বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্কের নতুন অধ্যায়

0
30

 

বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্ক নানা উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়েছে। বিশেষত, পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ে বৈঠক ও যোগাযোগ বিগত অতীতে দৃশ্যত বন্ধই ছিল। এ বৈঠক সর্বশেষ হয়েছিল ২০১০ সালে। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের ষষ্ঠ বৈঠক অনুষ্ঠিত ১৭ এপ্রিল। প্রায় ১৫ বছরের বিরতিতে অনুষ্ঠিত বৈঠকে অংশ নিতে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব আমনা বালুচ আগের দিন দুপুরে ঢাকায় আসেন। পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠকের পর আমনা বালুচ অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। কাজেই দেড় দশক পর প্রথম যে বৈঠক হলো তাতে বিদ্যমান অনেক সমস্যার সমাধান একদিনে হয়ে যাবে বলে আশা করা যায় না। তবে, উভয় পক্ষের মধ্যে আলোচনার পরিবেশ ও সদিচ্ছা থাকলে সম্পর্কে নতুন অধ্যায় সূচিত হতে পারে।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব বলেছেন, পাকিস্তানের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে, ১৫ বছর পর ঢাকা-ইসলামাবাদ আলোচনা শুরু হওয়ায় তারা অমীমাংসিত বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করবেন। তিনি আরও বলেন, আমাদের সম্পর্কের ভিত্তি দৃঢ করতে এ বিষয়গুলো সমাধান করা প্রয়োজন। পররাষ্ট্র সচিব বলেন, পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দারেরও আগামী ২৭-২৮ এপ্রিল বাংলাদেশ সফরের কথা রয়েছে। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে শিগগির সরাসরি ফ্লাইট চালু হবে বলেও আশা প্রকাশ করেন তিনি।

এদিকে, ১৯৭১ সালের গণহত্যার জন্য পাকিস্তানকে ক্ষমা চাইতে বললো ঢাকা। এ ইস্যুতে আলোচনা চালিয়ে নিতে একমত হয়েছে পাকিস্তান। এছাড়া ঐতিহাসিকভাবে অমীমাংসিত ইস্যু সমাধানের জন্য গুরুত্ব আরোপ করেছে বাংলাদেশ। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব এসব কথা বলেন।

এ কথা সত্য যে, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক কখনোই স্থির থাকে না। সময়, প্রেক্ষাপট এবং বাস্তবতার নিরিখে রাষ্ট্রগুলোকে নিজেদের পররাষ্ট্রনীতি পুনর্মূল্যায়ন করতে হয়। বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্ক, যার ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে ১৯৭১ সালের এক রক্তাক্ত যুদ্ধের মাধ্যমে, বর্তমানে একটি নতুন মোড় নিচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব আমনা বালুচের ঢাকা সফর এবং এই সফরকে ঘিরে বাংলাদেশের দৃঢ় ও আত্মমর্যাদাসম্পন্ন কূটনৈতিক অবস্থান একটি নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে। সামনের দিকগুলোতে উভয় দেশের মধ্যে আরও উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকেও ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের শীর্ষ নেতৃত্বও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক সন্মেলনের সুযোগে মিলিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন, যা উভয় দেশের সম্পর্ক উন্নয়নে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে।

বাংলাদেশপন্থি পররাষ্ট্রনীতির প্রয়োজনীয়তা

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি অতীতে নানাভাবে চিহ্নিত হয়েছে। কখনও বলা হয়েছে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি ‘‘ভারতপন্থী“ কিংবা কখনও ছিল “পাকিস্তানপন্থী”। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের পদক্ষেপ নিয়ে অনেক সমালোচক সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তারা এটাও পর্যবেক্ষণ করেছেন যে, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি কোন দিকে যায়। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বর্তমান সরকার যে পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করছে তা আদতে “বাংলাদেশপন্থি”—অর্থাৎ, এটি দেশের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে গঠিত। রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ও ন্যায্য দাবি আদায়ের যে অবস্থান বাংলাদেশ নিয়েছে, তা স্বাধীন ও স্বাবলম্বী পররাষ্ট্রনীতির প্রকৃষ্ট উদাহরণ। শুধু পাকিস্তানের ক্ষেত্রে সম্পর্ক প্রসঙ্গেই নয়, বাংলাদেশের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ইস্যুতে, যেমন রোহিঙ্গা সমস্যার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বর্তমানের নিজস্ব জাতীয় স্বার্থের নিরিখে অগ্রসর হচ্ছে। পাকিস্তানের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে সম্পর্ক পুনর্নিমাণের প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এতে একটি বাস্তবধর্মী পররাষ্ট্রনীতির ছাপ বাংলাদেশের আচরণ ও কার্যক্রমে ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে।

