তুরস্কের বায়রাক্তার ড্রোন প্রযুক্তি পাচার হচ্ছে ইসারাইলের কাছে!

0
257

খবর৭১ঃ গত সপ্তাহে তুরস্কের ড্রোন প্রযুক্তি পাচারের সঙ্গে জড়িত ১১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ পত্র দাখিল করা হয়েছে দেশটির একটি আদালতে।

অভিযুক্তদের মধ্যে তুরস্কের সামরিক শিল্পের সাবেক একজন প্রজেক্ট ম্যানেজার, নৌবাহিনীর তিনজন অফিসার এবং অস্ত্র ব্যবসায়ে জড়িত কয়েকজন ব্যক্তি আছেন।

প্রায় ৭-৮ মাস তদন্তের পরে এই অভিযোগ পত্র দাখিল করা হয়। প্রধান অভিযুক্ত ব্যক্তি হলেন তুরস্কের ডিফেন্স ইন্ডাস্ট্রিজের মানবহীন এবং ইন্টেলিজেন্স সিস্টেম ডিপার্টমেন্টের প্রজেক্ট ম্যানেজার ইউসুফ হাকান ওযবিলগিন। তিনি তুরস্কের বায়রাক্তার টিবি-২ ড্রোন এবং তুরস্কের আসেলসান, রকেটসান এবং হাভেলসানসহ আরও অনেক কোম্পানির গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বাইরে পাচার করেন। যা শেষ পর্যন্ত ইসরাইলের হাতে গিয়ে পড়েছে বলে ধারণা করা হয়।

আসলে গত দুই তিন দশক ধরে বিভিন্ন সময়ে তুরস্কের সামরিক খাতকে নিজেদের কব্জায় রাখার জন্য অনেক ধরণের ফন্দি করেছে ইসরাইল এবং আমেরিকা। কখনও তুরস্কের এই উচ্চাভিলাষী প্রজেক্টগুলোকে হুমকি ধামকি দিয়ে বাতিল করিয়েছে। কখনও এই প্রজেক্টে কাজ করা ইঞ্জিনিয়রদের হত্যা করেছে। কখনওবা প্রলোভন দেখিয়ে এই প্রকল্প থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করেছে তুরস্ককে । শেষ পর্যন্ত যখন তুরস্ক সামরিক প্রযুক্তিতে সফল হয়েছে এখন সেগুলো চুরি করার চেষ্টা করছে তারা।

এরকম অনেকগুলো ঘটনা ঘটেছে গত কয়েক দশকে।

যেমন গতবছর তুরস্কের গোয়েন্দা সংস্থা দেশটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক সংস্থা টার্কিশ ডিফেন্স ইন্ডাস্ট্রিজের মধ্যে একটা শক্তিশালী গুপ্তচর নেটওয়ার্কের সন্ধান পায়। তখন থকেই তাদেরকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখে।

এবছর জানুয়ারি মাসে গোয়েন্দা সংস্থা এবং পুলিশ এক যৌথ অভিযানে গ্রেফতার করে এই ডিফেন্স ইন্ডাস্ট্রিজের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে এবং সমরাস্ত্র ব্যবসার সঙ্গে জড়িত আরও কয়েকজনকে।

সেই কর্মকর্তা হলেন এই ডিফেন্স ইন্ডাস্ট্রিজের মানবহীন এবং ইন্টেলিজেন্স সিস্টেম ডিপার্টমেন্টের প্রজেক্ট ম্যানেজার। নাম তার ইউসুফ হাকান ওযবিলগিন। তুরস্কের সামরিক শিল্পের তৈরি সব ড্রোন এবং ইন্টেলিজেন্স সিস্টেম সম্পর্কিত সব প্রজেক্ট ছিল তার আন্ডারে। তার বাসায় সার্চ করলে পুলিশ একটা লাগেজের মধ্যে দেড় মিলিয়ন ডলার এবং ইউরোর নগদ টাকা পায়। এছাড়াও তার ব্যাংকের ভল্টে পায় আরও তিন মিলিয়ন ইউরো। ব্যাগের ওই টাকার বিষয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলে তিনি জানান যে তার এক বন্ধুকে গাড়িতে করে বাসায় পৌঁছে দিতে গেলে ওই বন্ধু ব্যাগটি তার গাড়িতে ভুলে ফেলে রেখে যায়। তারপর সেই বন্ধুকে ফোন করলে তিনি নাকি ওনাকে জানান যে এখন না পরে একসময় ব্যাগ নিয়ে যাবেন তার কাছ থেকে। সেভাবেই নাকি তার বাসায় থাকে এই ব্যাগ।

