ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে প্রয়োজন শুদ্ধাচার

0
411
ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে প্রয়োজন শুদ্ধাচার

খবর৭১ঃ বিদায়ী ২০১৯ সাল জুড়ে ব্যাংক খাত ছিল নানা চাপে। প্রতি প্রান্তিকেই খেলাপি ঋণ বেড়েছে, ঋণ পুনঃতপশিলের জন্য দেওয়া হয়েছে নানা সুযোগ। চাপ ছিল সুদ কমানোর। বেশির ভাগ ব্যাংকই গত ২০১৯ সালে এর আগের বছর অর্থাত্ ২০১৮ সালের চেয়ে বেশি পরিচালন মুনাফা অর্জন করেছে। গোটা অর্থনীতিতে রয়েছে নানা ধরনের চাপ। নতুন বছরে সেই সব চাপ মোকাবিলা করে এগিয়ে নিতে হবে অর্থনীতিকে। এ জন্য চলছে নানা পরিকল্পনাও চিন্তাভাবনা। ব্যাংক খাতে নতুন বছরে শৃঙ্খলা ও শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠা নিয়ে আমরা সবাই আশাবাদী হতে চাই।

ব্যাংকিং ব্যবস্থা যে একটি মাত্র বিষয়ের ওপর ভয় করে গড়ে উঠেছিল, সেটি হচ্ছে আস্থা বা বিশ্বাস। অর্থাত্ আদিযুগে, মানুষ নগদ অর্থকড়ি কিংবা সোনাদানা ঘরে জমিয়ে বা লুকিয়ে রাখার চেয়ে গির্জা বা মন্দিরের সিন্দুকে রাখাকে অধিকতর নিরাপদ মনে করত। কিন্তু আয় বা প্রতিদান ছাড়া এ রকম অলাভজনকভাবে সম্পদ জমিয়ে না রেখে তার বিপরীতে বিশ্বাসের সঙ্গে লাভ বা সুদ আয় শ্রেয়তর বিবেচিত হয়েছিল বলেই ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানের জন্ম। ব্যাংকিং সেবার ক্রম জটিলতর বিবর্তন এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সংঘটিত বিভিন্ন সময়ে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন সংকট ও কেলেঙ্কারি উদ্ঘাটনের পর ব্যাংকিং সেবা ও পেশায় নৈতিকতার প্রশ্নটি জোরালোভাবে সামনে উঠে এসেছে। বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে আর্থিক খাতে শুদ্ধাচার কৌশল বাস্তবায়নের বিষয়টি নিয়ে বিভিন্নমুখী আলোচনা হচ্ছে। জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল মৌলিক মানবাধিকার, সামাজিক সাম্য, সুবিচার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি কৌশল হিসেবে সরকারের কাছে বিবেচিত হয়েছে।

রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠানেই শুদ্ধাচার অনুশীলন অতি প্রয়োজনীয় বিষয়। এটিকে এড়িয়ে থাকার কোনো সুযোগ নেই। বিশেষ করে আর্থিক সেক্টর শুদ্ধাচার অনুশীলন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। আর্থিক সেক্টর একটি শৃঙ্খলাবদ্ধ সেক্টর। এখানে আর্থিক কর্মকাণ্ড নিয়ে সব বিষয়ে আবর্তিত হয় বিধায় এখানে বিশৃঙ্খলা, অনিয়ম, অসাধুতা, অনৈতিকতার চর্চা যে কোনো মূল্যে প্রতিরোধ প্রয়োজন।

রাষ্ট্র ও সমাজ দুর্নীতি দমন ও শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সরকার নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশলের রূপকল্প হচ্ছে সুখী সমৃদ্ধ সোনার বাংলা। আমাদের সবার কাঙ্ক্ষিত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের বাংলা গড়তে হলে রাষ্ট্রের সর্বস্তরে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সুশাসন প্রতিষ্ঠার বিকল্প নেই।