অমীমাংসিত বিষয়গুলোর পুনরুত্থান ও বাংলাদেশের কূটনৈতিক অবস্থান

পাকিস্তানের ক্ষেত্রে সম্পর্ক উন্নত করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ নিজের স্বার্থের কথা মোটেও বিস্মৃত হয় নি। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে পাকিস্তানের কাছে ১৯৭১ সালের গণহত্যার জন্য আনুষ্ঠানিক ক্ষমা চাওয়ার দাবির পাশাপাশি ৪.৩২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সম্পদ দাবির পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। তাছাড়া আটকে পড়া পাকিস্তানি নাগরিকদের প্রত্যাবাসনের অনুরোধও জানানো হয়েছে, যা সবই একটি পরিপক্ব, দায়িত্বশীল এবং ইতিহাস সচেতন পররাষ্ট্রনীতির বহিঃপ্রকাশ। এই দাবি কেবল অতীতের ন্যায্য হিসেব নয়; এটি ভবিষ্যতের সম্পর্ক গঠনের প্রাথমিক শর্তও বটে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এই দাবিগুলোর উত্থাপন কেবল প্রতীকী নয়, বরং কূটনৈতিকভাবে সুপরিকল্পিত এই বার্তা দেওয়া হয়েছে যে, অতীত মীমাংসা ছাড়া ভবিষ্যত নির্মাণ সম্ভব নয়।

আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের কৌশল

পূর্ব-ধারণা ও নানা রকম মেরুকরণের আশঙ্কার বিপরীতে, অন্তর্বর্তী সরকার পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনাকে মূল হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। কারণ, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নির্মাণে েযুক্তিপূর্ণ আলোচনাই শেষ কথা। এতে দীর্ঘ বিরতির পর পাকিস্তানকে আলোচনার টেবিলে ফিরিয়ে আনা এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্ভাবনা অন্বেষণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের কূটনৈতিক দক্ষতা প্রতিভাত হয়েছে। বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে পাকিস্তানের সফররত পররাষ্ট্র সচিবের সাক্ষাৎ ও আলোচনা কৌশলগত ধারাবাহিকতারই অংশ, যা আলোচনার মাধ্যমে সম্পর্ক উন্নয়ন ও সমস্যার সমাধানের শান্তিপূর্ণ পন্থার নির্দেশ করেছে।

পররাষ্ট্রনীতিতে স্বাধীন পরিচয়ের প্রতিফলন

“এক প্রতিবেশীকে খুশি করতে অন্য প্রতিবেশীর সঙ্গে দূরত্ব বাড়ানো”—এমন পররাষ্ট্রনীতি একটি স্বাধীন জাতির জন্য অবমাননাকর। বাংলাদেশ এই ফাঁদে পা না দিয়ে কৌশলগত ভারসাম্যের মাধ্যমে সব প্রতিবেশীর সঙ্গে পরিপক্ব, স্বার্থভিত্তিক ও বাস্তবধর্মী সম্পর্ক গড়ার পথ নিচ্ছে। এই কৌশল ভারত কিংবা চীন কিংবা পাকিস্তান—কোনও পক্ষকেই একতরফাভাবে প্রাধান্য দেয় না, বরং বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়। পাকিস্তান প্রসঙ্গেও বাংলাদেশ তার পররাষ্ট্রনীতিতে স্বাধীন পরিচয়ের প্রতিফলন ঘটিয়েছে।

স্পষ্টতই, জুলাই-পরবর্তী পরিবর্তনের পর বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সম্পর্ক নতুন মোড় নিচ্ছে এবং এই মোড় বদলে পেছনে রয়েছে কৌশলগত বাস্তবতা ও আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সম্ভাবনার উপলব্ধি এবং বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ নিশ্চিত করার তাগিদ। অতীতের ইতিহাসকে অস্বীকার না করে বরং সম্মান ও ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে আলোচনার মাধ্যমে ভবিষ্যৎ গড়ার যে প্রচেষ্টা বর্তমান সরকার নিয়েছে, তা একটি আত্মমর্যাদাপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতির উদাহরণ হয়ে থাকবে। এই দৃষ্টিভঙ্গি একদিকে যেমন আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশের অবস্থানকে মজবুত করবে, তেমনি আঞ্চলিক শান্তি ও সহযোগিতার নতুন দ্বার উন্মোচন করতে সক্ষম হবে। তদুপরি, বাংলাদেশের আত্মমর্যাদা ও স্বতন্ত্র অবস্থানের বিষয়গুলোও আন্তর্জাতিক এবং আঞ্চলিক পরিসরে সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত হবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here