বিপাকীয় সমস্যা যখন জন্মগত, কী করবেন?

0
221

খবর৭১ঃ
জন্মগত মেটাবলিক রোগসমূহ বংশগতভাবে বাহিত হয়। এতে নবজাতক বা শিশুর দেহে এক বা একাধিক এনজাইমের ঘাটতি বা কাজের অস্বাভাবিকতার কারণে প্রোটিন সংশ্লেষ বাধাগ্রস্ত হয়।

ফলে কোনো দেহবর্জ্য ক্রমশ দেহে জমা হতে থাকে ও পরবর্তী ধাপের উপাদানটি তৈরি করতে ব্যর্থ হয়। ক্ষতিকারক উপাদানের পরিমাণ দেহে বাড়তে থাকে।

জন্মগত বিপাকীয় সমস্যার ধরন ও প্রতিকার নিয়ে বিস্তারিত জানিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যলয়ের এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. শাহজাদা সেলিম।

প্রধানত জিনের মিউটেশনের কারণে এ সমস্যাটি ঘটে। মিউটেশন জিনের একটি নির্দিষ্ট এনজাইমের নিয়ন্ত্রক অংশটিতে ঘটলে ওই এনজাইম এবং তার কো-এনজাইম বা কো-ফ্যাক্টর কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলে; তথ্য প্রবাহকারী প্রোটিন ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং সংবেদনশীল সিস্টেমের কার্যকারিতা ব্যাহত হয়।

পৃথিবীতে কমপক্ষে তিনশ’ জন্মগত মেটাবলিক রোগ শনাক্ত হয়েছে। দিনে দিনে আরও এ ধরনের নতুন রোগ শনাক্ত হচ্ছে। এ দলভুক্ত অনেক রোগ শনাক্ত হওয়ার বাইরে আছে। বিভিন্ন দেশের প্রায় পাঁচ হাজার জীবিত শিশুর মাঝে একজন এ রোগে আক্রান্ত থাকতে পারে। এ দলভুক্ত রোগগুলোর একেকটির প্রাবল্য একেক রকম।

যেমন- ফ্যামিলিয়াল হাইপার কোলেস্টেরলেমিয়া প্রতি পাঁচশ’ জীবিত নবজাতকের একজনের থাকতে পারে; ফিনাইল কিটোনরিয়া বারো হাজারে একজনের থাকতে পারে; অর্গানিক এসিডোইউরিয়া পনেরো হাজারে একজনের থাকতে পারে; গ্লাইকোজেন স্টোরেজ ডিজিজ ষাট হাজারে একজনের; গ্যালাকটোসেমিয়া পঁয়তাল্লিশ হাজারে একজনের; হমোসিস্টোনরিয়া এক লাখে একজন এবং ম্যাপলসিরাপ ইউরিনডিজি দুই লাখ নব্বই হাজার নবজাতকের মাঝে একজনের থাকতে পারে।

এ জিনগত ত্রুটিসমূহ অটোসোমাল রিসেসিভ ট্রেইট হিসাবে পূর্ব পুরুষ থেকে উত্তর পুরুষে বাহিত হয়। কোনো একজনের দেহে এ রোগ থাকলে পরবর্তী চারটি সন্তানের একজনের (২৫ শতাংশ) আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকবে। এ দলভুক্ত কিছু রোগ এক্স-লিঙ্কড্; যেখানে মাতা বাহক, পুরুষদের ৫০ শতাংশ স্বাভাবিক অথবা রোগাক্রান্ত। মাইটোকন্ড্রিয়াল রোগগুলো যাদের আছে তাদের সবকটি (১০০%) সন্তানই এ রোগে আক্রান্ত হবে।

এ রোগকে দুটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয় : ক্যাটাগরি ১ এর রোগসমূহে আক্রান্ত ব্যক্তির এনজাইমের কার্যকারিতা ব্যাহত হয়। ক্যাটাগরি ২ এ দলভুক্ত রোগসমূহে মেটাবলিক পাথওয়ে আক্রান্ত হয়। ক্যাটাগরি ২ এর রোগসমূহকে আবার ১, ২, ৩ এভাবে ভাগ করা হয়।

এ রোগগুলোর শারীরিক লক্ষণ নবজাতক শিশু কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরিণত বয়সেও দেখা দিতে পারে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে অনির্দিষ্ট বিপাকীয় লক্ষণসমূহ দেখা দিতে পারে।

