করোনা চিকিৎসায় ঝুঁকি বাড়ছে: পরীক্ষা ছাড়াই চলছে প্লাজমা থেরাপি

0
347
করোনা চিকিৎসায় ঝুঁকি বাড়ছে: পরীক্ষা ছাড়াই চলছে প্লাজমা থেরাপি

খবর৭১ঃ নিয়ম না মেনেই কোভিড-১৯ আক্রান্ত অনেক রোগীর চিকিৎসায় প্লাজমা থেরাপি প্রয়োগ হচ্ছে। এটা দেয়ার আগে পরীক্ষাও করা হচ্ছে না। প্লাজমা নিউট্রালাইজ অ্যান্টিবডি না করেই রোগীর শরীরের প্রয়োগ করা হচ্ছে।

এগুলো রোগীর ঝুঁকি বাড়াচ্ছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, দেশে গড়ে ১৪ শতাংশ মানুষের শরীরে ভাইরাল ইনফেকশন থাকে। কাজেই প্লাজমা দেয়ার আগে পরীক্ষার মাধ্যমে বিষয়গুলো নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন। অন্যথায় রোগীর বড় ধরনের বিপদ হতে পারে বলে তারা শঙ্কা প্রকাশ করেন।

জানা গেছে, সম্প্রতি স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার তত্ত্বাবধানে দেশব্যাপী ভাইরাল হেপাটাইটিসের ওপর একটি জরিপ পরিচালিত হয়। সেখানে দেখা গেছে দেশে প্রতি একশ’ জনের মধ্যে গড়ে ১৩ থেকে ১৪ জনের শরীরে হেপাটাইটিস এ, বি বা সি ভাইরাসের অস্তিত্ব রয়েছে। র‌্যাপিড টেস্টে এগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ধরা পড়ে না। তবে মলিকিউলার টেস্টে ধরা পড়ে। এ ধরনের তথ্য থাকার পরও করোনা আক্রান্ত মুমূর্ষু রোগীদের শরীরে প্লাজমা প্রয়োগের ক্ষেত্রে মলিকিউলার পরীক্ষা করা হচ্ছে না।

সূত্র জানায়, দেশে প্লাজমা নিউট্রালাইজ অ্যান্টিবডি পরীক্ষা করার কোনো মেশিন নেই। ফলে ক্ষেত্র বিশেষ র‌্যাপিড টেস্টে অ্যান্টিবডি পরীক্ষা করে সুস্থ রোগীর কাছ থেকে প্লাজমা নেয়া হয়। কিন্তু ওই প্লাজমা নিরোগ কিনা, সেখানে অ্যান্টিবডির পরিমাণ কতটা, যাকে দেয়া হবে তার কতটুকু প্রয়োজন এসব কিছুই দেখা হয় না। যা একদিকে ঝুঁকিপূর্ণ অন্যদিকে অবৈজ্ঞানিক।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা মেডিকেল কলেজের হেমাটোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. এমএ খান যুগান্তরকে বলেন, প্লাজমা দেয়ার ক্ষেত্রে একটি গাইডলাইন করা দরকার ছিল। সেটি করা হয়নি। ফলে সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছ। সাধারণত আক্রান্ত রোগীদের প্রথমে এটি দিলে কাজ ভালো পাওয়া যায়। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় মুমূর্ষু রোগীদের এটি দেয়া হয়, ফলে কাজ হচ্ছে না বা উপকার পাওয়া যায় না। তিনি বলেন, প্লাজমা দেয়ার ক্ষেত্রে ভাইরাল ইনফেকশন পরীক্ষা করা হয়। কিন্তু রক্তে প্লাজমার পরিমাণ দেখা হয় না, সেই সুযোগ সীমিত। রক্তে যদি ১:১.৬০ না হয় তাহলে সেই প্লাজমা দিয়ে সুফল পাওয়া যাবে না।

বিশেষজ্ঞদের মতে, প্লাজমা থেরাপির জন্য রক্তদাতা নির্বাচনের আগে কিছু বিষয় নিশ্চিত করতে হবে। যেমন, রক্তদাতার করোনাভাইরাস সংক্রমণ হয়েছিল তা আরটি-পিসিআরের মাধ্যমে কনফার্ম করা হয়েছে কিনা। কমপক্ষে ১৪ দিন আগে রক্তদাতার রোগ সম্পূর্ণ নিরাময় হয়েছে কিনা। রক্ত দেয়ার সময় রক্তদাতা সম্পূর্ণ সুস্থ অবস্থায় আছে কিনা; এ সময় সময় আরটি-পিসিআরের মাধ্যমে রক্তদাতার শ্বাসতন্ত্রীয় নমুনা বা রক্ত পরীক্ষা করে নিশ্চিত করতে হবে যে ফলাফল নেগেটিভ কিনা। এছাড়া রক্তদাতার রক্তে এলাইজা টেস্টের মাধ্যমে করোনাভাইরাসের অ্যান্টিবডি পরীক্ষা করে দেখতে হবে।

