গুলশান অগ্নিকাণ্ডে তদন্ত শুরু, সন্দেহে ‘শর্টসার্কিট’

0
109

খবর৭১ঃ
রাজধানীর গুলশান-২ এলাকায় বহুতল ভবনে অগ্নিকাণ্ডের তদন্ত শুরু করেছে ফায়ার সার্ভিসের তদন্ত কমিটি। সোমবার বিকাল ৩টায় ঘটনাস্থল পরিদর্শনের মধ্য দিয়ে তদন্ত কাজ শুরু করে কমিটি। তবে ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশ সূত্র বলছে, বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে।

এদিকে এ ঘটনায় এ পর্যন্ত দুজনের মৃত্যু হয়েছে। দুজনই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। তারা আগুন লাগার পর ভবন থেকে লাফ দিয়েছিল বলে পুলিশ জানিয়েছে। এর মধ্যে একজন ঘটনার পরপরই রবিবার রাতে এবং অন্যজন গতকাল মারা গেছেন বলে ফায়ার সার্ভিসের মিডিয়া সেলের কর্মকর্তা মো. শাহজাহান শিকদার।

রবিবার সন্ধ্যায় গুলশান-২ নম্বরের ১০৪ নম্বর সড়কের ২ নম্বর হোল্ডিংয়ের ১৪ তলা ভবনের ৭ তলায় আগুন দেখতে পেয়ে ফায়ার সার্ভিসে খবর দেন বাসিন্দারা। এর মধ্যে আগুন ভবনের ১২ তলায় ছড়িয়ে পড়ে। ফায়ার সার্ভিসের ১৯টি ইউনিটের প্রায় চার ঘণ্টার চেষ্টায় রাত ১১টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। এ ঘটনায় দুজনের মৃত্যু হয়েছে। অগ্নিকাণ্ডের সময়ে তারা ভবন থেকে লাফিয়ে পড়ে মারা যান বলে জানায় পুলিশ। অগ্নিকাণ্ডে আহত হয়েছেন কয়েকজন। তারা চিকিৎসাধীন রয়েছেন। ওই ভবনে ২৬ ফ্ল্যাটে ২৩ পরিবার বাস করে।

এদিকে সোমবার বিকালে অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত ভবন পরিদর্শন শেষে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, গুলশানে আগুন লাগা ভবনে কোনো ফায়ার সেফটি ও ফায়ার সার্ভিসের লাইসেন্স ছিল না। ভবন কর্তৃপক্ষ শুধু প্রাথমিকভাবে এনওসি (অনাপত্তি) নিয়েছিল।

অগিকাণ্ডের ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান তাজুল ইসলাম বলেন, ‘আগুন বিভিন্নভাবেই লাগতে পারে। এখানে গ্যাসের লাইন, বিদ্যুতের লাইন, আবার একই সঙ্গে বিভিন্ন দাহ্য পদার্থও আছে। সুতরাং কোনটা থেকে অগ্নিকাণ্ড হয়েছে বলা যাচ্ছে না।’

তিনি বলেন, তদন্তের বিষয়ে এখনো বলা যাচ্ছে না। কারণ তদন্ত চলাকালে নতুন নতুন বিষয়ও আসতে পারে। পুরো তদন্ত শেষে জানানো হবে।

ফায়ার সার্ভিসের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, আমরা ঘটনাস্থলে এসে ২২ জনকে উদ্ধার করি। বারবার নিষেধ করেছি কেউ যেন লাফ না দেন। কিন্তু যে দুজন মারা গেছেন তারা লাফ দেওয়ার কারণেই মারা গেছেন। এটা আসলে তাদের দোষ না। পরিস্থিতির কারণে তারা হয়তো লাফ দিয়েছেন।

* ঘটনাস্থল পরিদর্শন ফায়ার সার্ভিস গঠিত কমিটির, ফায়ার লাইসেন্স ছিল না ভবনের
* এ পর্যন্ত দুজনের মৃত্যু, একজন সংকটাপন্ন, মেডিকেল বোর্ড গঠন

* ভবনের দুর্বলতা শনাক্তে কমিটি করেছে রাজউক, জমির মালিক বিএনপির এক সাবেক এমপি
ভবন নিয়ম মেনে হয়েছে: মেয়র

এদিকে সোমবার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেছেন, ভবনটি সব নিয়ম মেনেই করা হয়েছে।

তিনি বলেন, ‘ভবনটি বিল্ডিং কোড মেনেই করা হয়েছে। কিন্তু আর্থিং লাইন ও ইলেকট্রনিক লাইন একই পাইপে উঠেছে। দুই লাইনের মাঝে সেপারেশন থাকে। সেটা যদি না থাকে বা মাঝে যদি কোনো দাহ্য পদার্থ থাকে, তাহলে কিন্তু সেপারেশন হলো না। সেটা আমি ইঞ্জিনিয়ার ও ফায়ার সার্ভিসকে দেখতে বলেছি। সেন্ট্রাল এসি ছিল। সেটা থেকে কোনো কারণে আগুনের ঘটনা ঘটেছে কি না, সেটা তদন্ত হবে। ফায়ার সার্ভিস আগুনের কারণ অনুসন্ধানে তদন্ত কমিটি করেছে।’

মেয়র দাবি করেন, ‘আমরা ফ্যাক্টরিতে বা গার্মেন্টসে প্রতিনিয়ত অগ্নিমহড়া করছি, সচেতনতামূলক কর্মসূচি পালন করছি। কিন্তু বাসাবাড়িতে সাধারণত সেটা হয় না। ফ্ল্যাট কেনেন কিংবা নিজে বাড়ি করেন, সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই।’

যা বললেন ভবনের প্রকৌশলী:

