‘দুলা ভাই ক্যাপ্টেন ভূঁইয়া মুক্তিযুদ্ধে, তাই আমাদের বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়’

0
474

খবর৭১ঃ  অধ্যাপক ড. কামালউদ্দীন আহমদ বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ। জন্ম কুমিল্লার দাউদকান্দির খানেবাড়ি গ্রামে। বাবা দাউদকান্দির বিশিষ্ট সমাজসেবক, শিক্ষানুরাগী এবং আহমদ পাবলিশিং হাউজের প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত মহিউদ্দীন আহমদ। মা রহিমা খাতুন। এরআগে অধ্যাপক ড. কামালউদ্দীন আহমদ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করেন, সবশেষ বিভাগের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্বপালন করেন। পরে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর, গ্রন্থাগারিক (ভারপ্রাপ্ত) এবং আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন এই শিক্ষাবিদ।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় কামালউদ্দীন আহমদ ছিলেন ১২/১৩ বছরের কিশোর। ঢাকায় বাংলাবাজারে বাবার ব্যবসা ও জিন্দাবাহারের পৈত্রিক বাড়ি থাকলেও মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে জীবনের নিরাপত্তায় তিনি পরিবারের সঙ্গে গ্রামে অবস্থান করেন। ২৫ মার্চ রাতে দখলদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাঙালিদের ওপর নৃসংশ হামলা ও গণহত্যা চালায়। কামালউদ্দীনের সদ্য বিবাহিত বড় বোন মাহমুদা আক্তারের স্বামী তৎকালীন ক্যাপ্টেন সুবিদ আলী ভূঁইয়া (বর্তমানে কুমিল্লা-১ আসনের সংসদ সদস্য এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি) তখন সস্ত্রীক ছিলেন চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে নিযুক্ত। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অযৌক্তিক ও অতর্কিত বর্বর আক্রমণে সুবিদ আলী ভূঁইয়া বিদ্রোহ করে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।

বড় বোনের স্বামী ক্যাপ্টেন ভূঁইয়া বাংলাদেশকে শত্রুমুক্ত করার জন্য পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে লড়াই করছেন এই আক্রোশে একাত্তরের জুলাই মাসে কামালউদ্দীনদের গ্রামের বাড়িতে হামলা করে দাউদকান্দি থানা ও ডাক বাংলোতে অবস্থানরত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী।
একাত্তরের দুঃসহ স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ড. কামালউদ্দীন আহমদ লেখককে জানান, দুলা ভাই মুক্তিযুদ্ধে লড়াই করছেন। ততদিনে এই খবর সবার জানা হয়ে যায়। এ অঞ্চলের দখলে থাকা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের দোসর-রাজাকাররাও এ ব্যাপারে অবগত। তাই প্রতিটি দিন-রাত আমাদের আতংকে কেটেছে। এদিকে ক্যাপ্টেন ভূঁইয়ার স্ত্রী আমার বড় বোন মাহমুদা আক্তার তখন আমাদের গ্রামের বাড়িতেই ছিলেন। বাড়িতে আমার বিবাহের উপযুক্ত আরও ১ বোনসহ মোট ৫ বোন। আমরা শিশুকিশোর। তাই বাবা আমাদের নিরাপত্তা নিয়ে প্রতিনিয়ত শংকিত ছিলেন।

জুলাই মাসের দিকে এক রাতে আমরা দুই ভাই বাবার সঙ্গে কাচারিঘরে ঘুমাই। রাত ১টার দিকে দাউদকান্দি থেকে আমাদের এক চাচা এসে বাবাকে ঘুম থেকে ডেকে তোলেন। আমাদেরও ঘুম ভেঙ্গে যায়। চাচা হাঁপাচ্ছেন। বাবার চোখেমুখে চিন্তার ভাজ। চাচা দাউদকান্দি থানার একটি সোর্স থেকে জানতে পারেন যে, কিছুক্ষণ পরেই অথবা সকালে ক্যাপ্টেন শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে পাকিস্তানি সেনার একটি দল আমাদের বাড়ি আক্রমণ করবে (ক্যাপ্টের শহীদুল্লাহ যুদ্ধাপরাধের মামলায় বর্তমানে জেলে)। বাবা তখন গভীর রাতে তাৎক্ষণিকভাবে পরিবারের সবাইকে ডেকে তুলেন। হাতের কাছের দরকারি কিছু জিনিস নিয়েই আমরা দ্রুত বাড়ি ছাড়ি। গভীর রাতে বোনদের দিয়ে চলাফেরা সহজ ছিল না; আমার বড় বোন মাহমুদা আক্তার ছিলেন গর্ভবতী। সবার চোখেমুখে ভয়-উৎকণ্ঠা। আমরা ভাঙ্গা ও কর্দময় পথে হাঁটতে হাঁটতে চক্রতলা গ্রাম হয়ে মারুকার একটি বাড়িতে গিয়ে উঠি।’

