হারিয়ে যাচ্ছে রুপলাল হাউজ

0
511

মেহেরাবুল ইসলাম সৌদিপ: পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী স্থাপনার মধ্যে রূপলাল হাউজ অন্যতম। কিন্তু সংরক্ষণের অভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে এই রুপলাল হাউজ। এই হাউজটির বেশিরভাগ অংশই দীর্ঘকাল ধরে বেদখল হয়ে রয়েছে। হাউজটি পুরান ঢাকার শ্যামবাজারের পাশে ঊনবিংশ শতকে নির্মিত একটি ভবন। এটি বুড়িগঙ্গা নদীর উত্তর পারে ফরাশগঞ্জ এলাকায় অবস্থিত। ফরাশগঞ্জ আসলে আহসান মঞ্জিলের কথা বললে সবাই এক আংগুলে দেখিয়ে দিবে। কিন্তু যদি বলেন রুপলাল হাউজটা কোথায় সে আংগুল দিয়ে মাথা চুলকাবে। হা বলছি সেই রুপলাল হাউজের সেই রুপলাল দাশ, রঘুনাথ দাশ বাবুদের কথা। কালের বির্বতনে হারিয়ে গেছে ইতিহাস। হয়তো একদিন হারিয়ে যাবে এই বাড়ীখানাও। কথিত আছে এক কালে ব্রিটিশরা ঢাকা আসলে রুপলাল হাউজে রুম ভাড়া নিয়ে থাকতো। তৎকালীন আমলে রুম ভাড়া ছিল ২০০ টাকা। ঢাকার নবাব আর রুপলাল বাবুদের মধ্যে একটা ঠান্ডা যুদ্ধ সব সময় লেগে থাকতো। সে সময় ঢাকা শহরে নাচ ঘর বা বল রুম ছিল শুধু আহসান মঞ্জিল আর রুপলাল হাউজে। ১৮৮৮ সালে কোন এক সময় লর্ড ডাফরিন ঢাকায় আসলো। তার সম্মানে নাচ গানের আসর বসবে এই নিয়ে প্রতিযোগিতায় নামে ঢাকার নবাব আর রুপলাল বাবুরা। সে সময় অনেক বেশী ভোটে বিজয়ী হয় রুপলাল হাউজ। পান মসলার আড়তের ভীড়ে হারিয়ে গেছে তার পুরান আধিপত্য। দেবত্তর সম্পত্তি এখন জামাল বাবুদের দখলে। সে আর এক ইতিহাস। রুপলাল হাউজ যে আমাদের ঐতিহ্য ছিল সে কথাও হয়তো কিছুদিন পর মানুষ মনে রাখবে না।

