লাইসেন্স নেই সাড়ে ৭ লাখ চালকের

0
292
লাইসেন্স নেই সাড়ে ৭ লাখ চালকের

খবর৭১ঃ

সারা দেশে ৮৬ দশমিক ৩৩ শতাংশ দুর্ঘটনার প্রধান কারণ চালকের বেপরোয়া গতি। ভুল ওভারটেকিংয়ের কারণে ঘটে আরও ৪ দশমিক ৩৬ শতাংশ দুর্ঘটনা। সবমিলিয়ে সড়ক দুর্ঘটনার ৯০ দশমিক ৬৯ ভাগের জন্যই দায়ী চালক। পুলিশের অভ্যন্তরীণ পরিসংখ্যানে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

তাদের হিসাব অনুযায়ী, গত ৫ বছরের মধ্যে ২০১৯ ও ২০২০ সালে সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েছে। চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত ৩ হাজার ৩৭২টি দুর্ঘটনা ঘটে। এতে মারা গেছেন ৩ হাজার ১৯৭ জন ও আহত হয়েছেন ৩ হাজার ১৬৩ জন। এর আগে ২০১৯ সালে সারা দেশে ৪ হাজার ১৪৭টি দুর্ঘটনায় ৪ হাজার ১৩৮ জন নিহত ও ৪ হাজার ৪১১ জন আহত হন। যদিও বেসরকারি সংগঠনগুলোর হিসাবে হতাহতের সংখ্যা আরও বেশি। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

সূত্র জানায়, সড়ক-মহাসড়কে বিপুলসংখ্যক যানবাহন চলছে লাইসেন্সবিহীন চালক দিয়ে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) হিসাব অনুযায়ী, অক্টোবর পর্যন্ত সারা দেশে নিবন্ধিত গাড়ির সংখ্যা ৪৪ লাখ ৯৪ হাজার ৪২০। এসব গাড়ির বিপরীতে লাইসেন্সধারী চালকের সংখ্যা ৩৭ লাখ ৬৩ হাজার ১৭৪। ৭ লাখ ৩১ হাজার ২৪৬টি গাড়ির বৈধ কোনো চালকই নেই।

এর বাইরে অনেক অনিবন্ধিত ছোট-বড় গাড়িও রাস্তায় চলছে। সেগুলোতেও লাইসেন্সধারী চালক নেই। এসব গাড়ির সঠিক পরিসংখ্যান পুলিশ ও বিআরটিএর কাছে নেই। এদের কারণে সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েই চলছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

তবে এককভাবে চালকের দায় মানতে নারাজ পরিবহন শ্রমিক নেতারা। এ বিষয়ে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের মহাসচিব ওসমান আলী যুগান্তরকে বলেন, ১০৫ কারণে সড়কে দুর্ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে পাঁচটি কারণ চালকের সঙ্গে সম্পৃক্ত। সেগুলো হচ্ছে- ওভারটেকিং, ওভারস্পিড, ওভার কনফিডেন্স, ওভারলোড ও মোবাইল ফোন।

তিনি বলেন, চালক ট্রেনিং স্কুল ১২০টির মধ্যে ৮০টি সচল। বাকিগুলো বন্ধ। বিআরটিসির ২৪টি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের মধ্যে ১৪টিই বন্ধ। চালকদের প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা বাড়াতে সরকার কোনো ভর্তুকি দেয়নি। এ খাতে ভর্তুকি দিলে দুর্ঘটনা কমে আসত।

জানা গেছে, চালকের অদক্ষতা, অবহেলা, ক্লান্তি ও বেপরোয়া মনোভাবের কারণে সড়কে দুর্ঘটনা কমছে না। দুর্ঘটনায় প্রাণহানি হলে সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ এর ৯৮ ও ১০৫ ধারায় মামলা হয়। আইনটির ৯৮ ও ১০৫ ধারায় বেপরোয়া ও নিয়ন্ত্রণহীন গাড়ি চালানোর কারণে জীবন ও সম্পত্তির ক্ষতিসাধনের কথা বলা আছে। ৯৮ ধারায় ৩ বছর জেল বা ৩ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয়দণ্ড এবং ১০৫ ধারায় ৫ বছরের জেল ও ৫ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয়দণ্ডের বিধান রয়েছে। সংশ্লিষ্টদের মতে, দুর্বল আইন দিয়ে চালকদের বেপরোয়া গতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়।

পুলিশের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ৫ বছরের মধ্যে ২০১৯ সালে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটে। এরপরের অবস্থানে আছে ২০২০ সাল। ২০১৯ সালে সারা দেশে আইন লঙ্ঘনের দায়ে ৩৩ লাখ ৯৮ হাজার ৯৭১টি গাড়ির বিরুদ্ধে মামলা করে পুলিশ। এতে ১৬৬ কোটি ৪১ লাখ ৮৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। ২০১৮ সালে ২ হাজার ৬০৯টি দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ২ হাজার ৬৩৫ জন ও আহত হয়েছেন ১ হাজার ৯২০ জন। ২০১৭ ও ২০১৬ সালে দুর্ঘটনা আরও কম ছিল।

