চীনা ভ্যাকসিনের ট্রায়াল হবে বাংলাদেশে

0
359
চীনা ভ্যাকসিনের ট্রায়াল হবে বাংলাদেশে

খবর৭১ঃ চীনের তৈরি করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিনের তৃতীয় ধাপের ট্রায়াল হবে বাংলাদেশে। সিনোভ্যাক বায়োটেক লিমিটেডের তৈরি ওই ভ্যাকসিনের পরীক্ষামূলক প্রয়োগ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক এই তথ্য জানিয়ে বলেন, এই ভ্যাকসিন বাংলাদেশে পরীক্ষামূলক প্রয়োগের কাজটি করবে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র আইসিডিডিআরবি। তাদের তত্ত্বাবধানে কাজ করবে সিনোভ্যাক।

গতকাল রাতে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক ইত্তেফাককে বলেন, আশা করি ভ্যাকসিন বাংলাদেশই প্রথম পাবে। তিনি বলেন, ট্রায়াল দেওয়ার অনুমতি দেওয়ায় চীনের রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। তবে আগে হলে ভাল হতো। অনুমতি দিতে দেরি হওয়ার কারণ তুলে ধরে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, প্রথম দিকে ট্রায়াল দেওয়ার জন্য সিদ্ধান্ত ছিল। তবে করোনার মধ্যে বন্যা হয়েছে। এছাড়া সব বিশেষজ্ঞ কমিটির মতামত নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে কিছুটা বিলম্ব হয়েছে।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী আরো বলেন, অক্সফোর্ডের সঙ্গে আমরা যোগাযোগ রেখেছি। ভারতের সঙ্গে সেই ধরনের কথাবার্তা হয়েছে। তিনি বলেন, করোনার ভ্যাকসিন সারাদেশের মানুষ কিভাবে পাবে, সেই প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। যারা ভ্যাকসিন পুশ করবে তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে। এর মধ্যে ভারত তিনটি প্রতিষেধক নিয়ে কাজ করছে। দুটি তাদের নিজেদের তৈরি এবং আরেকটি ব্রিটেনের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় এবং অ্যাস্ট্রাজেনেকার যৌথ উদ্যোগে তৈরি। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় এবং অ্যাস্ট্রাজেনেকার যৌথ উদ্যোগে তৈরি ভ্যাকসিনের পেটেন্ট নিয়ে ভারতের সেরাম ইন্সটিটিউট ভ্যাকসিন উত্পাদন করছে এবং এই ভ্যাকসিনটি তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়ালে রয়েছে।

করোনা মোকাবিলায় গঠিত জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির সদস্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, চীনা ভ্যাকসিন ট্রায়ালের অনুমতি দেওয়ার মাধ্যমে সরকার আরেকটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটা খুবই দরকার ছিল।

তিনি বলেন, এই ট্রায়ালে ৪২০০ জন স্বেচ্ছাসেবক অংশগ্রহণ করবেন। ২১০০ জনকে নরমাল স্যালাইন দেওয়া হবে। আর ২১০০ জনকে ভ্যাকসিন দেওয়া হবে। যিনি পুশ করবেন তিনিও জানবেন না কাকে নরমাল স্যালাইন দেওয়া হচ্ছে, আর কাকে ভ্যাকসিন দেওয়া হচ্ছে। শুধুমাত্র একজন জানবেন। পরীক্ষার রেজাল্ট পাওয়ার পর বিষয়টি জানা যাবে।

তিনি বলেন, ট্রায়ালের অনুমতি দেওয়ার আগে জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটি, ওষুধ প্রশাসন, বাংলাদেশ মেডিক্যাল এন্ড রিসার্স কাউন্সিলসহ সবার মতামত ও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, এদেশে ট্রায়াল করলে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ফর্মুলা পাওয়া যাবে। সব কোম্পানি তৈরি করতে পারবে।