মারুকা আশ্রয় নিয়েও নিরাপদবোধ করতে পারেননি কিশোর কামালউদ্দীনের পরিবার। কারণ লোকজন বলাবলি করে যে, মারুকাতেও পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এসে আক্রমণ করতে পারে। এরপর আবার নিরাপদ আশ্রয়ে বেরিয়ে পড়েন তারা। কামালউদ্দীন বলেন, ’তখন বর্ষাকাল ছিল। দিনের বেলায় সড়ক পথে আশ্রয়ে যাওয়া নিরাপদ ছিল না। তাছাড়া বড় বোনের পেটে সন্তান। তাই দুটি নৌকার ব্যবস্থা করা হয়। আমরা মারুকা থেকে চান্দিনা থানার দক্ষিণাঞ্চলে আমার বড় বোনের স্বামীর বাড়ির দিকে যাই।’

চান্দিনা থানায়ও তো পাকিস্তানি আর্মির ঘাঁটি ছিল। সে এলাকায় নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে অধ্যাপক কামালউদ্দীন বলেন, বড় দুলা ভাইয়ের বাড়ি ছিল চান্দিনার কৈলান গ্রামে। এটি চান্দিনা এবং চাঁদপুরের কুচুয়া সীমান্তে অবস্থিত। একেবারে ভেতরের দিকে। সেখানে তখন পর্যন্ত পাকিস্তানি আর্মির তৎপরতা ও হামলার খবর পাওয়া যায়নি। আবার বর্ষাকাল হওয়ার ওই জায়গাটি নিরাপদ ভেবে বাবা সেখানে যাওয়ার সিদ্বান্ত নেন। সেদিন আমার কৈলান গ্রামের পৌঁছাতে সন্ধ্যা হয়ে যায়।

ঐদিন সকালেই কী বাড়িতে আক্রমণ করা হয়েছিল? জবাবে কামালউদ্দীন জানান,
‘না’। লোক মারফত জানতে পারি, সকালে পাকিস্তানি আর্মি আমাদের বাড়িতে আসেনি। হামলা করা হয় তার পরের দিন। এসেই পুরো বাড়িতে গানপাউডার ছিটিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। আমাদের বাড়ির সব ঘর পুড়ে ছাঁই হয়ে যায়। শুধু চাচার একটি ঘর কিছুটা রক্ষা পায়। কারণ, ঘরটিতে টিনের বেড়া ছিল। টিনের ঘরে সাধারণ আগুনে ধরতে সময় লাগে। বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়ার খবর শুনে আমরা দুই ভাই পরদিন দেখতে যাই। এসে দেখি তখনো কোথাও কোথাও ধোঁয়া উড়ছে। পোড়া গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে আছে। বাড়িটি যেন শ্মশানে পরিণত। আমরা তো ছোট, এই দৃশ্য দেখে আবেগ ধরে রাখতে পারিনি। হাউমাউ করে কেঁদেছি।
নিরাপদবোধ না করায় আমরা দুই ভাই আবার ফেরৎ যাই চান্দিনার কৈলান গ্রামে। সেখানে কয়েকদিন থাকার পর শুনি এখানেও পাকিস্তানি আর্মি আসতে পারে। বাবা তখন বিচলিত হয়ে পড়েন। এদিকে ভারতের আগরতলা থেকে সোর্সের মাধ্যমে দুলা ভাই বীর মুক্তিযোদ্ধা সুবিদ আলী ভূঁইয়া খবর পান যে, আমাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। দুলা ভাই তখন আমার বড় বোন মাহমুদা আক্তারের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন। তাঁর গর্ভে তখন ৭ মাসের সন্তান। দুলা ভাই আগরতলা থেকে তাঁর বিশ্বস্ত একজনকে পাঠান আমার বোনকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। বাবা বোনকে দিতে রাজি ছিলেন না। তারপরও বোন বড় ঝুঁকি নিয়ে কৈলান গ্রাম থেকে প্রথমে নৌকায় করে, পরে রিকশা ও হেঁটে আগরতলার উদ্দেশে বের হন। সঙ্গে তাঁর দেবরকেও নিয়ে যান। একদিকে মুক্তিযোদ্ধার যুবতী স্ত্রী হওয়ায় বাংলাদেশে থাকা নিরাপত্তার ঝুঁকি, অপরদিকে ক্যাপ্টেন ভূঁইয়ার দুঃশ্চিন্তা কমানো, যাতে তিনি মুক্তিযুদ্ধে মনোযোগী থাকতে পারেন। এ কারণে আমার বোন আগরতলা যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
আমার বোন যাওয়ার পর আমরা নৌকায় করে চাঁদপুরে এক আত্মীয়র বাড়ির উদ্দেশে বের হই। পথে পথে কত দুঃশ্চিন্তা। এক অনিশ্চিত জীবনের দিকে যাযাবরের মত ছুটে চলেছি আমরা। চাঁদপুরের কাছাকাছি গিয়ে নদীতে থাকতেই শুনি, সামনে পাকিস্তানি আর্মির অবস্থান। মাঝিরা জানায়, আর সামনে আগালে বিপদ। বাবা তখন মানসিকভাবে খুবই ভেঙ্গে পড়েন। উনার চোখমুখ অন্ধকার হয়ে আসে। নৌকাতেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। নৌকায় ডাক্তার পাবো কোথায়? নদীর পানি মাথায় দিয়ে দিয়ে বাবাকে সেবা করি। ছোটভাইবোনেরাও কান্না শুরু করে।

