আব্দুল্লাহ আল ইমরান,বাগেরহাট:
জাতীয় দলে যখন খেলার সুযোগ পাই, ভেবেছিলাম মা-ভাইকে অন্তত না খেয়ে থাকতে হবে না। মাথা গোজার জীর্ণ বাড়িটা এবার একটু শক্তপোক্ত করে নিতে পারবো। কিন্তু আমাদের ভাগ্যটাই খারাপ। তাই না হলে আমার মা-ভাইকে এখনো না খেয়ে থাকতে হবে কেনো। ঘরে খাবার নেই তা বলতেও লজ্জা লাগে। এভাবেই নিজের হতাশা প্রকাশ করছিলেন বাংলাদেশ শারীরিক প্রতিবন্ধী ক্রিকেট দলের ওপেনিং ব্যাটসম্যান মোঃ ইকবাল হোসেন। বাগেরহাট জেলার মোরেলগঞ্জ উপজেলার মধ্যকালিকাবাড়ি গ্রামের মৃত মোঃ ইলিয়াস হোসেন খানের ছেলে ইকবাল হোসেন।
ইকবাল হোসেন দেশ-বিদেশের একাধিক আন্তঃর্জাতিক খেলায় অংশগ্রহন করেছেন। পেয়েছেন অনেক পুরস্কার। দেশের জন্য বয়ে এনেছেন সম্মান। তবে দেশের জন্য সন্মান আর নিজে অসংখ্যা পুরষ্কার পেলেও আর্থিক স্বচ্ছলতা আসেনি ইকবালের পরিবারে। চরম আর্থিক সংকটে মা ও মানসিক প্রতিবন্ধী ভাইকে নিয়ে অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটে ইকবালের।
বাংলাদেশ শারীরিক প্রতিবন্ধী ক্রিকেট দলের ওপেনিং ব্যাটসম্যান ২৮ বছর বয়সী মোঃ ইকবাল হোসেন বলেন, দেড় বছর বয়সের সময় পোলিও জ্বরে আক্রান্ত হই। এরপরে পক্ষাঘাতগ্রস্থ (প্যারালাইজড)হয়ে পড়ি। কয়েক বছর পরে কিছুটা সুস্থ হলেও বাম পায়ের শক্তি কমতে থাকে আমার। বাম-পায়ের উড়ু থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত চিকুন হতে থাকে। যার ফলে স্বাভাবিক চলাফেরার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলি। বন্ধুদের দেখতাম ক্রিকেট খেলতে। আমি মাঠে গেলে অনেকে উপহাস করতো। তবু আমি খেলা চালিয়ে যেতাম। বাড়িতে বসে একা একাও অনুশীলন করতাম। কিন্তু আমি দরিদ্র পরিবারের সন্তাান। দিন যত যেতে থাকে পরিবারের কাছে বোঝা হয়ে উঠতে থাকি। ২০১৬ সালে জাতীয় দলে চান্স পাই। কিন্তু অর্থাভাবে বাধ্য হয়ে ২০১৮ সালে খুলনার গল্লামারী এলাকায় জাকির নামের একটি খাবার হোটেলে কাজ শুরু করি। হোটেলে কাজ করে মা ও মানসিক প্রতিবন্ধী ছোট ভাইয়ের ভরন পোষন চালাতাম। করোনার মধ্যে সব টুর্নামেন্ট বন্ধ হয়ে যায় এবং হোটেলের কাজও চলে যায় আমার। ৪-৫ বছরে দেশ-বিদেশে একাধিক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট খেলেছি। জাতীয় দলের খেলোয়াড় হয়েও আমার পরিবারের কষ্ট দূর হয়নি। বাবা মারা গেছে প্রায় ২০ বছর আগে। ভাঙ্গাচোরা ছোট একটি ঘর ছাড়া আমাদের কোনো সহায়-সম্পদও নেই, উপার্জনের উপায়ও নেই।
জাতীয় দলে চান্স পাওয়া প্রসংগে ইকবার বলেন, ২০১৬ সালে একটি পত্রিকায় বাংলাদেশ শারিরীক প্রতিবন্ধী ক্রিকেট টিমের জন্য ক্রিকেটার চেয়ে বিজ্ঞাপন দেয়। বিজ্ঞাপন দেখে আমি আবেদন করি। প্রায় ৫ হাজার প্রতিবন্ধী ছেলেদের সাথে প্রতিযোগিতা করে বাংলাদেশ শারিরীক প্রতিবন্ধী ক্রিকেট টিমে চান্স পাই। এরপরে বাংলাদেশ শারিরীক প্রতিবন্ধী ক্রিকেট টিমের হয়ে দেশের বাইরে ও ভিতরে একাধিক আন্তর্জাতিক সিরিজ ও লিগ খেলেছি।