জনস্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান (আইপিএইচ) ভ্যাকসিন বিভাগের প্রধান ডা জিয়াউদ্দিন বলেন, দেশে ১৯৪৮ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত জনস্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান কুকুরের ভ্যাকসিন তৈরি করে এসেছে। এর আবিষ্কারক ফ্রান্সের লুই পাস্তুর। এখন এদেশের বিভিন্ন কোম্পানি কুকুরের ভ্যাকসিন সরবরাহ করছে। এ কারণে ২০১১ সাল থেকে জনস্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান এই ভ্যাকসিন তৈরি বন্ধ রেখেছে। তিনি বলেন, করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন তৃতীয় ধাপে অর্থাৎ প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে বাংলাদেশে ট্রায়াল হচ্ছে। এতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এদেশে তৈরি সুযোগ সৃষ্টি হবে। করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন ট্রায়াল দেওয়ার এই সিদ্ধান্ত যুগান্তকারী। সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

ঢাকা শিশু হাসপাতালের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের প্রধান ও অণুজীববিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. সমীর সাহা বলেন, করোনা ভাইরাসের ট্রায়াল দেওয়ার সিদ্ধান্ত খুবই ভাল উদ্যোগ। তবে একাধিক কোম্পানিকে এই সুবিধা দিলে ভাল হয়। ব্রাজিলে রাশিয়ার ভ্যাকসিন ট্রায়াল হয়েছে। আবার অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিনও ট্রায়াল হয়েছে। এদেশে আরো কোম্পানির ট্রায়ালের সুযোগ দিলে আমরা বেশি পাব। নিপসনের সাবেক পরিচালক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. আব্দুর রহমান বলেন, ট্রায়াল দেওয়ার এই সিদ্ধান্তের কারণে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ভ্যাকসিন তৈরির সুযোগ সুবিধা পাব।

ব্রিফিংয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী আরো বলেন, চীনের সঙ্গে আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হয়েছিল, তাদের সিনোভ্যাক কোম্পানি বাংলাদেশকে ভ্যাকসিন দেবে। বাংলাদেশে তারা কিছু পরীক্ষাও করতে চায়, ট্রায়াল করতে চায়। সে বিষয়ে আমরা বিভিন্নভাবে বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা করেছি। ভ্যাকসিনের সব বিষয়ে আমরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অবহিত করেছি।

ভারত, চীন, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের টিকার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করা হয়েছে জানিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রী চিন্তা-ভাবনা করে আমাদের একটা নির্দেশনা দিয়েছেন। সিদ্ধান্ত হয়েছে, আমরা যেহেতু চাই দেশে ভ্যাকসিন আসুক, তাহলে তার তো ট্রায়াল লাগবেই। সেই ট্রায়ালটা কাদের উপরে করব? প্রপোজাল হল ডাক্তার, নার্স এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবাকর্মীদের ওপর আগে (ট্রায়াল) করা হবে। আমরা নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে ট্রায়াল করতে দেব। যারা স্বেচ্ছায় আসবে, তাদের ওপরই শুধু ট্রায়াল হবে। ঢাকায় চীনের রাষ্ট্রদূত এবং সিনোভ্যাক কোম্পানিকেও আমরা এ কথা জানিয়ে দিয়েছি।

কোনো টিকার চূড়ান্ত অনুমোদনের আগে তৃতীয় ধাপের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে বিপুল সংখ্যক মানুষের শরীরে প্রয়োগ করে তার ফলাফল দেখতে হয়। পরীক্ষায় নিরাপদ ও কার্যকর প্রমাণিত হলেই সেই টিকা অনুমোদন পায়। চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের করোনা ভাইরাসের টিকা এখন তৃতীয় ধাপের পরীক্ষার পর্যায়ে রয়েছে। এর মধ্যে চীনের সিনোভ্যাক বায়োটেক লিমিটেড তাদের তৈরি করা টিকার তৃতীয় ধাপের পরীক্ষা বাংলাদেশেও করার পরিকল্পনা করে।

গত ১৮ জুলাই এই টিকা বাংলাদেশে পরীক্ষামূলক প্রয়োগের অনুমোদনও দেয় বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল, বিএমআরসি। ঘোষণা অনুযায়ী, এই টিকার বাংলাদেশে পরীক্ষামূলক প্রয়োগের কাজটি করবে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র আইসিডিডিআর,বি। আগামী ১৮ মাস ধরে দেশের স্বাস্থ্যকর্মীদের ওপর এই টিকার পরীক্ষামূলক প্রয়োগের কথা রয়েছে। ভ্যাকসিন ট্রায়ালের অনুমোদন প্রদান প্রসঙ্গে স্বাস্থ্যমন্ত্রী আরো বলেন, ‘চীনের এই কোম্পানিটি গত কয়েক মাস থেকেই আইসিডিডিআরবি এর মাধ্যমে ট্রায়ালের ব্যাপারে আমাদেরকে অনুরোধ করে আসছিল। সরকার তাদের ভ্যাকসিনের ব্যাপারে সব ধরণের যাচাই-বাছাই করেছে। কোম্পানিটি ইতিমধ্যে ইন্দোনেশিয়ায় ট্রায়াল শুরু করেছে। তুরস্কসহ বেশ কিছু দেশে ট্রায়াল শুরুর পর্যায়ে রয়েছে বলে জানিয়েছে। বাংলাদেশকে তারা (চায়না কোম্পানি) পছন্দের শীর্ষে রেখেছে শুরু থেকেই।

