসে নারীদের দিনের বিভিন্ন সময়ে স্বাধীন প্রবেশাধিকার না থাকার অলিখিত বাস্তবতার কথা জানান। এসময় আলোচক এক যুবনারী, ওপেন স্পেসে যাবার পূর্বে নারীদের পাওয়া কিছু পারিবারিক নিষেধাজ্ঞার কথা জানান। তিনি তার বক্তব্যে উল্লেখ করে পরিবার থেকে কেন নারী এবং কন্যাশিশুদের বাহিরে যাবার বেলায় জেন্ডার বৈষম্যের শিকার হতে হয় সেই অনিরাপত্তার বাস্তবতার কথাও। আরেক আলোচক ওপেন স্পেসে নারীদের দৃশ্যতা/উপস্থিতি কম থাকার কথা উল্লেখ করেন। বলেন – রাতে, দুপুরে, ভোরে নারীর নির্জন পথে চলাচলের অনিরাপত্তার কথা। এ পর্যায়ে আরেক আলোচক জানান- সামাজিক কিছু অলিখিত নিয়মাবলীর কথা। জানান যে –“সমাজ সবসময় বিনোদনের জন্য নারীর বাহিরে যাওয়াকে এক প্রকার ‘মন্দ’ ব্যাপার বলেই শিখিয়ে এসেছে। তাই নগরের পার্ক, খেলার মাঠগুলো নারীবান্ধব হয় খুব কম। নেই গর্ভবতী নারীদের জন্য কোনো বিশেষ সুবিধা।” এসময় সকল আলোচকরাই নগরে খেলাধুলার জন্য নারীবান্ধব ওপেন স্পেসের অনুপস্থিতির কথা জানান। অনেকে সরাসরি খেলা দেখার উদ্দেশ্যে দর্শক হওয়ার নানা মন্দ অভিজ্ঞিতার কথাও অকপটে ব্যক্ত করেন। আলোকপাত করেন, রোজ নগরেরে পদেপদে হাজারো নারীর মৌখিকভাবে যৌন সন্ত্রাসের শিকার হবার ঘটনাগুলোর ওপর। আলোচনায় অংশগ্রহনকারী হিসেবে তিনজন কিশোরীও উপস্থিত ছিলেন। তারা নগরে কিসোরীদের চলাচলের সময় নানাধরনের ইভটিজিং এর শিকার হবার ঘটনাগুলো জানান। তাদের নানা স্বেচ্ছাসেবী কার্যক্রমে অংশগ্রহনের সময়ও বিভিন্ন সামাজিক বাধার সম্মুখীন হতে হয় তাও উল্লেখ করেন। তারা বলেন- “সমাজ যেনো ধরেই নেয় যে মেয়ে কিংবা নারী মাত্রই সে মূলত ঘরে থাকবে। একান্ত বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া তাদের পাবলিক স্পেসে যাওয়াটা অপ্রয়োজনীয়। খেলাধুলা-বিনোদনের জন্য ছেলেদেরই বাহিরে যাওয়াটাই শোভনীয়।” পাবলিক স্পেসে নারীর সমঅধিকার নিয়ে কথা বলার সময় আলোচকরা- শপিংমলে, সিনেমা হলে, পার্ক, খেলার মাঠ, ইত্যাদি স্থানগুলোতে নারীদের উপস্থিতিকে সমাজের চোখে “অপ্রয়োজনীয়” ভাবার মতো পুরুষতান্ত্রিক প্রথার কথা জানান। আলোচকদের ভাষ্যমতে- “যদিও এখন নারীরা বাহিরে আগের দশকের তুলনায় সংখ্যায় বেশি বের হচ্ছে, তবে আজো সমাজ নারীর বাহিরের চলাচলকে মেনে নিতে শিখে নি। তাই বর্তমানেও সমাজে বেশিরভাগ মানুষ নারীদের পোশাককে যৌনহয়রানির অন্যতম কারন বলে বিশ্বাস করে। জায়েজ ভাবে রাতে বাহিরে থাকা নারীর চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলার মত কাজকে।” নারীরা কিভাবে নিজেদের পোশাক-পরিচ্ছদের বিভিন্ন দ্রব্য (অন্তর্বাস) ক্রয়ের সময়ও প্রতিনিয়ত হ্যারাসমেন্টের শিকার হন সেই অভিজ্ঞতাগুলোও আলোচনায় যুবনারীদের কাছ থেকে উঠে আসে। নগরের ওপেনস্পেসগুলোকে নারীবান্ধব গড়ে তোলার জন্য পাবলিক টয়লেটকেও আলোচনায় গুরুত্বপূর্ন বলে দাবি করা হয়।