এ বিষয়ে বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউটের (এআরআই) সহকারী অধ্যাপক কাজী মো. সাইফুন নেওয়াজ যুগান্তরকে বলেন, সড়কে দুর্ঘটনা কমিয়ে আনতে ১১১টি সুপারিশ করা হলেও তা এখনও বাস্তবায়ন হয়নি। মিটিংয়ে এসব সুপারিশ সীমাবদ্ধ। এছাড়া সব জায়গা ও সবার জন্য আইন সঠিকভাবে প্রয়োগ হচ্ছে না। এতেও চালকরা বেপরোয়া হয়ে উঠছেন। তিনি বলেন, সড়ক ইন্সপেকশন, গাড়ি চলাচল ২৪ ঘণ্টা নজরদারিতে আনতে হবে। তাহলে চালকরা সচেতন থাকবেন।

সড়ক দুর্ঘটনার কারণ, ধরন, স্থান, আবহাওয়া, মামলাসহ বিভিন্ন তথ্য বিশেষ সফটওয়্যারে এন্ট্রি করছে পুলিশ। চলতি বছর থেকে নিজস্ব তত্ত্বাবধানে এ কার্যক্রম শুরু হয়। এখনও সব তথ্য এ সফটওয়্যারে ইনপুট দেয়া হয়নি। গত সপ্তাহ পর্যন্ত ৪৬০টি ঘটনার তথ্য ওই সফটওয়্যারে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বেপরোয়া গতির কারণে ৬০ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটছে। ২৬ দশমিক ৭৪ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটছে মাত্রাতিরিক্ত গতির কারণে। আর ৪ দশমিক ৩৬ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটছে ভুল ওভারটেকিংয়ের কারণে। এছাড়া চালকের ক্লান্তি, পথচারী, সড়কের অবকাঠামো, অতিরিক্ত মাল পরিবহন ও আবহাওয়ার কারণে বাকি দুর্ঘটনা ঘটে।

পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, দুর্ঘটনার জন্য সড়কের অবকাঠামো ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনাও অন্যতম দায়ী। শহরে ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট ভালো থাকায় দুর্ঘটনা কম হয়। দূরপাল্লার সড়কে বেশি দুর্ঘটনা ঘটে। রোড ডিভাইডার আছে এমন সড়কে দুর্ঘটনার ৮ দশমিক ২ শতাংশ। অপরদিকে রোড ডিভাইডার ও ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ নেই এমন রাস্তায় দুর্ঘটনার হার ৫৯ দশমিক ২ শতাংশ।

সংশ্লিষ্টরা জানান, মনিটরিং না থাকায় এসব সড়কে চালকের বেপরোয়া গতি ও মনোভাবের কারণে বেশি দুর্ঘটনা ঘটে। এছাড়া পুলিশ নিয়ন্ত্রিত এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনার হার ১৩ দশমিক ৮ শতাংশ ও ট্রাফিক বাতি নিয়ন্ত্রিত এলাকায় ১ শতাশ দুর্ঘটনা ঘটে। বাকিগুলো অন্যান্য কারণে ঘটে। আরও দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশি ৬৬ শতাংশ ৭০ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটে ন্যাশনাল হাইওয়েতে। দুই লেনের সড়ক ও ডিভাইডার না থাকায় এসব সড়কে মুখোমুখি সংঘর্ষ বেশি হয়। এছাড়া রিজিওনাল সড়কে ১৮ দশমিক ৪ শতাংশ, ফিডার রোডে ৪ দশমিক ২ শতাংশ, গ্রাম্য পথে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ ও অন্যান্য কারণে ৩ দশমিক ৮ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটছে।

ভারি গাড়ি বেশি দুর্ঘটনা ঘটায় : পুলিশের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ভারি গাড়ি যেমন বাস, মিনিবাস, ট্রাকের কারণে বেশি দুর্ঘটনা ঘটে। ভারি ট্রাকের কারণে ১৫ শতাংশ, বাসের কারণে ১০ দশমিক ৫০ শতাংশ এবং ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যানের কারণে ৪ দশমিক ১০ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটেছে।

বিআরটিএ সূত্রে জানা গেছে, অক্টোবর পর্যন্ত ভারি গাড়ির সংখ্যা ২ লাখ ৬৪ হাজার ৩৪৪টি। এর বিপরীতে চালক আছে ১ লাখ ৫ হাজার ৭৪৬ জন। এ হিসাবে ভারি গাড়ি চালানোর জন্য ১ লাখ ৫৮ হাজার ৫৯৮ জন চালকের সংকট আছে। নিয়ম অনুযায়ী, কর্মঘণ্টা ঠিক রাখতে ভারি গাড়িতে দু’জন চালক থাকার কথা। অথচ পরিসংখ্যান মতে, একজন করেও চালক নেই এসব গাড়িতে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, পরিবহন মালিক ও চালকদের চাপের মুখে মধ্যম আকারের গাড়ি চালকেরা বর্তমানে ভারি গাড়ি ও হালকা যানের চালকেরা মধ্যম ধরনের গাড়ি চালাচ্ছেন। চলতি ডিসেম্বর পর্যন্ত এ সুযোগ দেয়া হয়েছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here