বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনে ভারসাম্য ঘাটতির মুখে

0
274

খবর৭১ঃ আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়া এবং রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনে ভারসাম্য ঘাটতির মুখে পড়েছে। গত ১১ মাসেই এই ঘাটতি দাাঁড়িয়েছে ১৭ বিলিয়ন ডলার। এই অবস্থা চলতে থাকলে এক বছরে ঘাটতি ২০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছানোর শঙ্কা রয়েছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। ইতিমধ্যে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে এর প্রভাব পড়েছে।

সম্প্রতি এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (এসিইউ) দায় শোধের পর দুই বছরে প্রথমবার রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমেছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যে এতটা ঘাটতি আর দেখা দেয়নি। আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়া এবং রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাওয়ার কারণে বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনে এই ঘাটতি দেখা দিয়েছে।
এসিইউ হলো এমন একটি ব্যবস্থা যার মাধ্যমে অংশগ্রহণকারী দেশগুলো আঞ্চলিক লেনদেনের জন্য আমদানি পেমেন্ট নিষ্পত্তি করে। বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, ইরান, মালদ্বীপ, মিয়ানমার, নেপাল, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা এসিইউ-এর সদস্য। ইরানের রাজধানী তেহরানে এর সদর দপ্তর। এই ব্যবস্থায় দেশগুলোর কেন্দ্রীয়ব্যাংকগুলোকে প্রতি দুই মাস অন্তর আমদানির অর্থ পরিশোধ করতে হয়।

সদ্য বিদায়ী ২০২১-২০২২ অর্থবছরের ১১ মাসে (জুলাই-মে) বাংলাদেশে পণ্য বাণিজ্যে সার্বিক ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩০ দশমিক ৮১ বিলিয়ন ডলার। এর আগে কখনও এতো বড় বাণিজ্য ঘাটতির মুখে পড়েনি দেশ। গত অর্থবছরের একই সময়ের এই ঘাটতি ছিল ২০ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলার। আর পুরো অর্থবছরে এই ঘাটতি ছিল ২২ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলার।

সাধারণভাবে চলতি হিসাবের মাধ্যমে দেশের নিয়মিত বৈদেশিক লেনদেন পরিস্থিতি দেখানো হয়। আমদানি-রপ্তানিসহ অন্যান্য নিয়মিত আয়-ব্যয় এতে অন্তর্ভুক্ত হয়। এখানে উদ্বৃত্ত হলে চলতি লেনদেনের জন্য দেশকে কোনো ঋণ করতে হয় না। আর ঘাটতি থাকলে তা পূরণ করতে ঋণ নিতে হয়। পণ্য ও সেবাবাণিজ্যে ঘাটতি অনেক বেড়ে যাওয়ায় এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে চলতি হিসাবের ভারসাম্যে।

গত ৩০ জুন ২০২১-০২২ অর্থবছর শেষ হলেও বাংলাদেশ ব্যাংক চলতি জুলাই মাসের ৭ তারিখে বিদায়ী অর্থবছরের ১১ মাসের (জুলাই-মে) বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেন ভারসাম্যের তথ্য প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যায়, ওই ১১ মাসে বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৭ দশমিক ২৩ বিলিয়ন ডলার। আগের অর্থবছর অর্থাৎ ২০২০-২০২১ অর্থবছরের একই সময়ে এই ঘাটতি ছিল মাত্র ২ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বিদায়ী ২০২১-২০২২ অর্থবছর শুরুই হয়েছিল লেনদেনের ভারসাম্যে ঘাটতি নিয়ে। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই ঘাটতির পরিমাণ ছিল ২ দশমিক ৩১ বিলিয়ন ডলার। চার মাস শেষে (জুলাই-অক্টোবর) তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪ দশমিক ৭৭ কোটি ডলারে। এভাবে প্রতি মাসেই বাড়তে বাড়তে ১১ মাস শেষে এই ঘাটতি ১৭ দশমিক ২৩ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে।

অর্থনীতিবিদরা মনে করেছেন, এই ঘাটতি অব্যাহত থাকলে বিদায়ী অর্থবছরে ১২ মাসে বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনের চলতি ঘাটতি ২০ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে ঠেকতে পারে। তারা বলেছেন, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল, খাদ্যপণ্যসহ সব ধরনের জিনিসের ঊর্ধ্বমূল্য আমদানি খরচ বাড়ার একটি কারণ। সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নানা উদ্যোগ নেওয়ার পরও আমদানি ব্যয়ের লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না। আমদানি ব্যয় বাড়লেও এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে না রপ্তানি।