গনপরিবহনে নারীর বাস্তবতা

আলোচকরা গণপরিবহন ব্যবহারের ক্ষেত্রে জেন্ডার বৈষম্যের কথা জানান। আলোচকরা জানান- আমাদের নগরের গণপরিবহনগুলো মোটেও নারীবান্ধব নয়। আমাদের গণপরিবহনে যদিও নয়টি সিট সংরক্ষিত থাকে নারী-শিশু এবং প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য, কিন্তু অনেক সময় এসব সিটে নারীরা বসার সুযোগ পায় না। ভার্চুয়াল গোলটেবিল আলোচনায় এপর্যায়ে তিনজন আলোচক সম্মিলিতভাবে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার জের ধরে আরো বলেন, “আমাদের নগরের গণপরিবহনে নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণের উদ্দেশ্যেই সংরক্ষিত আসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এমতাবস্থায়, এমন বাস্তবতা হরহামেশাই চোখে পড়ে যেখানে গাড়ির চালক এবং গাড়ির অন্যান্য যাত্রীরা ধরেই নেন যে, সংরক্ষিত আসন পুরন হবার পর আর কোনো বাড়তি নারীযাত্রীর গণপরিবহনে ওঠার প্রয়োজনীয়তা নেই”। এ বিষয়ে অন্যান্য আলোচকরাও একমত প্রকাশ করেন। এসময় একজন আলোচক বলেন- “আমাদের সমাজের অনেকে এখন পর্যন্ত ইতিবাচক জেন্ডার বৈষম্য অর্থাৎ কেন নারীদের বিশেষ সুবিধা প্রয়োজন গণপরিবহনে ব্যবহারের ক্ষেত্রে সেই ধারণাটি পরিষ্কারভাবে অনুধাবন করতে সক্ষম না। এর জন্য সবার প্রথমে যেটা দরকার তা হল- প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নৈতিক মূল্যবোধ চর্চার গুরুত্ব প্রদর্শন অর্থাৎ সকল মানুষকে পরিবার, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই শিখে আসা প্রয়োজন যে, নারী-পুরুষ একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী নয় বরং দুপক্ষই সমাজের সকল সুযোগ-সুবিধা ভোগের এবং দায়িত্ব গ্রহণের সমান অধিকার পাবার যোগ্য” এক্ষেত্রে আলোচকরা নৈতিক মূল্যবোধ তৈরীর জন্য বিভিন্ন ক্যাম্পেইন এবং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় নৈতিকমূল্যবোধ চর্চাকে গুরুত্বপূর্ণ বলে অভিহিত করেন। পাবলিক গণপরিবহনগুলোতে নারী শিক্ষার্থীরা যখন অর্ধেক (হাফ) ভাড়া দিতে চান; সেসময়ের নানা অপ্রীতিকর অভিজ্ঞতার কথাও আলোচনায় উঠে আসে। আলোচকরা বলেন যে- যেকোন গণপরিবহনে নারী যাত্রীদের যত হরহামেশা- “সংরক্ষিত আসনে জায়গা নাই আর কোন নারী যাত্রী নিব না” কিংবা “মহিলা মানুষ এত চিল্লাচিল্লি করে গাড়িতে উঠেছেন তবুও হাফ ভাড়া দিচ্ছেন” ইত্যাদি অস্বস্তিকর বাক্য শুনতে হয়, তেমনটা কখনোই কোনো পুরুষ যাত্রীদের প্রতিদিনকার জীবনে নিয়মমাফিক শুনতে হয় না।

আইন ও মূল্যবোধ

আলোচনার শেষ পর্যায়ে সকলেই একত্রে সমাজের ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্য আইনের সুশাসনকে গুরুত্বপুর্ণ বলেন। যুবনারীরা জানান- রাষ্ট্রের সুস্পষ্ট যৌন সন্ত্রাস বিরোধী আইন ও পলিসি নারীদের ওপেনস্পেসে স্বাধীনতা নিশ্চিকরনে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে সক্ষম। আলোচনার শেষ পর্যায়ে সকল আলোচকদের কাছেই জানতে চাওয়া হয়- “নিরাপদ নারীবান্ধব শহরের এমন একটি বৈশিষ্ট্যের কথা যা সাধারনত প্রত্যেক যুবনারীই একটি শহরকে নিরাপদ শহর ভাবার জন্য আবশ্যক মনে করেন”। এমতাবস্থায় সকল আলোচকদের কাছ থেকে সম্মিলিতভাবে যে তিনটি বিষয় উঠে এসেছে তা হল-

ক) সুস্পষ্টভাবে যৌনসন্ত্রাস বিষয়ক আইন প্রনয়ন ও এর বাস্তবায়ন, খ) নৈতিক মূল্যবোধের মাধম্যে নারীর ওপেন স্পেস ব্যবহারের দৃশ্যকে একটি স্বাভাবিক ব্যাপার বলে ভাবতে জানা এবং গ) নগরের গণপরিবহন এবং ওপেন স্পেসগুলো নারীদের ব্যবহার উপযোগী হিসেবে ডিজাইন করা এবং ওপেন স্পেসের সুবিধা ভোগের জন্য নারীদের যেসব প্রাসঙ্গিক সুযোগ সুবিধা-থাকার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে সেগুলো কে “প্রিভিলেজ” না মনে করে “পজিটিভ জেন্ডার ডিসক্রিমিনেশন” এর উদাহরণ হিসেবে সমাজের সকলকে বিশেষত পুরুষ সদস্যদের ভাবতে শেখানোর প্রক্রিয়াকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়েছে।

সবশেষে আলোচকরা আহ্বান করেন- প্রতিটি স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি, সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং প্লাটফর্ম তথা সমাজের প্রত্যেকটি স্তরের মানুষকেই নারীবান্ধব নগরায়নের গুরুত্ব অনুধাবন করতে হবে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে সোচ্চার হতে হবে। নারীবান্ধব নগর কেবল নারীদেরই নয় বরং দেশের সকলের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে।

লেখক- রেনেকা আহমেদ অন্তু, নৃবিজ্ঞানের বিভাগের শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here