ভাজা-পোড়া ও তেলযুক্ত খাবারে স্বাস্থ্যঝুঁকি বেশি

0
97

খবর৭১ঃ
ভাজা-পোড়া ও তেলযুক্ত খাবারে স্বাস্থ্যঝুঁকি বেশি
আমরা ভাজা-পোড়া, তৈলাক্ত খাবার বেশি পছন্দ করি। খেতে সুস্বাদু হলেও স্বাস্থ্যসম্মত নয় বলে এসব খাবারের পরিবর্তে বেশি করে ফলমূল ও শাকসবজি খাওয়া উচিত।

ভাজা-পোড়া, তৈলাক্ত খাবারে ব্যবহার করা তেল বারবার ব্যবহার করা হয় বলে পুড়ে যায় এবং তা ট্রান্স ফ্যাটে রূপান্তরিত হয়ে যায়। ট্রান্স ফ্যাট হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের মূল কারণ।

তাই যারা হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের সমস্যায় ভুগছেন, তাদের ভাজা-পোড়া, তৈলাক্ত খাবার পরিহার করা বাঞ্ছনীয়।

খাওয়ার প্রতি অনেকেরই ভীষণ লোভ থাকে। বেশি খেতে ইচ্ছা করলেও মাত্রাতিরিক্ত কোনো খাবারই খাবেন না। অতিভোজন নানা সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। দিন দীর্ঘ ও গরমের কারণে আমাদের শরীরে পানিশূন্যতা সৃষ্টি হয়। পানিশূন্যতা শরীরে বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। তাই সবার পর্যাপ্ত পানি পান করা দরকার। মনে রাখবেন, পানির বিকল্প কোমলপানীয় নয়। কোমলপানীয় আপনার শরীরে উপকারের চেয়ে অপকারই করবে বেশি। অনেকেই মনে করেন কফি, চা ও সোডা থেকে তারা পর্যাপ্ত পানি আহরণ করেন। চা ও কফিতে রয়েছে ক্যাফেইন, যা সাধারণত ডাইইউরেটিক হিসাবে কাজ করে। ডাইইউরেটিকের কাজ হলো শরীর থেকে পানি বের করে দেওয়া। সুতরাং বেশি চা বা কফি পান থেকে বিরত থাকুন। আরও একটি জরুরি কথা; বেশি চা বা কফি পান আপনার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাবে। পর্যাপ্ত ঘুম আপনার স্বাস্থ্যের জন্য একান্ত প্রয়োজন।

Advertisement

আমরা ভোজনবিলাসী নই শুধু, অতিমাত্রায় ভোজনবিলাসী। ভালো খাবারদাবার পেলে তো কোনো কথাই নেই। কিছু উদাহরণ দিই, কোনো বিয়ের অনুষ্ঠানে একজন মেহমান যদি গুনে গুনে তেল ও চর্বিসমৃদ্ধ দশ টুকরা খাসির মাংস খান বা তিন প্লেট বিরিয়ানি খান, তাহলে তাকে অতিমাত্রায় ভোজনবিলাসী না বলে উপায় আছে? কোনো এক ঘরোয়া অনুষ্ঠানে এক ভদ্রলোক আমার সামনে এক ঘণ্টার মধ্যে এক লিটার কোকাকোলা সাবাড় করে দিলেন। আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলাম এবং এক সময় জিজ্ঞেস করলাম-আপনি কি বরাবরই এভাবে কোমলপানীয় পান করেন? তিনি গর্বের সঙ্গে হ্যাঁ-সূচক উত্তর দিলেন। এ ভদ্রলোকের কপালে কী আছে, তা ভেবে চিন্তিত হই। আমার জানাশোনা অনেকেই প্রতিযোগিতা করে রসগোল্লা খান।