এত বিশাল টাকার ব্যাগ ফেলে রেখে যাওয়া এই বন্ধুটি কে? এই বন্ধুটি হচ্ছে তারই অনেকদিনের দোস্ত মেহমেত দুরমাযের ছেলে এমরে আল্প দুরমায। এই মেহমেত দুরমায হচ্ছেন ইসরাইলের কয়েকটি বিখ্যাত প্রতিরক্ষা শিল্পের তুর্কি এজেন্ট। তিনি গত ত্রিশ বছর ধরে ইরসাইল মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রি বা IMI এবং ইসরাইল এরোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ বা IAI এর তুরস্কের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করছেন।

এই মহেমেত দুরমাযের মাধ্যমেই ইসরাইলের IAI কোম্পানি তুরস্কের সামরিক বাহিনীর কাছে HERON ড্রোন বিক্রি করে। কিন্তু সে ড্রোনগুলোর কয়েকটি উড়তে গিয়ে বিধ্বস্ত হয়। আর কয়েকটি উড়ার আগেই অকেজো হয়। এই ঘটনা সেই ১৯৯৪-৯৫ সালের দিকের। এর পরে ২০০২ সালে ইসরাইলের IMI কোম্পানি বড় ধরণের অর্থনৈতিক সংকটে পরে। তখন তুরস্কের সেনাবাহিনী এই কোম্পানিটির সঙ্গে ১৭০ টি M60 ট্যাঙ্ক মডার্নাইজেশনের জন্য চুক্তি করে। সে চুক্তিতেও মধ্যস্ততা করেন এই মেহমেত দুরমায। কারণ তিনিই হলেন ওই কোম্পানির তুর্কি প্রতিনিধি। তখন প্রতিটি ট্যাঙ্কের আধুনিকায়নের জন্য ৪ মিলিয়ন ডলারে চুক্তি হয়। সে অনুযায়ী ১৭০ টি ট্যাঙ্কের আধুনিকায়নের জন্য মোট ৬৮৭.৫ মিলিয়ন ডলারের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

ওই সময়ে আরও অনেক কম খরচে নতুন তৈরি নিউ জেনারেশন ট্যাঙ্ক কেনা সম্ভব ছিল।কিন্তু তা না করে বরং ১৯৬০ সালের এই পুরাতন ট্যাঙ্কগুলো আধুনিকায়নের জন্য এতো বিশাল পরিমান টাকার চুক্তি করা হয় ইসরাইলের ওই মৃতপ্রায় কোম্পানিটির সঙ্গে। এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয় তখন।

যাইহোক, তুরস্কের ওই ট্যাঙ্ক আধুনিকায়ন চুক্তির মাধ্যমে তখন অর্থনৈতিক সংকট থেকে বেঁচে যায় ওই ইসরাইলী কোম্পানিটি।

এখন এই এমরে আল্প দুরমায এবং মেহমেত দুরমায অনেকগুলো সামরিক সরঞ্জাম প্রস্তুতকারক কোম্পানির সঙ্গে হয়তো শেয়ারে আছেন নয়তো প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করছেন। যে কোম্পানিগুলো অনেক বছর ধরে বাইরে থেকে তুরস্কের জন্য সামরিক সরঞ্জামের ব্যবস্থা করে আসছে।

তাদের এই কাজের মধ্যে আছে তুরস্কের সেনাবাহিনীর জন্য ইতালি, আমেরিকা এবং ইসরাইল থেকে বিভিন্ন ধরণের সফটওয়ার, যন্ত্রপাতি এবং সামরিক সরঞ্জাম ক্রয়ের মধ্যস্থতা করা।
এই এমরে আল্পের টাকা পাওয়া গেছে তুরস্কের ডিফেন্স ইন্ডাস্ট্রিজের সাবেক প্রজেক্ট ম্যানেজারের বাসায়। আদালতে পেশ করা অভিযোগ পত্রে বলা হয় এমরে আল্প এবং তারা বাবা মেহমেত দুরমাযের কাছে তুরস্কের সামরিক শিল্পের গুরুত্বপূর্ণ প্রজেক্ট পাচারের বিনিময়ে তিনি এই টাকা নেন তাদের কাছ থেকে।