সুযোগ-সুবিধা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে ইকবাল বলেন, জাতীয় দলের খেলোয়াড় হলেও আমাদের সুযোগ সুবিধা এত নগন্য যা বলার মত নয়। যদিও আমাদের এই টিমকে পরোক্ষভাবে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) ও বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (বিকেএসপি) তত্ত্বাবাধায়ন করে। তবে আমরা তেমন কোন বেতন ভাতা বা সুযোগ সুবিধা পাইনা।
ইকবাল হোসেনের মা মোমেনা বেগম বলেন, স্বামী মারা যান ২০০২ সালে। দুই প্রতিবন্ধী ছেলে ও চার মেয়েকে নিয়ে জীবন যুদ্ধে নামি। দিনের পর দিন কোনোরকম খেয়ে না খেয়ে থেকেছি। অনেক কষ্টে চার মেয়েকে বিয়ে দেই। বড় ছেলে ইকবাল যখন প্রতিবন্ধী ক্রিকেট টিমে খেলা শুরু করে তখন ভেবেছিলাম, আমাদের সংসারে স্বচ্ছলতা আসবে। ছেলে আজ ৪-৫ বছর ধরে খেলছে, কিন্তু ভাঙ্গা ঘর ভাঙ্গাই রয়েছে। ঠিকমত খাবার জোটে না তিন বেলা। থাকার মত একটি ভাল ঘরও নেই আমাদের। একজন মানুষ আসলে বসতে দিব এজন্য একটি চেয়ার পর্যন্ত নেই। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রতিবন্ধী সন্তানদের জন্য একটু সাহায্য চাই, ওদের তো যাওয়ার কোনো জায়গা নেই বলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন তিনি।
ইকবালের প্রতিবেশী ও স্থানীয় মোঃ হাসিব খান, জাহিদুল ইসলাম, খলিল খান বলেন, ইকবাল আমাদের এলাকার গর্ব। সে কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশ শারীরিক প্রতিবন্ধী ক্রিকেট দলের ওপেনিং ব্যাটসম্যান হিসেবে খেলছে। কিন্তু ইকবালের আর্থিক অবস্থা এতটাই খারাপ যে মা ও ভাইকে নিয়ে ঠিকমত খেতেও পারে না। জাতীয় পর্যায়ের একজন প্রতিবন্ধী ক্রিকেটারের করুণ অবস্থা দেখে আমাদেরও কষ্ট হয়। সরকারের কাছে ইকবালের পরিবারের তিন বেলা খাওয়ার ব্যবস্থা ও থাকার জন্য একটি ঘর করে দেওয়ার দাবী জানান তারা।
মোরেলগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এ্যাড. শাহ-ই-আলম বাচ্চু বলেন, ইকবালের বিষয়টি আমি জেনেছি। তার দুরবস্থার কথা শুনে উপজেলা পরিষদের পক্ষ থেকে করোনাকালীন সময়ে গত বছর খাদ্য সহায়তা দিয়েছিলাম। আমরা তার উজ্জল ভবিষ্যৎ কামনা করি। আমরা চাই সে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ভালো খেলে বাগেরহাট তথা দেশের সম্মান বৃদ্ধি করুক। উপজেলা পরিষদ ইকবালের পাশে থাকবে।
বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক ও জেলা ক্রীড়া সংস্থার সভাপতি আ.ন.ম ফয়জুল হক বলেন, আমরা শুনেছি ইকবাল একজন ভালো খেলোয়াড়। সে আমার সাথে দেখা করেছে। তাকে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার জন্য আমরা চেষ্টা করছি। পাশাপাশি খেলাধুলার জন্য প্রয়োজনীয় বিষয়ে ইকবালকে সহযোগিতারও আশ্বাস দেন তিনি।