প্রচুর চর্বি ও চিনিসমৃদ্ধ খাবার খেলে শরীরের ওজন বেড়ে যায়। বাড়তি ওজন শরীরের জন্য কোনো দিক থেকেই ভালো নয়। পশ্চিমা বিশ্বে ক্যান্ডি, আইসক্রিম, প্রচুর চিনিসমৃদ্ধ খাবার, কোমলপানীয় পান, তেল ও চর্বিসমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার কারণে মানুষের, বিশেষ করে অপ্রাপ্তবয়স্কদের ওজন বৃদ্ধি এক বড় সমস্যা হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে। শরীরের মাত্রাতিরিক্ত ওজনের সঙ্গে হৃদরোগ, উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস, আর্থ্রাইটিসজাতীয় বহু রোগের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। এসব ভয়ংকর প্রাণঘাতী রোগের কথা ভেবে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা স্থূলকায় লোকদের ওজন কমিয়ে স্বাভাবিক মাত্রায় নিয়ে আসার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। অতিরিক্ত চর্বি ও ক্যালরিসমৃদ্ধ খাবার শরীরের জন্য মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। কোলেস্টেরল এক সুপরিচিত লিপিড। স্থূলকায় লোকদের শরীরের শিরা উপশিরার অভ্যন্তরীণ দেওয়ালে চিনি ও ফ্রি রেডিক্যালের কারণে প্রদাহ ও ক্ষত সৃষ্টি হলে ক্ষতিকর কোলেস্টেরল (পুড়ে নষ্ট হয়ে যাওয়া), ট্রান্স ফ্যাট, লিপিড বা চর্বিজাতীয় দ্রব্য এবং লাইপোফেইজ পুঞ্জীভূত হওয়ার কারণে শিরা মোটা হয়ে যায় এবং সম্প্রসারণ-সংকোচন ক্ষমতা বিলুপ্ত হয়। ফলে উচ্চরক্তচাপ, স্ট্রোক ও হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বহুগুণে বেড়ে যায়।

শরীরের ওজন বাড়ার পেছনে কখনো কখনো বিভিন্ন ধরনের কোমলপানীয়েরও এক ধরনের ভূমিকা থাকে। কোমল পানীয়তে প্রচুর পরিমাণে চিনি ব্যবহার করা হয়। ৩৫৫ মিলি. কোমলপানীয়তে ৯ টেবিল চামচ পরিশোধিত চিনি থাকে। ৩৫৫ মিলি. আপকোলায় থাকে ৩৫ চা চামচ চিনি। দাম কমানোর জন্য ১৯৮০ সাল থেকে কোমলপানীয়তে চিনির পরিবর্তে উচ্চমাত্রার ফ্রুকটোজ কর্ন সিরাপ ব্যবহার করা হচ্ছে। এ সিরাপের জন্য যে শস্য ব্যবহার করা হয় তা আসে জেনেটিক্যালি মডিফাইড ফুড থেকে। কোমলপানীয়তে উচ্চমাত্রায় চিনি বা কর্নসিরাপ ব্যবহার করার কারণে বিশ্বব্যাপী মানুষের বিশেষ করে শিশু-কিশোর, তারুণ-তরুণীদের ওজন অভাবনীয়ভাবে বেড়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় কী করণীয়? কোমলপানীয় খাওয়া ছেড়ে দিতে হবে? ছেড়ে দিলে ভালো। কারণ কোমলপানীয়তে পরিশুদ্ধ চিনি ছাড়া কার্যকর আর কিছু নেই। কালেভদ্রে ডায়াবেটিক রোগীদের একান্তভাবে মন চাইলে কয়েক চুমুক কোমলপানীয় পান করা যেতে পারে। তবে বাড়াবাড়ি পরিত্যাজ্য। আপনি যদি বেশি সতর্ক হতে চান, তবে কোমলপানীয় খেলে কার্বোহাইড্রেটের পরিমাণ অন্যত্র একটু কমিয়ে দিতে পারেন।