আমাদের সব উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির মূল কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে দেশের আর্থিক খাত। এখানে শৃঙ্খলা, সুশাসন এবং সর্বোপরি শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠা ছাড়া সমৃদ্ধি ও উন্নয়নের আশা করা যায় না। আর্থিক খাতে শুদ্ধাচারের চর্চা না থাকলে বিশৃঙ্খলা, অনিয়ম, দুর্নীতি বাসা বাঁধে সেখানে। তখন সব সমৃদ্ধি ও উন্নয়ন প্রক্রিয়া চরম হুমকির মধ্যে পড়ে যায়।

গত একদশকে বাংলাদেশে আর্থিক খাতে সংঘটিত বিভিন্ন কেলেঙ্কারি, অনিয়ম, অর্থ লোপাটের চাঞ্চল্যকর ঘটনাগুলো সবাইকে হতবাক করেছে। যুবক, ডেসটিনি, হলমার্ক, কিংবা বিসমিল্লাহ গ্রুপ প্রভৃতি নাম উচ্চারিত হতেই জনমনে এক ধরনের ঘৃণা, অস্বস্তি, অভক্তি ভাব জেগে উঠতে দেখা যায়। ব্যাংক খাতে সংঘটিত এসব অনিয়ম, দুর্নীতি, অর্থ লোপাটের ঘটনাগুলো একধরনের ভীতির সঞ্চার করেছে কর্মকর্তাদের মধ্যে। সবাই আজকাল নিজের গা বাঁচাতেই যেন বেশি ব্যস্ত। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বড়ো বড়ো ঋণগ্রহীতারা তা ফেরত দিতে চায় না, ব্যাংক কর্মকর্তারা প্রায় ক্ষেত্রে বড়ো বড়ো ঋণখেলাপির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে গিয়ে পদে পদে হোঁচট খান, বাধার সম্মুখীন হন। এসব কারণে এখন ব্যাংক খাতে ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে বিরাজ করছে স্থবিরতা, অনাগ্রহ।

আস্থা ও বিশ্বাসের ওপর ভর করে যে ব্যাংকিং ব্যবসার বিস্তৃত ঘটেছে পৃথিবীব্যাপী তা শুদ্ধাচার এবং নৈতিকতার অভাবে অনেকটাই হুমকির মধ্যে পড়ে গেছে। ব্যাংকে প্রতারণা, ঋণ জালিয়াতি, অনিয়ম, দুর্নীতি বাড়ছে। ব্যাংকিংও যে একধরনের ব্যবসা, এটা যেমন সত্যি, তেমনি ব্যাংক যে অন্যের আমানত নিয়ে ব্যবসা করে সেটিও অস্বীকার করার উপায় নেই। ঠিক এ কারণে অন্যান্য ব্যবসা-প্রয়াসের চেয়ে ব্যাংকের কাছ থেকে মানুষ অধিকতর নৈতিকতা ও দায়িত্বশীলতা প্রত্যাশা করে।

ব্যাংক জনগণ, জনগণের অর্থ বা অর্থের সমমূল্য পণ্য নিয়ে বিভিন্ন ধরনের কর্মকাণ্ড চালায়, ব্যবসা করে। মানুষ সবসময়েই উচ্চাকাঙ্ক্ষী এবং অর্থ হলো একটি স্পর্শকাতর সম্পদ। কাজেই মানসম্মত গ্রাহক সেবা ও বিশ্বাসযোগ্যতা, দুটোই ব্যাংকের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ দুটি বিষয় প্রধানত নির্ভর করে প্রাতিষ্ঠানিক দৃষ্টিভঙ্গি ও নৈতিকতার চর্চার ওপর। গ্রাহক সেবার ক্ষেত্রে দায়বদ্ধতা, স্বচ্ছতা, সততা ও ন্যায়পরায়ণতা, পরিপালন, নিরাপত্তা, গোপনীয়তা প্রভৃতি মৌলিক আদর্শ ও নৈতিকতা প্রতিষ্ঠা বা চর্চা নিশ্চিত করা হলে ব্যাংক তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে তেমন কোনো প্রতিকূলতার মুখোমুখি হবে না। অতএব ব্যাংক ব্যবস্থাপনার শুদ্ধাচার চর্চা ও প্রতিষ্ঠার জন্য সবাইকে আন্তরিক এবং নিবেদিতপ্রাণ হতে হবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here