ওই প্রজেক্ট ম্যানেজার বিদেশে ড্রোন প্রযুক্তি এবং সামরিক পরিকল্পনা বিক্রির অভিযোগে গ্রেফতার হন। এই প্রযুক্তির মধ্যে আছে তুরস্কের Bayraktar TB-2 ড্রোন প্রস্তুতকারক কম্পনী বায়কারের কিছু প্রকল্প, তুরস্কের Aselsan, Roketsan, এবং TUBİTAK-সাগের কিছু প্রকল্প। কোন দেশে বিক্রি করতে পারেন এই প্রযুক্তি? ইসরাইলের নাম আসবে সবার আগে।

তবে প্রশ্ন আসতে পারে, ইসরাইলের টেকনোলজি তো অনেক উন্নত। বিশ্বের প্রথম সারির ড্রোন প্রস্তুতকারক দেশ। সেই ১৯৯৪ সাল থেকে তারা ড্রোন উৎপাদন করছে। তাহলে কেন তুরস্কের ড্রোন প্রযুক্তি চুরি করতে চাইবে? এর দুটো উত্তর হতে পারে। একটা হচ্ছে তুরস্কের প্রযুক্তি আরও অনেক বেশি উন্নত যা তাদের হাতে নেই। আরেকটা হচ্ছে তারা আসলে ড্রোন প্রযুক্তিতে অতটা উন্নত না যেমনটা ধারণা করা হতো।

তাহলে আরেকটু পিছনে ফিরে যাই। ১৯৯৩ সাল। তুরস্কের তুখোড় রাজনীতিবিদ এবং দেশটির সবচেয়ে বড় ইঞ্জিনিয়র এবং বিজ্ঞানী নাজিমুদ্দিন এরবাকান একটা ঘরোয়া মিটিঙয়ে কথা বলছেন। তিনি তখনও প্রধানমন্ত্রী হয়তে পারেননি। কিন্তু তুরস্কের আগ্রগতির পুরো পরিকাল্পনা তার প্রস্তুত। কোন কোন সেক্টরে কিভাবে আগাতে হবে সে বিষয়ে পুরো রূপরেখা প্রণয়ন করছেন এবং সে অনুযায়ী কাজও করছেন। যাকে যেভাবে পারছেন ফ্যাক্টরি করার জন্য উদ্ভুদ্ধ করছেন। প্রজেক্ট দিচ্ছেন। রাস্তা ঘাঁট তৈরি করা থেকে শুরু করে, ট্যাঙ্ক, যুদ্ধ জাহাজ, গাড়ি এবং ড্রোন তৈরি প্রকল্পও বাদ যায়নি তার পরিকল্পনা থেকে। তিনি তখন এক ঘরোয়া মিটিঙে বলেন যে তুরস্কের প্রথম ড্রোন আসছে কিছুদিনের মধ্যেই। কারণ তিনি ড্রোন প্রকল্প তুরস্কের সামরিক ইন্ডাস্ট্রির কাছে হস্তান্তর করেছেন।

কিন্তু এই প্রজেক্ট আর আলোর মুখ দেখেনি। অথচ এর মাত্র এক দেড় বছর পরে তার প্রজেক্টের আদলেই ইসরাইল তৈরি করে তাদের বিখ্যাত হেরন ড্রোন। তাই ধারণা করা হয় এই প্রকল্পও তখন ইসরাইলকে দেয়া হয়েছে বা তারা চুরি করে নিয়েছে।
অবশ্য এও বলা হয় যে এরবাকান ড্রোন নিয়ে তার পুরো পরিকল্পনা তখন ওই সেনা কর্মকর্তাদের হাতে দেননি। তিনি আসল পরিকল্পনা দিয়ে যান সেলচুক বাইরাক্তারের বাবা ওযদেমির বায়রাক্তারের কাছে। সে বিষয়ে অন্য একদিন বলবো।
এর পরে ২০১৬ সালের এপ্রিল মাসের একটি ঘটনা। সেই কুখ্যাত সামরিক অভ্যুত্থানের কয়েকমাস আগের কথা। তুরস্কের মেকানিকাল এন্ড কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রির দেশটির সর্বপ্রথম ন্যাটো মানের রাইফেল তৈরির ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু সেই রাইফেল বাজারে আসার আগেই এই প্রযুক্তি আমেরিকার কাছে বিক্রিরই চেষ্টা কড়া হয়। ওই ইন্ডাস্ট্রির অধীনে কিরিককালে অস্ত্র কোম্পানির প্রধান মুস্তফা তানরিভেরদি তুরস্কের এই নিজস্ব রাইফেল প্রকল্প বিক্রির সময় হাতেনাতে ধরাপরে গোয়েন্দা সংস্থার কাছে।

