‘এখানে যদি টাকা না দেয়, আমাদের একজন একজন করে মেরে ফেলতে বলেছে। তাদের যত তাড়াতাড়ি টাকা দেবে, তত তাড়াতাড়ি ছাড়বে বলেছে’ ভারত মহাসাগরে সোমালিয়ার জলদস্যুদের হাতে জিম্মি বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহর প্রধান কর্মকর্তা (চিফ অফিসার) মোহাম্মদ আতিক উল্লাহ খানের অডিওবার্তার অংশ এটি।
মঙ্গলবার (১২ মার্চ) মাগরিবের পর হোয়াটসঅ্যাপে নিজের স্ত্রীর কাছে পাঠানো একটি অডিওবার্তায় আতিক উল্লাহ এসব কথা বলেছেন। বার্তাটি সবাইকে জানিয়ে দেওয়ার অনুরোধ জানান তিনি।
অডিও বার্তায় আতিক উল্লাহ খান বলেছেন, ‘এই বার্তাটা সবাইকে পৌঁছে দিয়ো। আমাদের কাছ থেকে মোবাইল নিয়ে নিচ্ছে। ফাইনাল কথা হচ্ছে, এখানে যদি টাকা না দেয়, আমাদের একজন একজন করে মেরে ফেলতে বলেছে। তাদের যত তাড়াতাড়ি টাকা দেবে, তত তাড়াতাড়ি ছাড়বে বলেছে। এই বার্তাটা সবদিকে পৌঁছে দিয়ো।’
এর আগে বাংলাদেশ সময় মঙ্গলবার দুপুর দেড়টার দিকে জাহাজ থেকে বার্তা পাঠিয়ে জানানো হয়, আফ্রিকার দেশ মোজাম্বিক থেকে কয়লা নিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতে যাওয়ার পথে ভারত মহাসাগরে জলদস্যুর কবলে পড়েছে বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহ।
জিম্মি হওয়া ক্রুরা হলেন ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ আব্দুর রশিদ, চিফ অফিসার মোহাম্মদ আতিকুল্লাহ খান, দ্বিতীয় কর্মকর্তা মোজাহেরুল ইসলাম চৌধুরী, তৃতীয় কর্মকর্তা মো. তারেকুল ইসলাম, ডেক ক্যাডেট মো. সাব্বির হোসেন, প্রধান প্রকৌশলী এ এস এম সাইদুজ্জামান, দ্বিতীয় প্রকৌশলী মো. তৌফিকুল ইসলাম, তৃতীয় প্রকৌশলী মো. রোকন উদ্দিন, চতুর্থ প্রকৌশলী তানভীর আহমদ, ইঞ্জিন ক্যাডেট আইয়ুব খান, ইলেকট্রিশিয়ান ইব্রাহিম খলিল উল্লাহ, এবি মো. আনোয়ারুল হক, এবি মো. আসিফুর রহমান, এবি সাজ্জাদ হোসেন, ওএস জয় মাহমুদ, ওএস মো. নাজমুল হক, ওএস আইনুল হক, অয়েলার মোহাম্মদ শামসউদ্দিন, মো. আলী হোসেন, ফায়ারম্যান মোশারফ হোসেন শাকিল, চিফ কুক মো. শফিকুল ইসলাম, জিএস মো. নূর উদ্দিন ও ফিটার মো. সালেহ আহমেদ। তাদের মধ্যে ১১ জন চট্টগ্রামের বলে জানা গেছে।
জাহাজ থেকে চিফ অফিসারের অডিওবার্তা
মঙ্গলবার মাগরিবের পর হোয়াটসঅ্যাপে নিজের স্ত্রীর কাছে অডিওবার্তার আগে আরেকটি বার্তা পাঠিয়েছিলেন চিফ অফিসার মোহাম্মদ আতিক উল্লাহ খান। তার কণ্ঠে শোনা যায়, ‘ক্যাপ্টেন স্যার ব্রিজে ছিলেন। আমরা জিগজ্যাগ কোর্স, এসএসএ করলাম। ইউকেএমটিতে ট্রাই করছিলাম। কিন্তু ইউকেএমটি তখন ফোন রিসিভ করেনি। এরপর পাইরেটসগুলো (দস্যুরা) চলে এলো। আসার পর ক্যাপ্টেন স্যার আর সেকেন্ড স্যারকে ক্যাপচার করল। তারপর আমাদের সবাইকে ডাকল। আমরা সবাই আসলাম। ওরা কিছু গোলাগুলি করেছিল। আমরা সবাই ভয় পেয়েছিলাম।’
সবাই ব্রিজে বসে ছিল। এমনিতে কারও গায়ে হাত তোলেনি। সেকেন্ড অফিসারকে একটু মারধর করেছে। তারপর আরেকটি স্পিডবোট করে ওরা আরও কয়েকজন আসল। এভাবে ১৫-২০ জন চলে এলো। আসার কিছুক্ষণ পর একটি ফিশিং ভেসেল এলো। ওদের মাদার ভেসেল। ওটা ইরানিয়ান ফিশিং বোট, যেটা এক মাস আগে তারা নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। ওই ট্রলার নিয়েই তারা এক মাস ধরে সার্ফিং করছিল। দস্যুরা অন্য জাহাজ খুঁজছিল।
ইরানিয়ান জাহাজটিকে ছেড়ে দেবে। ফিশিং বোটের ফুয়েল শেষ হয়ে গেছে। আমাদের জাহাজ থেকে তারা ডিজেল নিচ্ছে। তারা থার্ড ইঞ্জিনিয়ারকে নিয়ে জাহাজের স্টার্ট বন্ধ করল। জাহাজের কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। আমাদেরও তেমন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। কিন্তু সবাই ভয়ে আছে। ওরা আমাদের ভয় দেখাচ্ছে। আমাদের জাহাজের ২০-২৫ দিন প্রবেশন আছে। ২০০ মেট্রিক টন ফ্রেশ ওয়াটার আছে। আমরা ইতোমধ্যে বলেছি, ফ্রেশ ওয়াটার যাতে সবাই কম করে ব্যবহার করে। প্রবেশনও আমরা ওভাবে হ্যান্ডল করব। আমাদের জাহাজে ৫৫ হাজার টন কয়লা আছে। এটা ডেঞ্জারাস কার্গো, এটি ফায়ার্ড হ্যাজার্ডে আছে।’