পরে অন্যত্র আমাদের এক আত্মীয়র বাড়িতে গিয়ে উঠি। সেখান কিছু দিন থেকে স্টিমারে করে আবার ঢাকায় আসি। ঢাকায় আসার পথে নৌঘাটে পাকিস্তানি আর্মির চেকপোস্টের মুখোমুখি হই। ভাগ্য ভালো যে, আমাদেরকে তল্লাশি করে ছেড়ে দেয়। এরপর জিন্দাবাহারের বাড়িতে উঠি। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণ ও বিজয়ের আগপর্যন্ত এখানেই ছিলাম।’

একাত্তরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণ থেকে প্রাণ বাঁচাতে এবং নারীদের সম্ভ্রম রক্ষায় লাখ লাখ মানুষ নিজের বাড়িঘর ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে ছুটেছে। অনেকে ভারতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছে। কত মানুষ পথেও মারা গেছে। যুদ্ধে নিরীহ মানুষকে নিজ বাড়িঘর ছেড়ে পালাতে বাধ্য করা একধরণের নির্যাতন। পাকিস্তানি আর্মির হত্যা, গণহত্যা, নারী ধর্ষণের পাশাপাশি, বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে বাঙালিদেরকে অনিশ্চিত জীবনের দিকে ঠেলে দেওয়ার নির্যাতনের শিকার হয়েছেন অসংখ্য মানুষ। মুক্তিযুদ্ধে এই নির্যাতনের শিকার হয়েছেন অধ্যাপক কামালউদ্দীনের পরিবার ।
পাকিস্তান আর্মি বাড়ি আক্রমণের কারণ সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে অধ্যাপক কামালউদ্দীন বলেন, কারণ একটাই। আমার বড় বোনের স্বামী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর চাকরিকে লাথি মেরে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। ২৬ মার্চ ১৯৭১, চট্টগ্রামের উপকণ্ঠে কুমিরায় তীব্র প্রতিরোধ যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন তিনি। যুদ্ধে পাকিস্তানি আর্মির কমান্ডিং অফিসারসহ তাদের অনেক সেনা নিহত হয়। এরপর ৩ নম্বর সেক্টরে বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করতে থাকেন। যেহেতু দুলাই পরিচিত ও আলোচিত মুক্তিযোদ্ধা, তাই আমাদের বাড়িতেও মুক্তিবাহিনীর আনাগোনা ও গোপন ঘাঁটি থাকতে পারে। একারণে বাড়িতে আক্রমণ করা হয়। আক্রমণে নেতৃত্বে দেয় ক্যাপ্টেন শহীদল্লাহ। সে এখন জেলে। আমি এই যুদ্ধাপরাধীর উপযুক্ত শাস্তি চাই।’

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন : বাশার খান
সাংবাদিক এবং মুক্তিযুদ্ধ গবেষক।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here