রূপলাল হাউজ বাংলাদেশের ঢাকা শহরের পুরানো ঢাকার শ্যামবাজার এলাকায় ঊনবিংশ শতকে নির্মিত একটি ভবন। রূপলাল হাউজ নামের এই ভবনটি নির্মাণ করেন হিন্দু ব্যবসায়ী ভ্রাতৃদ্বয় রূপলাল দাস ও রঘুনাথ দাস। এই ভবনটি ৯১ দশমিক ৪৪ মিটার দীর্ঘ একটি দ্বিতল ভবন। দ্বিতল এই ভবনের স্থাপত্যশৈলী অভিনব। এটি জমিদার ও বণিকদের তৈরি। যাকে ইউনিক বলেছেন স্থাপত্যবিদরা। এর পেছনভাগে বুড়িগঙ্গা নদী প্রবহমান। ভবনটি নির্মাণ করেন হিন্দু ব্যবসায়ী ভ্রাতৃদ্বয় রূপলাল দাস ও রঘুনাথ দাস। এটি বুড়িগঙ্গা নদীর উত্তর পারে ফরাসগঞ্জ এলাকায় অবস্থিত। রূপলাল ঢাকার বিখ্যাত আর্মেনীয় জমিদার আরাতুনের কাছ থেকে বাড়িটি কিনে পুনর্নির্মাণ করেছিলেন। এর নির্মাণ কাল ঊনবিংশ শতাব্দীর ষাটের দশক। মার্টিন এন্ড কোং কোম্পানির একজন স্থপতি এর নকশা প্রণয়ন করেছিলেন। দ্বিতল এই ভবনের স্থাপত্য শৈলী অভিনব। এটি দুইটি অসম অংশে বিভক্ত যার প্রতিটিতে কিছুটা ভিন্ন স্থাপত্য শৈলী দেখা যায়। এর ভিত্তিভূমি ইংরেজী E অক্ষরের ন্যায়। যার বাহুত্রয় শহরের দিকে প্রসারিত। মাঝের দীর্ঘতম বাহুটির দৈর্ঘ্য ১৮.৩৩ মিটার। ভবনটির ছাদ নির্মাণ করা হয়েছিল ‘কোরিনথীয়’ রীতিতে। এর উপরে রয়েছে রেনেসাঁ যুগের কায়দায় নির্মিত ‘পেডিমেন্ট’। রূপলাল হাউজে দ্বিতীয় তলায় দুটি অংশে বিভিন্ন আয়তনের মোট ৫০টিরও বেশি কক্ষ রয়েছে। এছাড়াও রয়েছে কয়েকটি প্রশস্ত দরবার কক্ষ। ভবনের পশ্চিামংশে দোতলায় অবস্থিত নাচঘরটি আকষণীয়ভাবে তৈরী। এর মেঝে ছিল কাষ্ঠ নির্মিত। পুরো বাড়ি জুড়ে উত্তর-দক্ষিণ পার্ম্বে রয়েছে প্রশস্ত বারান্দা। বারান্দা দুটি ইট-নির্মিত ‘সেমি-কোরিনথীয়’ স্তম্ভ বা সমায়ত ইটের স্তম্ভের ওপর সংস্থাপিত। নদীর দিকে সম্মুখভাগে ভবনের চূড়াতে একটি বড় ঘড়ি ছিল যা ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দের ভূমিকম্পে ভেঙ্গে পড়ার পড়ে আর ঠিক করা হয়নি। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ভারত বিভাগকালে রূপলালের উত্তরাধিকাররা ঢাকা ত্যাগ করে পশ্চিম বঙ্গে চলে যান। খাতা কলমে রুপলাল হাউজ এখনও টিকে আছে। এটিকে জামাল হাউস নামেই বেশির ভাগ লোক চিনে। সাম্প্রতিক কালে রূপলাল হাউজ মসলা ও সবজি ব্যবসায়ীদের দখলে চলে গিয়েছিল। সরকারিভাবে এই স্থাপনাটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সম্পদ হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে। ঘোষণার পর আজ পর্যন্ত ভবনটি সংরক্ষণে আনতে পারিনি সরকার।

