মালয়েশিয়ায় অর্থ পাচার করে যেভাবে দ্বিতীয় নিবাস গড়ে তোলেন সম্রাট

0
555
মালয়েশিয়ায় অর্থ পাচার করে যেভাবে দ্বিতীয় নিবাস গড়ে তোলেন সম্রাট

খবর৭১ঃ মালয়েশিয়ায় দ্বিতীয় নিবাস গড়ার কর্মসূচি বা মালয়েশিয়া মাই সেকেন্ড হোমে (এমএম ২ এইচ) অংশ নিয়েছেন যুবলীগ ঢাকা দক্ষিণের বহিষ্কৃত সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট।

দুদক সূত্র জানায়, মালয়েশিয়ার আমপাংয়ের তেয়ারাকুন্ডে একটি ফ্ল্যাট রয়েছে ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটের। সেই সঙ্গে দেশটির বিভিন্ন ব্যাংকেও তার অ্যাকাউন্ট রয়েছে। এসব অ্যাকাউন্টে নিয়মিত লেনদেনের প্রমাণও পেয়েছে দুদক।

গত ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে অনোনুমোদিত ক্যাসিনোতে শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা করছে র‌্যাবসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। এর পর থেকেই বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে গোয়েন্দা তথ্য বিনিময় শুরু করে দুদক। এর অংশ হিসেবে একটি গোয়েন্দা সংস্থা, বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (বিএফআইইউ) ও র‌্যাবের গোয়েন্দা ইউনিটের কাছ থেকে তথ্য পেয়েছে দুদক। সেই সঙ্গে দুদকের নিজস্ব গোয়েন্দা ইউনিটও অনুসন্ধান চালিয়ে আসছিল। এ চার সংস্থার তথ্যের সমন্বয়ে দুদক ৪৩ জনের বিরুদ্ধে অর্থপাচার ও বেনামি সম্পদের প্রমাণ পেয়েছে।

২০০২ সালে চালু হওয়া এমএম ২ এইচ হলো এমন একটি কর্মসূচি, যেখানে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ দিয়ে অন্য দেশের একজন নাগরিক মালয়েশিয়ায় দীর্ঘমেয়াদি বসবাস ও অন্যান্য সুবিধা পান। বিভিন্ন দেশ থেকে এ কর্মসূচিতে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত সব মিলিয়ে ৪২ হাজার ২৭১ জন অংশ নিয়েছেন। এর মধ্যে বাংলাদেশির সংখ্যা চার হাজার ১৩৫ জন।

এ কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। আর প্রথম ও দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে চীন ও জাপান।

বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় নিবাস গড়তে বৈধভাবে অর্থ নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইন-১৯৪৭ অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংকের জারি করা এক সার্কুলারে দেশের বাইরে কোনো স্থাবর সম্পত্তি কেনার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। ফলে সেকেন্ড হোম কর্মসূচিতে যারা অংশ নিয়েছেন তারা টাকা পাচার করেছেন।

পাঁচ লাখ রিঙ্গিত বা এক কোটি টাকা জমা দেওয়ার পাশাপাশি মাসে ১০ হাজার রিঙ্গিত বা দুই লাখ টাকা বৈদেশিক আয় দেখাতে পারলেই পাওয়া যায় মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোমে স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ। যে কোনো দেশের নাগরিক এ প্রকল্পে বিনিয়োগ করতে পারেন। এ জন্য স্থায়ী আমানত বা ফিক্সড ডিপোজিট হিসেবে পাঁচ লাখ রিঙ্গিত জমা রাখতে হয়। তবে দ্বিতীয় বছরে অর্ধেক অর্থ তুলে নিতে পারেন সুবিধা গ্রহণকারীরা।