যেমন- শিশুর খাদ্য গ্রহণে অনীহা, ঘন ঘন বমি হওয়া, পানি শূন্যতা, দুর্বল বোধ করা, মাংশপেশি থলথলে বা শক্তিহীন মনে হওয়া এবং খিচুনি। কোনো কোনো শিশুর শরীরে ইনফেকশনেও এ রকম দেখা দেয়।

এ দলভুক্ত শিশুদের মৃত্যুর অন্যতম কারণ হল জীবাণু সংক্রমণ। তবে কিছু কিছু শিশুর তীব্র শ্বাসকষ্ট হতেও দেখা যায়। কিছু কিছু নবজাতক এ রোগগুলোর লক্ষণ নিয়ে জন্ম গ্রহণ করে। যদিও ভালোভাবে লক্ষ্য না করলে তা শনাক্ত হতে সময় লাগতে পারে।

এ রোগগুলোকে শনাক্ত করার উদ্দেশ্যে নবজাতকদের স্ক্রিনিং টেস্ট করার কোনো বিকল্প নেই। এতে যাদের রোগ ধরা পড়বে তাদের চিকিৎসা দিতে হবে এবং ভালো ফলাফল সেক্ষেত্রে আশা করা যেতে পারে।

পরিণত বয়সে বা পরে কোন এক সময় এ রোগগুলো ধরা পড়লে চিকিৎসার পরও ভালো ফল পাওয়ার সম্ভাবনা কমে যাবে। অনেক ক্ষেত্রে রোগাক্রান্ত সন্তান ধারণকারিণী মা’রও বেশ কিছু সমস্যা দেখা দেয়। যেমন- ফিনাইল কিটোনরিয়ায় আক্রান্ত মাকে সন্তান গর্ভে ধারণকারী সময়ে খাদ্যাভ্যাসে কঠোর নিয়ন্ত্রণ আনতে হয়। গ্লাইকোজেন স্টোরেজডিজিজ রোগীদের অসিদ্ধ ভুট্টার শর্করা যথেষ্ট ভালো ফল পাওয়া যায়।

মেটাবলিক ত্রুটি সাপেক্ষে শৈশবে বা কৈশোরে রোগের লক্ষণ দেখা দেয়া নির্ভর করে। যেমন- প্রোপাইওনিয়া এসিডেমিয়ায় আক্রান্ত বালকদের মাঝে মাঝেই ২-৩ দিন যাবৎ বমি হতে থাকে, যা খাদ্য গ্রহণে বিরত থাকলেই ঠিক হয়ে যায়।

এ রোগে আক্রান্ত পরিণত বয়সিদের হাত-পা কাঁপে এবং ক্রমশ স্মৃতিশক্তি লোপ পেতে থাকে। যাদের ফ্রুকটোজ জাতীয় খাদ্য হজমে এনজাইমের ত্রুটি থাকবে তারা ফ্রুকটোজ জাতীয় খাবার খেলে মারাত্মক বিপাক জনিত সমস্যায় পড়বেন। এনিমিয়া বিপাক জনিত সমস্যার রোগীরা সবচেয়ে মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হন এবং ঘন ঘন আইসিইউতে নিতে হতে পারে।

শৈশব বা কৈশোরে কিছু কিছু রোগের লক্ষণ দেখা দেয়। যেমন- এলক্যাপটোনরিয়ায় আক্রান্তদের বড় বড় জয়েন্টগুলোতে ও মেরুদন্ডে ব্যথা শুরু হয় তৃতীয় বা চতুর্থ দশকে।

হাইপোগ্লাইসেমিয়া (রক্তে গ্লুকোজ বেশি কমে যাওয়া) পরে যে রোগগুলো সেগুলো সাধারণত শৈশবেই প্রতিভাত হয়। যেসব শিশু-কিশোর অল্প পরিশ্রমে কাতর হয়ে পড়ে, তাদেরও এ দলভুক্ত রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি। উইলসনডিজিজ কৈশোরে বা প্রাপ্তবয়সেই দেখা দেয়।

রোগ শনাক্তকরণের উদ্দেশ্যে সুনির্দিষ্ট পরীক্ষা করা হয়। যা রোগীর লক্ষণ, পারিবারিক ইতিহাস ইত্যাদিও ভিত্তিতে নিরূপিত হয়। এ রোগগুলো অনেক সময়ই অগোচরে থেকে যায় আর যখন তীব্র লক্ষণ দেখা দেয়, তখন রোগ শনাক্তকরণের চেষ্টা করা হয়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here