অন্যদিকে, ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হচ্ছে রেমিট্যান্স প্রবাহে। বেশ কয়েক বছর পর ২০২০-২০২১ অর্থবছরে সামগ্রিক লেনদেন ভারসাম্যে ঘাটতিতে পড়ে বাংলাদেশ। প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি নিয়ে শেষ হয়েছিল ওই বছর। তার আগে ৯ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলারের বড় উদ্বৃত্ত নিয়ে ২০১৯-২০২০ অর্থবছর শেষ হয়েছিল। তার আগের বছরে উদ্বৃত্ত ছিল ৩ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলার।

সামগ্রিক লেনদেন ভারসাম্যেও ঘাটতির মুখে পড়েছে বাংলাদেশ। বিদায়ী অর্থবছরের জুলাই-মে সময়ে এই ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ৩০ বিলিয়ন ডলার। অথচ গত বছরের একই সময়ে এই উদ্বৃত্ত ছিল ৮ দশমিক ৫২ বিলিয়ন ডলার।

এদিকে, বিদায়ী ২০২১-২০২২ অর্থবছরের ১১ মাসে (জুলাই-মে) বাংলাদেশে পণ্য বাণিজ্যে সার্বিক ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩০ দশমিক ৮১ বিলিয়ন ডলার। এর আগে কখনও এতো বাণিজ্য ঘাটতির মুখে পড়েনি দেশ। গত অর্থবছরের একই সময়ের এই ঘাটতি ছিল ২০ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলার। আর পুরো অর্থবছরে এই ঘাটতি ছিল ২২ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলার।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, ২০২১-২০২২ অর্থবছরের জুলাই-মে ৭৫ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলারের বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ। এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৩৯ শতাংশ বেশি। ২০২০-২০২১ অর্থবছরের এই ১১ মাসে ৫৪ দশমিক ২৩ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছিল। অন্যদিকে জুলাই-মে সময়ে বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে ৪৪ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ডলার আয় হয়েছে। যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৩৩ শতাংশ বেশি। এ হিসাবেই ১১ মাসে পণ্য বাণিজ্যে সার্বিক ঘাটতি দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩১ বিলিয়ন ডলার। নতুন বছরেও বাণিজ্য ঘাটতি কমবে এমন কোনো আশা দেখা যাচ্ছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের মুদ্রানীতিতে বাণিজ্য ঘাটতি আরো বেড়ে যেতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে। নতুন মুদ্রানীতিতে বাণিজ্য ঘাটতি প্রাক্কলন করা হয়েছে ৩৬ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলার।

নতুন মুদ্রানীতিতে বলা হয়েছে, দেশে রপ্তানি আয়ের চেয়ে আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় ৩০ জুন শেষ হওয়া বিদায়ী ২০২১-২০২২ অর্থবছরে পণ্য বাণিজ্যে ঘাটতি ৩৩ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছতে পারে। ২০২১-২০২২ অর্থবছরের মুদ্রানীতিতে ২৬ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলার বাণিজ্য ঘাটতি হতে পারে বলে প্রাক্কলন করা হয়েছিল। ২০২১-২০২২ অর্থবছরে পণ্য রপ্তানি ৩২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে। অর্থাৎ বিদায়ী অর্থবছরে আগের বছরের চেয়ে ৩২ শতাংশ বেশি রপ্তানি আয় দেশে আসবে। অন্যদিকে আমদানি ব্যয় বাড়বে ৩৫ শতাংশ। প্রবাসীদের পাঠানো প্রবাস আয় বা রেমিট্যান্স কমবে ১৪ শতাংশ। সব মিলিয়ে বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াবে ১৭ দশমিক ৭৩ বিলিয়ন ডলার।

চলতি ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে পণ্য রপ্তানি প্রবৃদ্ধি কমে ১৩ শতাংশে নেমে আসবে। আমদানি ব্যয় বাড়বে ১২ শতাংশ। রেমিট্যান্স ঊর্ধ্বমুখী হবে এবং ১৫ শতাংশ বাড়বে। চলতি লেনদেনের ভারসাম্যে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াবে ১৬ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ডলার।

বিগত দুই বছরের মধ্যে প্রথমবার বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নকে (এসিইউ) আমদানির অর্থ পরিশোধের অনুমোদন দেওয়ার পর রিজার্ভ কমে যায়। বাংলাদেশ গত সপ্তাহে এসিইউর সঙ্গে ১ দশমিক ৯৯ বিলিয়ন ডলার মূল্যের আমদানি পেমেন্ট নিষ্পত্তি করেছে। এর ফলে বিগত প্রায় দুই বছরের মধ্যে প্রথমবারের মত গত মঙ্গলবার রিজার্ভ ৩৯ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। গত বছরের ডিসেম্বরে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৪৬ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here