স্বজনের কাছে নাবিকের বার্তা
গতকাল মঙ্গলবার বেলা ১টা ৪০ মিনিটে জাহাজটির ডেক ক্যাডেট তার একজন স্বজনকে হোয়াটসঅ্যাপ মেসেঞ্জারে লেখেন, ‘সোমালিয়ায় আমাদের জাহাজ জলদস্যু দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। তারা আমাদের জিম্মি করেছে। জলদস্যুদের কাছে অস্ত্র আছে। প্লিজ! আমাদের সহযোগিতা করুন। মিডিয়া স্যারকে দ্রুত ফোন দেন।’ এর আগেই অবশ্য জাহাজটির ক্যাপ্টেন ইমেইল বার্তায় জাহাজ মালিককে জলদুস্য কবলে পড়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেন। জাহাজে অবস্থানরত নাবিক আতিকুল্লাহ খান বিকালে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পরিবার ও বন্ধুদের উদ্দেশে লেখেন, ‘আলহামদুল্লিাহ, আমরা ভালো আছি। ভয়ের কিছু নেই। আমাদের জন্য দোয়া করবেন।’
জাহাজের নাবিকদের একজন মোবাইলে জলদস্যুদের জাহাজে ওঠার দৃশ্যধারণ করেছেন। ছোট্ট ভিডিওতে দেখা যায়, কালো কাপড় পরা মুখোশধারী ব্যক্তি জাহাজে উঠছেন। তার কাঁধে লম্বা বন্দুক। এছাড়া কয়েকটি স্থিরচিত্রে দেখা গেছে, জাহাজে কালো পোশাক পরা ব্যক্তিরা অবস্থান করছেন।
নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল আমেরিকান নৌবাহিনী
জানা গেছে, ভারত মহাসাগরের যে অবস্থান থেকে জাহাজটি জলদস্যুদের কবলে পড়েছে, সেখানে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করে থাকে আমেরিকান নৌবাহিনীর জাহাজ। সোমালিয়ার জলদস্যুদের উৎপাত বন্ধ করতে আমেরিকান নৌবাহিনী ওই সাগরে নিরাপত্তা দেয়। কিন্তু এখন গাজা যুদ্ধের কারণে হুতিরা সাগরপথে জাহাজ চলাচলে বাধা দিচ্ছে। এ কারণে আমেরিকান নৌবাহিনী সক্রিয় রয়েছে হুতিদের দমনে। এই সুযোগে ভারত মহাসাগরে সোমালিয়ার জলদুস্যরা ফের তৎপর হয়ে উঠেছে। এমন প্রেক্ষাপটে সোমালিয়ার জলদস্যুদের থাবায় জিম্মি হলো বাংলাদেশি জাহাজ ও নাবিকরা।
জলদস্যুদের কবলে যেভাবে পড়ল জাহাজটি
কয়লাবাহী এম ভি আবদুল্লাহ আফ্রিকার মোজাম্বিক থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাতে যাচ্ছিল। ভারত মহাসাগর দিয়ে যাওয়ার সময় দুপুরের দিকে হঠাৎই ছোট ছোট বোট নিয়ে জাহাজের দিকে চলে আসে সোমালিয়ান জলদস্যুরা।
ওই জাহাজে থাকা একজন ক্রু ঘটনার সময় একটি ভিডিও ধারণ করেন। ভিডিওতে দেখা যায় ছোট ছোট নৌকায় করে জাহাজটিতে ওঠার চেষ্টা করে জলদস্যুরা।
জলদস্যুরা জাহাজটিতে ওঠার সময় তাদের হাতে বন্দুক ছিল বলেও দেখা যায় ভিডিওটিতে। জাহাজে ওঠার পরই সবাইকে জিম্মি করে ফেলে দস্যুরা।
জাহাজের মালিকপক্ষ জানিয়েছে, জাহাজটিতে ক্যাপ্টেন ছিলেন আবদুর রশিদ। জলদস্যুরা জাহাজের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পরই মঙ্গলবার দুপুর দেড়টার দিকে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজের মাধ্যমে মালিক প্রতিষ্ঠানকে একটি বার্তা পাঠায় জাহাজের একজন নাবিক। যাতে বলা হয়, ‘জলদস্যুরা জাহাজ দখল করে নিয়েছে। আমাদের নাবিকেরা আটকা পড়েছেন। আমরা বিস্তারিত জানার চেষ্টা করছি।’
নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী গণমাধ্যমকে জানান, দএখন পর্যন্ত কী কারণে, কেন তারা এই জাহাজটিকে জিম্মি করলো বা তাদের দখলে নিল, তাদের লক্ষ্য উদ্দেশ্য জানতে পারি নাই। তবে মেরিটাইম সেক্টরে আমাদের যতগুলো চ্যানেল আছে সবগুলো চ্যানেল দিয়ে আমরা যোগাযোগ করার চেষ্টা করছি।’