যাদের প্রচুর অর্থবিত্ত আছে, তাদের পরিবারে সমস্যাটা বেশি। শিশুদের শরীরের ওজন বেড়ে যাওয়ার পরিণতি খুব ভালো নয়। স্থূলকায় শিশুদের ৫৫ বছর বয়সের আগে মৃত্যুহার দ্বিগুণ। স্বাভাবিক ওজনের অল্প বয়সি মহিলাদের চেয়ে স্থূলকায় মহিলারা ৩৬-৫৬ বছরের মধ্যে বেশি মৃত্যুবরণ করে। গবেষকরা তাদের গবেষণার মাধ্যমে দেখিয়েছেন, এ শতাব্দীর মাঝামাঝি ডায়াবেটিস, স্ট্রোক, হৃদরোগ, ক্যানসারজাতীয় প্রাণঘাতী রোগের ব্যাপকতার কারণে মানুষের গড় আয়ু পাঁচ বছর কমে যাবে। বিশ্বব্যাপী স্থূলতার কারণে লাখ লাখ শিশু বা অল্পবয়সি তরুণ-তরুণী বয়স্কদের মতো ক্যানসার, ডায়াবেটিস, স্ট্রোক, অস্টিওআর্থ্রাইটিস ও হৃদরোগ-এসব রোগে আক্রান্ত হচ্ছে এবং মারা যাচ্ছে। মনে রাখবেন, অতিভোজন যেন আপনার ওজন বৃদ্ধিরও কারণ না ঘটে। তাই পরিমিত খান, ব্যায়াম করুন, অলস জীবনযাপন করবেন না, আবার কোনো অজুহাতে পুষ্টিকর খাবার থেকে শরীরকে বঞ্চিত করবেন না।

রাজধানী ঢাকায় প্রায় ৬০ লাখ মানুষ স্ট্রিট ফুড বা রাস্তার খাবার খান। রাস্তার খাবার গ্রহণে সতর্ক হতে হবে। স্বল্পমূল্য ও মুখরোচক বলে এ ধরনের খাবার জনপ্রিয় হচ্ছে। একই সঙ্গে অর্থনীতির বিকাশে অবদান রাখছে। যে কোনো দেশের পর্যটনের বিকাশে সে দেশের স্ট্রিট ফুড ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। সাশ্রয়ী হওয়ায় বিশ্বজুড়েই পর্যটকরা রকমারি খাবারের স্বাদ নিতে স্ট্রিট ফুড বেছে নেন। জাপানের টোকিও, মরক্কোর মারাকেশ, অস্ট্রেলিয়ার সিডনি, চীনের পেইচিং, যুক্তরাষ্ট্রের মায়ামি, মিসরের কায়রো, ইন্দোনেশিয়ার বালি, থাইল্যান্ডের ব্যাংকক, ভিয়েতনামের হো চি মিন সিটি থেকে শুরু করে ভারতের মুম্বাই ও কলকাতার স্ট্রিট ফুড বা পথখাবার এসব দেশের তো বটেই, বাইরে থেকে সেখানে বেড়াতে যাওয়া পর্যটকদেরও অন্যতম আকর্ষণ। বিকাল থেকেই এসব শহরের রাস্তার ধারে ভ্রাম্যমাণ খাবারের দোকান বসে যায়। ব্যয়বহুল রেস্তোরাঁয় পাওয়া যায় না, এমন অনেক খাবার এসব দোকানে পাওয়া যায়। ঢাকায়ও রাস্তার ধারে এখন স্ট্রিট ফুডের পসরা সাজিয়ে বসতে দেখা যায়। নগরীর অনেক এলাকায় রাস্তার খাবারের অস্থায়ী দোকান বসে। বিকাল থেকে রাত পর্যন্ত এসব দোকান খোলা থাকে। এ ছাড়া বিভিন্ন শিঙাড়া প্রতিষ্ঠানের বাইরে ঝালমুড়ি, ফুচকা-চটপটির দোকান তো আছেই। বিদেশের স্ট্রিট ফুডের সঙ্গে বাংলাদেশের স্ট্রিট ফুডের পার্থক্য এই যে, বিদেশে এসব খাবার তৈরি ও পরিবেশন করা হয় স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশে। কিন্তু বাংলাদেশে এ সবের বালাই নেই। ঢাকার প্রায় ৯০ শতাংশ রাস্তার খাবারেই ই-কোলাই, সালমোনেলা ও ইস্ট মোল্ডের মতো মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর জীবাণু পাওয়া গেছে।

