দেশে দেশে সরকারবিরোধী আন্দোলনের ঝড়

0
463
দেশে দেশে সরকারবিরোধী আন্দোলনের ঝড়

খবর৭১ঃ
দেশে দেশে চলছে সরকারবিরোধী আন্দোলন, বিক্ষোভ। গণতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক অধিকারের দাবিতে প্রাণ দিচ্ছে অগণিত মানুষ। এসব আন্দোলনের ধরন, কারণ এবং এগুলোর লক্ষ্যের মধ্যে পার্থক্য থাকলেও কিছু ক্ষেত্রে বিক্ষোভগুলোতে সাদৃশ্য রয়েছে। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে আন্দোলন চলছে ইরাক, লেবানন, স্পেনের কাতালোনিয়া, চিলি, বলিভিয়া, চীনের হংকংসহ বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলে। ইরাকে সরকারবিরোধী বিক্ষোভে সহিংসতায় গত দুই দিনেই অর্ধশত মানুষ নিহত হয়েছে। চিলিতে আন্দোলনের মুখে মন্ত্রিসভা ভেঙে দিয়েছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট সেবাস্তিয়ান পিনেরা। স্বাধিকারের দাবিতে রাজপথে আন্দোলন করছে কাতালোনিয়ার লাখ লাখ মানুষ। বন্দি প্রত্যর্পণের বিল আনুষ্ঠানিকভাবে বাতিলের পরও রাজনৈতিক স্বাধীনতার দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত রেখেছে হংকংয়ের বাসিন্দারা।

মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ ইরাকে চলমান রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা জানিয়ে এর সংস্কারের দাবি তুলেছে জনগণ। ইরাক সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা মেধার ভিত্তিতে সরকারি কাজে নিয়োগ না দিয়ে জাতিগত ও অন্যান্য বিবেচনায় নিয়োগ দিচ্ছে। জনগণের টাকা নষ্ট করে নেতারা এবং তাদের অনুসারীরা বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিচ্ছেন। কিন্তু সাধারণ মানুষের জীবনে সরকারি কোষাগারের অর্থ কোনো কাজে আসছে না। সরকারের এই বৈষম্য নীতির বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের বিক্ষোভ সহিংসতায় গত শুক্র ও শনিবার অন্তত ৬৭ জন ইরাকি নিহত হয়েছে। চলতি মাসে শুরু হওয়া প্রধানমন্ত্রী আদেল আবদুল মাহদি সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে রাজধানী বাগদাদসহ বিভিন্ন শহরে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে নিরাপত্তা বাহিনী ও মিলিশিয়া গোষ্ঠীগুলোর সংঘর্ষে দুই শতাধিক লোক নিহত হয়েছে। সহিংসতা অব্যাহত থাকায় শনিবার রাতে দেশটির অভিজাত কাউন্টার টেররিজম সার্ভিসের (সিটিএস) সদস্যদের বাগদাদ ও দক্ষিণাঞ্চীয় শহর নাসিরিয়ার রাস্তায় নামার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী মাহদি। তবে বিক্ষোভকারীরা দাবি আদায়ে রাজপথে থাকার ঘোষণা দিয়েছে।

মধ্যপ্রাচ্যের আরেক দেশ লেবাননে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে জ্বালানি, তামাক ও হোয়াটসঅ্যাপ কলের ওপর নতুন করারোপ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে অর্থনৈতিক সমস্যা, বৈষম্য ও দুর্নীতির অভিযোগও। এই আন্দোলন দ্বিতীয় সপ্তাহে গড়িয়েছে। গতকালও লেবাননের বিক্ষোভকারীরা মানববন্ধনের আয়োজন করে। আন্দোলনের মুখে নড়বড়ে পরিস্থিতির মুখে দেশটির জোট সরকার। সম্প্রতি দুর্নীতির অভিযোগে মিশরীয় সরকারের বিরুদ্ধেও বিক্ষোভ হয়। যদিও কঠোরভাবে সেই বিক্ষোভ দমন করেছে প্রেসিডেন্ট আব্দেল ফাত্তাহ আল-সিসির সরকার।

লাতিন আমেরিকার কয়েকটি দেশে বেশ কিছুদিন ধরেই ক্ষোভের বিস্ফোরণ দেখা গেছে। ভেনিজুয়েলার পর এবার চিলিতে আন্দোলন দানা বেঁধেছে। এর কারণ হলো দ্রব্যের উচ্চমূল্য। সম্প্রতি জ্বালানি তেলের উচ্চমূল্য এবং দেশটির দুর্বল মুদ্রার কারণ দেখিয়ে চিলি সরকার বাস ও মেট্রোর ভাড়া বৃদ্ধি করে। এর প্রতিবাদে সরকারবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। গত শুক্রবার রাজধানী সান্তিয়াগোতে বিক্ষোভে ১০ লাখের বেশি মানুষ জড়ো হয়। দক্ষিণ আমেরিকার অন্যতম ধনী দেশ চিলি। কিন্তু দেশটিতে তীব্রভাবে ধনবৈষম্য বিরাজমান। আন্দোলনের মুখে চিলির মন্ত্রিসভা ভেঙে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট সেবাস্তিয়ান পিনেরা। বিক্ষোভকারীদের দাবি মেনে নিয়ে অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি।

