হট্টগোল ধাক্কাধাক্কি পুলিশ বেষ্টনীতে শেষ হলো সুপ্রিমকোর্ট বারের ভোট

0
117

খবর৭১ঃ
আওয়ামী লীগ-বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের হট্টগোল, ধাক্কাধাক্কি, পুলিশি হামলা, পালটাপালটি স্লোগান ও কড়া নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে শেষ হলো সুপ্রিমকোর্ট বারের দুদিনের নির্বাচন। বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা ২০ মিনিটে দ্বিতীয় দিনের মতো ভোটগ্রহণ শুরু হলে দুপক্ষের মধ্যে ধাক্কাধাক্কির ঘটনা ঘটে। এবারের নির্বাচনে ৮ হাজার ৬০২ জন ভোটারের মধ্যে দুদিনে ৪ হাজার ১৩৭ ভোট পড়েছে।

বৃহস্পতিবার রাতেই ভোট গণনা হতে পারে। এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সুপ্রিমকোর্ট প্রাঙ্গণে বৃহস্পতিবারও বিপুলসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়। ভোটকেন্দ্রের চারপাশে গড়ে তোলা হয় নিরাপত্তা বলয়। দিনভরই ছিল উত্তেজনা। সমিতি ভবন ও প্রাঙ্গণসহ ভোটারদের প্রবেশের জন্য তৈরি প্যান্ডেলের সামনে ছিল বিপুলসংখ্যক পুলিশ। আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নসহ (এপিবিএন) অন্তত পাঁচ শতাধিক পুলিশ মোতায়েন ছিল বলে জানা গেছে।

এদিন সকালে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে বুধবার পুলিশের হামলাসহ নানা ঘটনার বর্ণনা দেন বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা। এরপর আওয়ামী লীগ ও বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা মিছিল-স্লোগান দেন। এর আগে প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগের বিচারপতিদের সঙ্গে প্রথমে বিএনপিপন্থি আইনজীবী ও পরে অ্যাটর্নি জেনারেল সাক্ষাৎ করেন। দিনভর দুপক্ষের মিছিল, ধাক্কাধাক্কির পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশি নিরাপত্তা বেষ্টনীতে দ্বিতীয় দিনের ভোট শেষ হয়। বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা ভোট দেননি বলে তারা দাবি করেন।

রেওয়াজ অনুযায়ী নির্বাচনের সময়ে ভোটের প্যান্ডেলের সামনে দুপক্ষের প্রার্থীরা উপস্থিত থাকতেন। প্রার্থীরা ব্যালট নম্বরসহ উল্লেখিত তাদের পরিচিতির কার্ড ভোটারদের হাতে তুলে দিতেন। এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্যানেলের আইনজীবীদের পক্ষে ভোটারদের হাতে কার্ড তুলে দিতে দেখা গেলেও বিএনপি সমর্থিত প্যানেলের কেউ কাজটি করেননি। আইনজীবীরা বলেন, এবারের নির্বাচনে উৎসবের আমেজ ছিল না, ছিল এক ধরনের উত্তেজনা।

বৃহস্পতিবার প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন এজলাসে বুধবার পুলিশের হামলা ও মামলার কথা তুলে ধরেন সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এ জে মোহাম্মদ আলীর নেতৃত্বে বিএনপিপন্থি আইনজীবী নেতারা। তারা এই নির্বাচন বাতিলের দাবি জানিয়ে হামলার বিচার চান। অপরদিকে নির্বাচনকে ঘিরে চলমান ঘটনায় প্রধান বিচারপতির কিছু করার নেই বলে জানিয়েছেন অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন।

নির্বাচনে দ্বিতীয় দিনে সকালে ধীরে ধীরে ভোটকেন্দ্রে দুই দলের আইনজীবীরা এসে জড়ো হন। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এ সময় আওয়ামী লীগ ও বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা জোরে জোরে স্লোগান দিতে থাকেন। একদল ‘ভোট চোর, ভোট চোর’ বলে স্লোগান দিতে থাকে। অন্য পক্ষ আবার এর উত্তর দিতে থাকে। একপর্যায়ে উভয়পক্ষের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়। এ সময় তুমুল উত্তেজনা দেখা দেয়। পুলিশ মাঝখানে দাঁড়িয়ে সতর্ক অবস্থায় থাকে। তবে এ সময় ভোটগ্রহণ চলছিল।