এসব খাবার খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ার আশঙ্কা আছে তা জানা সত্ত্বেও মানুষ রাস্তার এসব খাবার খাচ্ছেন। এটা এ দেশের বহু মানুষের অভ্যাস ও সংস্কৃতির অঙ্গ। আরও একটি ব্যাপার লক্ষণীয়; আমাদের দেশের বহু মানুষ ঝুঁকি নিতে বেশি পছন্দ করেন। ঝুঁকির কারণে অসুস্থ হওয়া বা বিপদগ্রস্ত হওয়া বাংলাদেশে স্বাভাবিক ব্যাপার। তারপরও এসব খাবার তৈরি ও পরিবেশন যাতে স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশে হয় সেদিকে এখন দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। রাস্তার খাবার বিপণন এখন একশ্রেণির মানুষের উপার্জনের মাধ্যম। আবার এ খাবারের কারণে জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে পড়বে-এটাও মেনে নেওয়া যায় না। কাজেই রাস্তার খাবার কীভাবে কতটা নিরাপদ করা যায়, তা নিয়ে ভাবতে হবে। এ বিষয়ে ভোক্তাদেরও সচেতন হতে হবে।

প্রযুক্তির উন্নয়ন মানুষের জীবনযাপনে প্রভাব ফেলছে। প্রাকৃতিক জীবনযাত্রা থেকে সরে আসার কারণে বিশ্বজুড়ে মানুষের শরীর-মন-আত্মার ওপর প্রবল বিরূপ প্রভাব পড়ছে। ফলে আমরা অতিমাত্রায় অসুস্থ হয়ে পড়ছি। সুস্থ-সুন্দর জীবনের জন্য আমাদের নিজেদের বদলাতে হবে। পরিবেশ, ওষুধ ও স্বাস্থ্য সম্পর্কে আমাদের আরও সচেতন হতে হবে, অন্যকে বদলানোর জন্য গণসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। আমাদের জানতে হবে কোনটি স্বাস্থ্যকর নিরাপদ খাবার আর কোনটি অস্বাস্থ্যকর খাবার, কোনটি নিরাপদ ওষুধ আর কোনটি ক্ষতিকর ও অপ্রয়োজনীয় ওষুধ। আমরা হয়তো জানি না, লাইফ স্টাইল পরিবর্তন করে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমরা ওষুধ ছাড়াই সুস্থ-সুন্দর জীবনযাপন করতে পারি। আগে বহুবার উল্লেখ করেছি-স্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস, সঠিক ও পুষ্টিকর খাবার খাওয়া, নিয়মিত ব্যায়াম করা, ধূমপান বর্জন করা, লবণ, চর্বি, ট্রান্স ফ্যাট এবং বিপুল ক্যালোরিসমৃদ্ধ খাবার পরিহার, মদ পান না করা, পর্যাপ্ত বিশুদ্ধ পানি পান করা, পর্যাপ্ত নিরুপদ্রব ঘুম এবং দুশ্চিন্তামুক্ত জীবনযাপন।

অপচয় রোধের শিক্ষাটা গ্রহণ করুন। অপচয় রোধ করে গরিব-দুঃখীদের বেশি বেশি দান করুন। অপচয় রোধের কোনো ম্যাজিক ফর্মুলা নেই। আমার দৃষ্টিতে এটা সম্পূর্ণ সহমর্মিতা ও উপলব্ধির ব্যাপার। হয়তো তা ব্যক্তিগত নতুবা সমষ্টিগত। তবে পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা অপচয় রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। মানবিক গুণাবলির অধিকারী কোনো মানুষের পক্ষে অনিয়ন্ত্রিত ও বেপরোয়া জীবনযাপন সম্ভব নয়। বিবেকের তাড়নায় সে মানুষ সব রকম অপচয় রোধে সদা সজাগ থাকবে। যে কোনো ধরনের অপচয় বা অপব্যবহার শুধু অনৈতিক নয়, অপরাধও বটে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here