সম্প্রতি লাতিন আমেরিকার আরেক দেশ ইকুয়েডরে প্রবল বিক্ষোভ হয়। সরকারি খরচ কমানোর অংশ হিসেবে সরকার হঠাৎ করেই জ্বালানিতে ভর্তুকি বন্ধ করার ঘোষণা দেওয়ার পর বিক্ষোভ শুরু হয়। বিক্ষোভকারীরা সরকারি সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে এবং ভর্তুকির দাবিতে আন্দোলনে নেমে রাজপথ বন্ধ করে দেয়, সংসদে হামলে পড়ে এবং নিরাপত্তারক্ষীদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায়। শেষ পর্যন্ত আন্দোলনের মুখে সরকার জ্বালানি তেলে ভর্তুকি বন্ধের সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে।

বিক্ষোভ হচ্ছে লাতিন আমেরিকার আরেক দেশ বলিভিয়ায়। নির্বাচনে জালিয়াতির অভিযোগ এনে রাজপথে বিক্ষোভ করছে বিরোধী দল ও সাধারণ মানুষ। এই বিক্ষোভের মধ্যে গত বৃহস্পতিবার ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট ইভো মোরালেসকেই জয়ী ঘোষণা করেছে দেশটির নির্বাচনী ট্রাইব্যুনাল। তবে বিরোধী প্রার্থী মেসা নির্বাচনের ফল গণনাকে ‘বড়ো ধরনের জালিয়াতি’ আখ্যা দিয়ে নতুন নির্বাচনের দাবিতে বিক্ষোভ অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছেন। বলিভিয়ায় সবচেয়ে বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় রয়েছেন প্রেসিডেন্ট মোরালেস। এ নিয়ে টানা চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় এসেছেন তিনি।

রাজনৈতিক স্বাধীনতার দাবিতে বিক্ষোভ চলছে চীনের নিয়ন্ত্রণে থাকা হংকংয়ে। বন্দি প্রত্যর্পণ নিয়ে সরকারি একটি বিলের বিরোধিতা করতে গিয়ে এই গ্রীষ্মে হংকংয়ে বিক্ষোভের সূত্রপাত। বিলটিতে বলা ছিল, কোনো অপরাধী ব্যক্তিকে কিছু নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে চীনের মূল ভূখণ্ডে হস্তান্তর করা যাবে। হংকং চীনের অংশ হলেও এই স্থান বিশেষ স্বাধীনতা ভোগ করে থাকে। কিন্তু হংকংয়ের মানুষের মধ্যে এই বোধ তীব্র হচ্ছে যে বেইজিং তাদের ওপরে আরো বেশি মাত্রায় নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে চায়। চিলি ও লেবাননের মতোই হংকংয়ের বিক্ষোভেও কাজ হয়েছে। বিতর্কিত বিলটি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রত্যাহার করেছে কর্তৃপক্ষ। তবু বিক্ষোভ এখনো চলমান। গতকাল রবিবারও হংকংয়ে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়েছে। ঐ অঞ্চলের পর্যটন জেলা টিসিম সা টিসুই থেকে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে টিয়ার গ্যাস ও পেপার স্প্রে নিক্ষেপ করে পুলিশ। এ সময় কয়েকজন বিক্ষোভকারীকেও আটক করে তারা।

আন্দোলন চলছে স্পেনের কাতালোনিয়ায়। গত ১৪ অক্টোবর কাতালোনিয়ার স্বাধীনতাপন্থি নেতাদের কারাবন্দি করার প্রতিবাদে স্পেনের বার্সেলোনার রাস্তায় নেমে আসে লাখ লাখ মানুষ। ২০১৭ সালে বার্সেলোনায় ‘অবৈধ’ গণভোটের আয়োজন করা এবং স্বাধীনতা ঘোষণার কারণে রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে বেশ কয়েকজনকে সম্প্রতি দোষী সাব্যস্ত করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। কিন্তু এই রায় ঘোষণার কিছুক্ষণের মধ্যেই বিক্ষোভে নামে কাতালোনিয়ার মানুষ। গত শনিবার কাতালোনিয়ার পুলিশ সদর দপ্তরের বাইরে বিক্ষোভের সময় স্বাধীনতাকামীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়েছে। কাতালোনিয়ার স্বায়ত্তশাসন ও রাজবন্দিদের মুক্তির দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছে তারা। স্পেনের স্থানীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে দেখা যায়, বিক্ষোভকারীদের একটি দল স্লোগান দিয়ে বলছে, ‘আমরাও দেখাব আরেক হংকং’।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here