দুদক সচিব দিলোয়ার বখত বলেন, অবৈধ ক্যাসিনোর মাধ্যমে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন কিংবা অর্থ পাচারের বিষয়ে যাদের বিরুদ্ধেই অভিযোগ আছে সে বিষয়ে দুদক অনুসন্ধান করছে। এ বিষয়ে নতুন কোনো বক্তব্য নেই বলে জানান তিনি। সচিব বলেন, অনুসন্ধান শেষেই বিস্তারিত বলা সম্ভব হবে।

এ তালিকায় সম্রাটের পরেই রয়েছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর, যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণ শাখার যুগ্ম-সম্পাদক ও বাংলাদেশ হকি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক মমিনুল হক সাঈদ। অবৈধ ক্যাসিনোর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার আগেই তিনি সিঙ্গাপুরে গিয়েছিলেন। অভিযান শুরুর পর তিনি এখন পর্যন্ত দেশে ফেরেননি। এ অবস্থায় ডিএসসিসির সভায় যোগ না দেওয়ার অভিযোগে তাকে কাউন্সিলর পদ থেকে বহিষ্কার করার প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে।

তালিকায় আরও রয়েছেন যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণ শাখার বহিষ্কৃত সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) পরিচালক ও মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক লোকমান হোসেন ভূঁইয়া, কলাবাগান ক্রীড়াচক্রের সভাপতি ও কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় নেতা সফিকুল আলম ফিরোজ, যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির দপ্তর সম্পাদক কাজী আনিসুর রহমান, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মিজানুর রহমান বকুল, গেন্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি এনামুল হক এনু ও সহ-সম্পাদক রুপন ভূঁইয়া। এদের বেশিরভাগই গ্রেফতার হয়েছেন এবং যুবলীগের পদ থেকে বহিষ্কৃত হয়েছেন।

দুদক সূত্র জানায়, সম্রাটসহ ৪৩ জনের বিরুদ্ধেই বিদেশে অর্থপাচারের প্রমাণ পেয়েছে দুদক। মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ডে অভিযুক্তরা অর্থপাচার করেছেন। এর পাশাপাশি এসব দেশে নামে ও বেনামে সম্পদও গড়েছেন। যার প্রমাণ এখন দুদকের হাতে।

১৮ সেপ্টেম্বর ক্যাসিনো বিরোধী অভিযান শুরুর পর থেকে দীর্ঘদিন আত্মগোপনে ছিলেন যুবলীগের প্রভাবশালী নেতা ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট। সম্রাট ও তার সহযোগী আরমানকে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে এক বাড়ি থেকে ৬ অক্টোবর গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। পরে তাকে ঢাকায় কাকরাইলের ভূঁইয়া ম্যানসনের কার্যালয়ে অভিযান চালানো হয়। তল্লাশি চালানো হয় শান্তিনগরে সম্রাটের ভাইয়ের বাসা ও ডিওএইচএসে সম্রাটের দ্বিতীয় স্ত্রীর বাসায়। বন্য প্রাণীর চামড়া রাখার দায়ে সম্রাটকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়। অস্ত্র এবং মাদক রাখায় সম্রাটের বিরুদ্ধে অস্ত্র ও মাদক আইনে মামলা করা হয়।

উন্নয়নশীল দেশ থেকে অর্থ পাচার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) সর্বশেষ প্রতিবেদনের তথ্যমতে ২০১৪ সালে বাংলাদেশ থেকে ৯১১ কোটি ডলার বা প্রায় ৭৩ হাজার কোটি টাকার বেশি পাচার হয়েছে। পাচার হওয়া এ অর্থ দিয়ে বাংলাদেশে দুটি পদ্মা সেতু তৈরি করা সম্ভব। একই সময়ে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের মোট বাণিজ্যিক লেনদেনের পরিমাণ ছিল ৭ হাজার কোটি ডলারের বেশি। অর্থাৎ বাংলাদেশের মোট বাণিজ্যিক লেনদেনের গড়ে ১০ শতাংশের বেশি অর্থ পাচার হয়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here