রুপলাল হাউজে যেতে হলে ঢাকার যে কোন প্রান্ত থেকে ফরাশগঞ্জ আসতে হবে। এরপর বাড়িটা আপনাকে খুঁজে বের করতে হবে। অনুসন্ধানী চোখ থাকলে ফরাশগঞ্জকে আপনার পানাম নগরের থেকে কোন অংশে কম মনে হবে। মসলার গন্ধে পিয়াজের ঝাজে মুগ্ধ হয়ে খুঁজে বের করতে হবে আপনাকে পুরান বাড়ীগুলো। স্থানীয় হিসাবে অনুযায়ী এই ফরাশগঞ্জে ৫০ এর অধিক পুরান বাড়ী আছে। খুঁজে বের করতে হলে লাগবে পাখির চোখ। শ্যামবাজারের কাছ ঘেঁষেই সেই রূপলাল হাউজ। আর বাজারের মধ্য দিয়েই একটা আড়ৎ। আড়ৎটাই রূপলাল হাউজের নিচতলার একটা অংশ! চারিদিকে অসংখ্য দোকান পাটসহ স্থাপনা গড়ে উঠেছে। ভবনটির নিচতলার পুরোটাই চলে গেছে ব্যবসায়ীদের দখলে। গেট দিয়ে ঢোকার পরেই উপরে ওঠার কাঠের সিঁড়ি। তবে তা সবসময় অন্ধকার থাকে। তবে মাঝখানের উঠানটায় রোদের আলো পড়ছে। চতুষ্কোণ বাড়ি খ্যাত রূপলাল হাউজকে ঘিরে শতাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এসবের মধ্যে রয়েছে জনতা কৃষি পণ্য বিপণন কেন্দ্র, বৈশাখী বাণিজ্যালয়, আরাফাত ট্রেডার্স, মেসার্স ঢাকা-বাংলা আড়ৎ, রাশেদ বাণিজ্যালয়, ইউনাইটেড ট্রেডার্স প্রভৃতি। ইতিহাসের সাথে বর্তমান রূপলাল হাউজের আকাশ-পাতাল ব্যবধান। দিন দিন দেয়াল থেকে চুন সুড়কির আবরণ খসে পড়ছে। ভবনের অনেকটা অংশ ভেঙেও গিয়েছে। দেয়ালে গজিয়েছে বটগাছ। উপরে ওঠার সিঁড়িগুলো ভেঙে গেছে। এইরকম ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায়ও সেখানে বসবাস করছে বেশ কিছু পরিবার। কিন্তু ভবনটি সংস্কারের কোন উদ্যোগ কোথাও চোখে পড়েনি না। ভবনের নিচে গড়ে উঠেছে মসলার বাজার। দেখা গেছে, এই ভবনটিতে ৫০টির অধিক কক্ষ রয়েছে এবং কয়েকটি প্রশস্ত দরবার কক্ষ রয়েছে। এক সময় রূপলাল হাউজ মসলা ও সবজি ব্যবসায়ীদের দখলে চলে গেছে।

বাড়িটি এখন ধ্বংসের মুখোমুখি এবং সবগুলো কক্ষসহ এর প্রাঙ্গন বেদখল। ভেতরে যেতে বাধা দেয় অনেকেই। তারা ক্যামেরা দেখলে ভয় পান। ছবি তুলতে গেলে করেন নানা ধরনের প্রশ্ন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হওয়া স্বাভাবিক-রূপলাল হাউজে আসিনি। পুরানো ঢাকার বিস্মৃতির অন্তরালে ঢাকা পড়া কোন জায়গায় আসিনি, আসিনি এক সময়ের পুরানো ঢাকার জৌলুসপূর্ণ কোন বাড়িতে। এসেছি, কোন এক মসলার আড়ৎ এ। এই হলো রূপলার হাউজের বর্তমান পরিনতি। প্রাচীন এ নিদর্শনগুলো রক্ষা করার জন্য একটি বড় ধরনের বিনিয়োগ সরকারকেই করতে হবে। পৃথিবীর অনেক দেশে সংরক্ষিত ঐতিহ্যবাহী এলাকা আছে। আমাদের দেশেও আছে। এতে করে আমাদের ঐতিহ্য সংরক্ষণের পাশাপাশি বিদেশি অনেক পর্যটককে আকর্ষণ করা সম্ভব।

এ বিষয়ে প্রত্নতন্ত্র অধিদপ্তরের আঞ্চলিক পরিচালক (ঢাকা বিভাগ) রাখী রায় বলেন, “রুপলাল হাউজ প্রত্নতত্ত্ব বিভাগে ১৯৮৯ সালে সংরক্ষিত একটি পুরাকীর্তি। ১৯৪৭ সালে রুপলাল হাউজের লোকেরা তাদের সম্পত্তি বিক্রি করে চলে গেছে। তখন থেকেই এটা পেয়াজ মরিচের ব্যবসার আড়ৎ। এই ব্যবসার আড়ৎ উঠানোর জন্য প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেছে কিন্তু পারেনি। তারা এখানে দীর্ঘদিন যাবত ব্যবসা করে যাচ্ছে তবে বিল্ডিংয়ের কোনো ক্ষতি হচ্ছে না, বিল্ডিং ঠিক আছে। বিল্ডিং বিল্ডিংয়ের জায়গায়ই আছে। তবে আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি কিভাবে এটা নিজেদের আওতায় আনা যায় এবং পরবর্তীতে আমরা এটা সংরক্ষণ করবো।”

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here