আপিল বিভাগে পুলিশি হামলার বর্ণনা দিলেন বিএনপিপন্থিরা : বৃহস্পতিবার সকাল সোয়া ৯টায় প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে এজলাসে আসন গ্রহণ করেন আপিল বিভাগের ৮ বিচারপতি। এ সময় বুধবার ঘটে যাওয়া পুলিশের হামলা ও মামলার কথা তুলে ধরেন সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এ জে মোহাম্মদ আলী। পাশাপাশি আইনজীবীদের নিরাপত্তা চান তিনি।

এরপর প্রধান বিচারপতিকে সম্বোধন করে ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, আমরা আপনার আদালতের আইনজীবী। আপনি আমাদের অভিভাবক। আমরা কী এমন অপরাধ করেছি? গতকাল পুলিশ আইনজীবীদের নির্যাতন করল। এ থেকে নারী আইনজীবীরাও রেহাই পাননি। আমি পুলিশকে বলেছি, আমি সম্পাদক প্রার্থী। তারপরও আমাকে ধাক্কাতে ধাক্কাতে বের করে দেওয়া হয়েছে। আমাদের বিরুদ্ধে দুটি মামলা দায়ের হয়েছে। বার ভবনে আমাদের কক্ষগুলো লক করে দেওয়া হয়েছে। এ কারণে আমরা আপনাদের কাছে এসেছি।

ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, আমি নিজেও পুলিশের নির্যাতনের শিকার হয়েছি। আজও আমি ভালো করে হাঁটতে পারছি না। গতকাল মিলনায়তনের ভেতরে আইনজীবীদের পায়ের নিচে ফেলে নির্যাতন করেছে পুলিশ। সাংবাদিক ও নারী আইনজীবীদেরও লাঠিচার্জ করা হয়েছে। এ সময় বিএনপির আইনজীবীদের উদ্দেশে প্রধান বিচারপতি বলেন, আপনারা কোর্ট অফিসার। আমরা আপনাদের সম্মান করি। এখন আদালতে মামলা শুনব। আপনারা দুজন (ব্যারিস্টার খোকন ও কাজল) বেলা ১১টার সময় খাস কামরায় আসুন। আপনাদের কথা শোনা হবে। প্রয়োজনে অ্যাটর্নি জেনারেলকেও ডেকে আনব।

প্রধান বিচারপতির সঙ্গে বৈঠক করলেন বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা : বেলা ১১টার দিকে প্রধান বিচারপতির কার্যালয়ে গিয়ে দেখা করেন সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির এবারের নির্বাচনে বিএনপি সমর্থিত সভাপতি প্রার্থী ব্যারিস্টার এম মাহবুব উদ্দিন খোকন ও সম্পাদক প্রার্থী ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল। সমিতির এবারের নির্বাচন ঘিরে সৃষ্ট পরিস্থিতি নিয়ে তারা তাদের বক্তব্য তুলে ধরেন। এ সময় আপিল বিভাগের অপর সাত বিচারপতি উপস্থিত ছিলেন। বেলা ১১টা ৫৩ মিনিটে প্রধান বিচারপতির কার্যালয় থেকে বেরিয়ে আসেন বিএনপিপন্থি এই দুই আইনজীবী। এ সময় আপিল বিভাগের সামনের করিডরে অর্ধশতাধিক বিএনপিপন্থি আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন। দুপুর ১২টার দিকে হাইকোর্টের এনেক্স ভবনের সামনে গিয়ে তাদের পক্ষ থেকে ব্রিফিং করা হয়।

ব্রিফিংয়ে রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, ‘প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগের বিচারপতিরা আধা ঘণ্টা ধরে আমাদের বক্তব্য শুনেছেন। তারা বলেছেন, অ্যাটর্নি জেনারেলকে ডেকেছেন প্রধান বিচারপতি। আমাদের পর তারা তার সঙ্গে কথা বলবেন। করণীয় থাকলে এ সম্পর্কে জানাবেন।’ বিএনপিপন্থি দুই আইনজীবী চলে যাওয়ার কিছু সময় পর প্রধান বিচারপতির কার্যালয়ে যান অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন।

