মিরসরাই হানাদার মুক্ত দিবস ৮ ডিসেম্বর

0
374

রেদোয়ান হোসেন জনি, মিরসরাইঃ
চলছে বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। ১৯৭১ সালের এই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে মিরসরাই উপজেলা পাক হানাদার মুক্ত হয়। ৭মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ শোনার পর থেকেই উপজেলার সর্বস্তরের জনতা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠন শুরু করে। মিরসরাইয়ে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয় ২৫ মার্চ রাত থেকেই। চট্টগ্রামের দিকে পাক হানাদারদের আগমন প্রতিরোধ করতে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ওই রাতে উড়িয়ে দেওয়া হয় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের শুভপুর ব্রিজ। তারপর মিরসরাই উপজেলা সদরের অছি মিয়ার পুল উড়িয়ে দিলে ১৩ দিন আটকে থাকে হানাদার দল। এ সময়ের মধ্যে চট্টগ্রামের মুক্তিবাহিনী রণপ্রস্তুতি নেয়। ৮ ডিসেম্বর ভোর থেকে মুক্তিযোদ্ধারা মিরসরাই উপজেলা সদরের দিকে এগোতে থাকেন। মিরসরাই রেলওয়ে ষ্টেশন রোড়ের ওয়ার্লেস এলাকা থেকে পাকবাহিনীর জিপ আসার খবরে প্রস্তুত হয় বীরের দল। দীর্ঘক্ষণ চলে গুলিবিনিময়। একপর্যায়ে থেমে যায় পাকবাহিনী। মুক্তিযোদ্ধারা নিশ্চিত হন, ওই মুহূর্ত থেকে তারা মুক্ত। বিকাল নাগাদ এলাকা মুখরিত হয়ে যায় জয়ধ্বনিতে।

তখনো চট্টগ্রামের কোন উপজেলা মুক্তির স্বাদ পায়নি। প্রথম উপজেলা হিসেবে মিরসরাই হানাদার মুক্ত হয় একাত্তরের এই দিনে। মিরসরাই পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের নীলাকাশে পত্পত্ করে ওড়ে লাল সবুজের বিজয় নিশান। বিজয়ানন্দে উদ্বেল জনতা সেদিন মুক্তির গান গেয়ে ওঠে সমস্বরে।

তৎকালীন মিরসরাই বিএলএফের ডেপুটি কমান্ডার ও মিরসরাই সদর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মরহুম জাফর উদ্দিন আহাম্মদ চৌধুরী জীবদ্দশায় সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, ৮ ডিসেম্বর সকাল বেলা তিনি সুফিয়া রোড এসে দেখতে পান ওয়ার্লেস স্টেশন থেকে একটি পাক বাহিনীর জিপ তীব্র গতিতে বেরিয়ে যাচ্ছে এবং কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই প্রচন্ড শব্দে কাঁপিয়ে ওয়ার্লেস স্টেশনটি ধ্বংস হয়ে যায়। শত্রুর অবস্থান নিশ্চিত হয়ে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে সকল মুক্তিযোদ্ধার কাছে খবর পাঠানো হয় যোদ্ধারা যেন সুসংগঠিত হয়ে মিরসরাই থানা সদরের দিকে অগ্রসর হন। বেলা প্রায় ১০ টার সময় মুক্তিযোদ্ধা জাফর উদ্দিন আহম্মদের বিএলএফ গ্রুপের মুক্তিযোদ্ধাসহ প্রায় দু’শ মুক্তিযোদ্ধা মিরসরাই সদরের পূর্ব দিক ছাড়া বাকী তিন দিক ঘিরে ফেলে। বেলা প্রায় ১১ টার দিকে মুক্তিযোদ্ধারা তিন দিক থেকে সংগঠিত হয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে একযোগে আক্রমন শুরু করে। শুরু হয় পাক সেনা ও মুক্তিযোদ্ধাদের গুলি বিনিময়। পাক সেনাদের অবস্থান ছিল মিরসরাই হাই স্কুল, মিরসরাই থানা, মিরসরাই সি.ও. অফিস। বৃষ্টির মতো গুলি বিনিময়ের একপর্যায়ে মনে হলো পাক সেনাদের পক্ষ থেকে কোন প্রতিরোধ আসছেনা। মুক্তিযোদ্ধারা সতর্কভাবে শত্রুর অবস্থানের দিকে গিয়ে দেখলেন পাক সেনারা পলিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধারা থানায় প্রবেশ করে পাক সেনাদের আটটি রাইফেল উদ্ধার করে। পাক সেনারা চট্টগ্রামের দিকে পালিয়ে গেছে বলে পরে জানা যায়। চট্টগ্রামের কোন অঞ্চল তখনো মুক্তির স্বাদ পায়নি। মিরসরাই শত্রু মুক্ত হয়েছে-এ কথা বাতাসে দ্রুত ছড়িয়ে যায় মিরসরাইয়ের সর্বত্র। মুহুর্তেই চতুর্দিক থেকে জয় বাংলা স্লোগানে মুখরিত মিছিল আসতে থাকে। হাজারো জনতার ঢল নামে মিরসরাই হাই স্কুল মাঠে। মৌলভী শেখ আহম্মদ কবির কোরআন তেলাওয়াত করেন। পরে জাতীয় সঙ্গীতের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধা জাফর উদ্দিন আহাম্মদ চৌধুরীসহ সবাই জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। ঘোষণা করা হয় আজ ৮ ডিসেম্বর ১৯৭১ সাল মিরসরাই ভূখন্ড পাক বাহিনী মুক্ত একটি স্বাধীন এলাকা। সে থেকে ৮ ডিসেম্বর মিরসরাইয়ে উদ্যাপিত হয়ে আসছে স্বাধীনতার শত্রু মুক্ত দিবস।

প্রসঙ্গত, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের সব উপজেলার মধ্যে একমাত্র মিরসরাই উপজেলা থেকে বেশি মুক্তিযোদ্ধা অংশগ্রহন করে। উপজেলার ১০ নম্বর মিঠানালা ইউনিয়নের মলিয়াইশ উচ্চ বিদ্যালয়ের ৬০ শিক্ষার্থী মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। যাঁদের বয়স ছিল ১৪ থেকে ১৬ বছর। জোরারগঞ্জের দুই কৃতি বোন মধুমিতা বৈদ্য, আলো রানী বৈদ্যও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। এদের মধ্যে মধুমিতা বৈদ্য ২০১০ সালে কালের কণ্ঠ পদত্ত সম্মাননা একাত্তরের বিজয়িনী লাভ করেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here