তিনি আসলে তুরস্কের সেই বিখ্যাত রাইফেল MPT-৭৬ এবং MP6 অস্ত্রের নকশা এবং প্রজেক্ট বিক্রি করার পরিকল্পনা করেন অনেক আগেই। এই খবর যায় গোয়েন্দা সংস্থায়।প্রায় কয়েকমাস ধরে গোয়েন্দারা কড় নজরদারি করে তার উপর। ফোনে আড়ি পাতে। অফিস বাসা সহ প্রতিটা পদক্ষেপ এবং কথোপকথন ৭/২৪ নজরদারিতে রাখা হয়। গোয়েন্দারা একটা টোপ ফেলেন তার সামনে। তারা খদ্দের হিসেবে যোগাযোগ করেন তার সঙ্গে। এবং শেষ পর্যন্ত প্রজেক্ট হস্তান্তরের সময় হাতেনাতে ধরে ফেলেন তাকে। তখন আসলে তিনি আমেরিকার একটা কোম্পানির কাছে বিক্রি করতে চেয়েছিলেন এই নকশা।

এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে তুরস্কের সামরিক বাহিনীর বিভিন্ন ধরণের টেন্ডারের অনেক গোপন তথ্য পাচার হয় ইসরাইল এবং আমেরিকার কাছে। কোন কোন বিষয়ে টেন্ডার আসছে, কে কে ঢুকছে সেই টেন্ডারে, কাদের কাছ থেকে কেনার পরিকল্পনা করছে এগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পাচার করা হয় তাদের কাছে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে এ ধরণের চুরি বা পাচার বন্ধে তুরস্ক কি ধরণের পদক্ষেপ নিচ্ছে। তিন ধরণের প্রদক্ষেপ নেয়া সম্ভব। এক. গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো। দুই. শক্তিশালী প্রতিরক্ষা সফটওয়ার ব্যবহার। তিন. দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা। প্রথম টুইটা করছে তুরস্ক। কিন্তু এই ধরণের চুরিতে শাস্তির পরিমাণ খুবই কম। ৮-৩০ বছরের সাজার বিধান আছে মাত্র। এখন আলোচনা চলছে এই শাস্তির পরিমাণ বাড়ানো এবং আরও কার্যকরী করার। দেখা যাক কখন কিভাবে করে এগুলো।

তুরস্কের সামরিক শিল্প এখন দেশটির গর্বের বিষয়। এমনকি সারা মুসলিম বিশ্বের গর্বের বিষয়। এর পিছনে আছে প্রচুর লোকের দেশপ্রেম আর অক্লান্ত পরিশ্রম। ইঞ্জিনিয়র, সামরিক বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা, পুলিশ এবং রাজনীতিবিদ সহ অনেক সাধারণ তুর্কিরাও আছেন সেই তালিকায়। তবে প্রতিপক্ষরা, শত্রুরা এবং গুপ্তচররাও সব সময়, সব জায়গায় সক্রিয় আছে, থাকবে। এর মধ্যেই শক্ত পদে এগিয়ে যেতে হবে এই দেশটিকে।

এখান থেকে তুরস্কের দৃঢ়তার সঙ্গে এগিয়ে যাওয়া মানে মুসলিম বিশ্বের এগিয়ে যাওয়া আর তুরস্কের মুখ থুবড়ে পরে যাওয়া মানে মুসলিম বিশ্বের আরও কয়েক দশক পিছিয়ে যাওয়া।

আমরা আশা করবো সব বাধা বিপত্তি উপেক্ষা করে সামনে এগিয়ে যাবে তুরস্কের এই প্রযুক্তি খাত। শত্রুর জন্য ভীতি এবং বন্ধুর জন্য ভরসার স্থল হবে দেশটির সামরিক শিল্প। সেই প্রত্যাশায়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here