আওয়ামী ও বিএনপিপন্থিদের ধাক্কাধাক্কি : সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচন ঘিরে দ্বিতীয় দিনের মতো বৃহস্পতিবারও আওয়ামী লীগ ও বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা মুখোমুখি অবস্থান নিয়ে স্লোগান দেন। বিকাল চারটার দিকে তারা এই মুখোমুখি অবস্থান নেন। এর আগে এ নির্বাচনকে ঘিরে দুপুর ১২টার দিকে আইনজীবীদের মধ্যে ধাক্কাধাক্কির ঘটনা ঘটে। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এ সময় আওয়ামী লীগ ও বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা জোরে জোরে স্লোগান দিতে থাকেন। একপর্যায়ে উভয়পক্ষের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়।

দ্বিতীয় দিনের ভোটগ্রহণে বিপুলসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন : সুপ্রিমকোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের দ্বিতীয় দিনের নির্বাচনের ভোট বৃহস্পতিবার সকাল ১০টার পর থেকে শুরু হয়। এদিকে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিপুলসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়। এদিকে আইনজীবী সমিতির নির্বাচনের ব্যালট পেপার চুরি ও ছিঁড়ে ফেলা এবং নির্বাচনসংক্রান্ত আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র বাইরে ফেলে দেওয়ার অভিযোগে বুধবার সন্ধ্যায় শাহবাগ থানায় মামলা করেছেন নির্বাচন পরিচালনা কমিটির আহ্বায়ক মো. মনিরুজ্জামান। মামলায় বিএনপিপন্থি আইনজীবী মাহবুব উদ্দিন খোকন, রুহুল কুদ্দুসসহ ১২ জন আইনজীবীর নাম উল্লে­খসহ অজ্ঞাতনামা ১০০ জনকে আসামি করা হয়।

হামলার ঘটনায় ডিবি প্রধানের দুঃখ প্রকাশ : এদিন সুপ্রিমকোর্ট পরিদর্শন করেন ডিবিপ্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ। তিনি আহত সাংবাদিকদের বিষয়ে সহমর্মিতা জানাতে ল’ রিপোর্টার্স ফোরামের কার্যালয়ে যান এবং নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাত করেন। হারুন অর রশীদ হামলার ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেন এবং হাসপাতালে ভর্তি এটিএন নিউজের রিপোর্টার জাবেদ আক্তারের উন্নত চিকিৎসার ব্যাপারে আশ্বাস দেন। এ সময় ল’ রিপোর্টার্স ফোরামের সভাপতি আশুতোষ সরকারসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন।

ঘটনার পূর্বাপর : সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচন ঘিরে মূলত গত সোমবার থেকে উত্তেজনা শুরু হয়। এর আগে নির্বাচন পরিচালনাসংক্রান্ত উপকমিটির আহ্বায়ক সুপ্রিমকোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মো. মনসুরুল হক চৌধুরী ‘ব্যক্তিগত’ কারণ দেখিয়ে পদত্যাগ করেন। এই প্রেক্ষাপটে ভোট হবে কিনা, কে আহ্বায়ক হবেন, নাকি উপকমিটির অপর সদস্যরা নির্বাচন পরিচালনা করবেন এ নিয়ে গত মঙ্গলবার দিনভর আইনজীবীদের মধ্যে আলোচনা চলে। ওইদিন সন্ধ্যার পর সমিতি প্রাঙ্গণে আহ্বায়ক কমিটির প্রধান নিয়ে দুপক্ষের মধ্যে উত্তাপ ছড়ায়। সেই উত্তাপ বুধ ও বৃহস্পতিবার পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। এর মধ্যেই শেষ হয় দুদিনের ভোট।

সভাপতি একটি, সহসভাপতি দুটি, সম্পাদক একটি, কোষাধ্যক্ষ একটি, সহসম্পাদক দুটি ও সদস্যের সাতটিসহ মোট ১৪টি পদে এক বছর মেয়াদের জন্য এই নির্বাচন হয়ে থাকে। সমিতির কার্যনির্বাহী কমিটির ১৪টি পদের মধ্যে বর্তমান সভাপতি ও সম্পাদকসহ সাতটি পদে আছেন আওয়ামী লীগ সমর্থিত আইনজীবীরা। সহসম্পাদক ও কোষাধ্যক্ষসহ অপর সাতটি পদে আছেন বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here