ভবনটি নির্মাণের সময় প্রকৌশলী হিসেবে কাজ করেন মাহফুজুল হাসান। সোমবার তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ভবনে অগ্নি দুর্ঘটনা থেকে বাঁচার জন্য সব ব্যবস্থাই ছিল।

তিনি বলেন, আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে অ্যালার্ম বেজেছে। সেটা শুনে যারা নিচের দিকে ছিলেন, তারা বের হতে পেরেছেন সহজে।

প্রকৌশলী মাহফুজুল হাসান বলেন, ওই ভবনে আগুনের দুর্ঘটনা থেকে বাঁচার জন্য সব ব্যবস্থাই ছিল। ভবনটিতে অগ্নিনির্বাপন প্রশিক্ষণের একটি টিমও ছিল, তারা তাৎক্ষণিক ব্যবস্থাও নিয়েছে। প্রত্যেক বাসায় সচেতন করেছে। ভবনটিতে নিরাপত্তার সব সিস্টেমই করা আছে। রাজউক থেকে যে সার্টিফিকেট দেয়, ওটাও নেওয়া ছিল।

তিনি বলেন, আগুন লাগার পরে প্রত্যেকেই যদি সিঁড়ি দিয়ে বের হয়ে যেতেন, তাহলে সবাই নিরাপদ হয়ে যেতে পারতেন। অনেক সময় ভুল অ্যালার্ম হয়। যারা বাসায় ছিলেন, তারা মনে করেছিলেন ভুল অ্যালার্ম হয়েছে। যখন তারা দেখেছেন আগুন এবং নিচ থেকে বলছিল আগুন লেগেছে, সবাই নেমে যান, তখন যারা পেরেছেন, নেমে এসেছেন।

ভবনে দ্রুত আগুন ছড়িয়ে যাওয়ার পেছনে কারণ হিসেবে তিনি বলেন, পুরো ভবনটিতেই কেন্দ্রীয় শীতাতপনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। একটি বাসা থেকে প্রথমে ধোঁয়া যায়, আগুন কিন্তু যায়নি। ধোঁয়ার জন্যই বেশি সমস্যা হয়েছে। আর আগুন ওপরে দুদিক থেকে বেশি হয়েছে।

আগুনে পোড়া ভবনটিতে ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ওই প্রকৌশলী বলেন, ‘নিউ এজ গার্মেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আরিফ ইব্রাহিমের ১০ ও ১১ তলা পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। আমি সব ফ্লোরে গিয়েছি, তবে অন্যান্য ফ্লোরে মূল দরজা বন্ধ আছে।’

ভবনের মালিক বিএনপির সাবেক এমপি:

আগুন লাগা ভবনটির জমির মালিক মো. মোশাররফ হোসেন ও জাকির হোসেন। মোশাররফ ফেনী-৩ (সোনাগাজী ও দাগনভূঞা) আসনের বিএনপির সংসদ সদস্য ছিলেন। আর জাকির বে-স্টেট লিমিটেডের মালিক। ভবনটি নির্মাণের সময় ঠিকাদারির কাজ করা প্রতিষ্ঠানের এনামুল হক কালাম নামে এক কর্মকর্তা অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িটি দেখতে এসে সোমবার দুপুরে এসব তথ্য জানান।

এনামুল হক কালাম জানান, ভবনের কয়েকটি ফ্ল্যাট বিক্রি হয়েছে। বাকিগুলোর মালিক মোশাররফ ও জাকির। সেগুলো ভাড়া দেওয়া আছে। তবে জমির মালিকরা কেউ এ বাড়িতে থাকেন না। তবে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) অনুমোদন এবং সব ধরনের নিয়ম মেনেই ভবনটি করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।

রাজউক সূত্রে জানা গেছে, ১৯ কাঠা জায়গার ওপর দুটি বেজমেন্টসহ বাড়িটি ১৪ তলার অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। বাড়িটির নকশা অনুমোদন করা হয়েছে নার্গিস আহমেদ গং- নামে এক নারীর নামে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নার্গিস আহমেদ গং এই জমির অংশীদার জাকিরের স্ত্রী।

জানা গেছে, ২০২০ সালে ভবনটি নির্মাণের জন্য পুনঃঅনুমোদন দেওয়া হয়। প্রাথমিকভাবে রাজউক, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল এভিয়েশন থেকে অনুমোদন নিয়ে ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছে।

অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় রাজউক জোন-৪ এর পরিচালক মাকসুদুল আরেফিনকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। পাঁচ দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা রয়েছে।

১৮ সদস্যের মেডিকেল বোর্ড:

গুলশানে অগ্নিকাণ্ডে আহতদের চিকিৎসায় ১৮ সদস্যর মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছে গতকাল। শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সমন্বয়কারী ডা. সামন্ত লাল সেন এ তথ্য জানিয়ে বলেন, ‘শেখ হাসিনা জাতীয় বার্নের পরিচালক অধ্যাপক ডা. রায়হানা আউয়ালকে প্রধান করে আহতদের চিকিৎসার জন্য ১৮ সদস্যের বোর্ড গঠন করা হয়েছে। এই বোর্ডে আমিও রয়েছি। ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের নিউরো সার্জারি, অর্থোপেডিক, জেনারেল সার্জারি ও থোরাসিক সার্জারির চিকিৎসকরাও রয়েছেন।’

ডা. সামন্ত লাল বলেন, অগ্নিকাণ্ডে দগ্ধ সায়মা রহমান সিনহাকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। তার ইনহালেশন বার্ন রয়েছে। শঙ্কামুক্ত বলা যাচ্ছে না। তবে অন্য দুজন শঙ্কামুক্ত। তাদের মধ্যে একজনকে ছেড়ে দেওয়া হবে।’

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here