বাংলাদেশ এই ট্রায়ালে অংশ নিলে এক লাখ পিস টিকা সামগ্রী ফ্রি লাভ করার পাশাপাশি আরো প্রয়োজনীয় সংখ্যক ভ্যাকসিন ক্রয় করতে অগ্রাধিকার পাবে বলে সরকার মনে করছে। তাছাড়া চীন সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক অনেক দৃঢ়। সবকিছু বিবেচনা করেই চীনা ভ্যাকসিন কোম্পানিটিকে ট্রায়ালে অংশ নেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। যত দ্রুত ভ্যাকসিন ট্রায়াল সম্পন্ন হবে, ততো দ্রুত দেশ ভ্যাকসিন টিকা প্রাপ্ত হবে।

এদিকে ভারতে তৈরি সম্ভাব্য টিকার পরীক্ষামূলক প্রয়োগের জন্যও বাংলাদেশ প্রস্তুত বলে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন এর আগে জানিয়েছেন। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও অ্যাস্ট্রাজেনেকার তৈরি করা টিকার পরীক্ষা ও উত্পাদনের সঙ্গে জড়িত হয়েছে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটি অফ ইন্ডিয়া (এসআইই)। দ্বিতীয় ধাপ থেকেই কোভিশিল্ড নামের ওই টিকার পরীক্ষামূলক প্রয়োগ করে যাচ্ছে দেশটির সবচেয়ে বড় ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারী এই সংস্থা। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ‘চীনের কাছ থেকে আমরা জানতে পেরেছি, বাংলাদেশে তাদের যে কর্মীরা রয়েছে এবং দূতাবাসের লোকজন রয়েছে, তাদের ওপরও এ কোম্পানি ট্রায়াল করবে।

আজ এ বিষয়ে ডিটেইল আলোচনা হয়েছে। অফিসিয়ালি জানিয়ে দিয়েছি আপনারা ট্রায়ালের ব্যবস্থা করুন আমাদের মন্ত্রণালয় এবং আইসিডিডিআরবি সহযোগিতা করবে। চীনের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে আলোচনায় এ সিদ্ধান্ত জানানো হয়েছে।’ বাংলাদেশে সিনোভ্যাকের ওই টিকার পরীক্ষামূলক প্রয়োগের সব খরচ চীন বহন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বলে জানান স্বাস্থ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রদূত চীনের সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে যত দ্রুত সম্ভব তা শুরু করবেন বলে জানিয়েছেন। আমরা বলেছি আমাদের দেশে ট্রায়াল করার সুযোগ দেব, তবে আমরা যেন অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ভ্যাকসিনটা পাই, সে কথাটার উপর জোর দিয়েছি।’ স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ভ্যাকসিন ট্রায়ালে ভারতসহ অন্যকোনো দেশ আগ্রহ দেখালে সরকার তার কার্যকারিতা যাচাই করে অনুমোদন দেওয়ার ক্ষেত্রে আন্তরিক থাকবে।

গতকাল স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের সভাপতিত্বে সভায় আরো উপস্থিত ছিলেন স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব মো. আবদুল মান্নান, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম, ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. মাহবুবুর রহমান, আইডিসিআর,বি এর পরিচালক, ইপিআই-এর প্রোগ্রাম ম্যানেজার, আইসিডিডিআর,বি এর সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. ফিরদৌসি কাদেরী, ড. খালিকুজ্জামান, ড. তাজুল ইসলাম বারী প্রমুখ। সভায় অনলাইন ‘জুম’ এর মাধ্যমে অংশ নেন বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত লি কিমিং।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here