এছাড়াও ব্লাড ডোনারের স্ক্রিনিং করে নিশ্চিত হতে হবে রোগীর শরীরে এইচআইভি বা হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাসের উপস্থিতি নেই। এগুলো ঠিক থাকলে রক্তদাতার কাছ থেকে মেশিনের মাধ্যমে ৪০০ থেকে ৬০০ মিলি প্লাজমা সরাসরি সংগ্রহ করা যায়। অথবা সমপরিমাণ রক্ত সংগ্রহ করে ল্যাবরেটরিতে খুব সহজেই রক্ত থেকে প্লাজমা সংগ্রহ করা যায়। করোনাভাইরাস থেকে আরোগ্য লাভ করা একজন সুস্থ ব্যক্তির রক্ত সংগ্রহ করে, তার থেকে রক্তকণিকাগুলোকে আলাদা করে, যে প্লাজমা বা রক্তরস পাওয়া যায় তা আরেকজন করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীর দেহে প্রয়োগ করা হয়।

এর মাধ্যমে করোনা থেকে সুস্থ হওয়া ব্যক্তির শরীরে তৈরি হওয়া সুনিদিষ্ট অ্যান্টিবডি অন্য ব্যক্তির শরীরে সংক্রমিত ভাইরাসকে নিয়ন্ত্রণ করবে। তবে রক্তদাতার শরীরে ঘাপটি মেরে থাকা কোনো জানা বা অজানা রোগ যেন রোগীর শরীরে প্রবেশ না করে। আর রক্তদাতার রক্তে অ্যান্টিবডির মাত্রা মাপাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ যথেষ্ট পরিমাণে অ্যান্টিবডি না থাকলে এ চিকিৎসার কার্যকারিতা সম্পূর্ণ ব্যাহত হবে। এসবের জন্যই মূলত থেরাপি দেয়ার আগে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো পরীক্ষা করে নেয়া জরুরি। কিন্তু দেশে এ ধরনের তেমন কোনো পরীক্ষাই হচ্ছে না। অথচ দেয়া হচ্ছে প্লাজমা থেরাপি।

এসব নিয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মনেও কিছু প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে আছে- ১. প্লাজমা থেরাপি গবেষণা বা ট্রায়াল থেকে চিকিৎসা পদ্ধতিতে রূপান্তরের অনুমতি কে দিয়েছে ২. পৃথিবীর কোথাও এটি ড্রাগ বা স্বীকৃত চিকিৎসা পদ্ধতি হিসেবে অনুমোদিত কিনা ৩. নিউট্রালাইজিং অ্যান্টিবডি না করে কিভাবে নিশ্চিত হওয়া সম্ভব সংগৃহীত প্লাজমা করোনাভাইরাসের অ্যান্টিবডি যুক্ত ৪. নিউট্রালাইজিং অ্যান্টিবডি না করে বিশ্বের কোনো ট্রায়াল সম্পন্ন হয়েছে কি ৫. সংগৃহীত প্লাজমা করোনাভাইরাস মুক্ত কিনা সেটির নিশ্চয়তা কি?

এ প্রসঙ্গে ন্যাশানাল ইন্সটিটিউট অব সোশ্যাল অ্যান্ড প্রিভেন্টিভ মেডিসিনের (নিপসম) জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও ভাইরোলজিস্ট ডা. মোহাম্মদ জামালউদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, ১৯৫৪ সাল থেকে বিভিন্ন জীবাণুর আক্রমণের শিকার রোগীদের শরীরে প্লাজমা প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। কিন্তু যখনই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসে তখন এটি বন্ধ হয়ে যায়। অর্থাৎ যে কোনো ধরনের ইনফেকশাস ডিজিজ কন্ট্রোলে প্লাজমা প্রয়োগ একটি পরীক্ষামূলক পদ্ধতি।

কোনো রোগের ক্ষেত্রেই প্লাজমা সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা পদ্ধতি হিসেবে স্বীকৃত নয়। এছাড়া বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বারবার বলেছে, প্লাজমা থেরাপিকে ট্রায়াল হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে কিন্তু চিকিৎসা পদ্ধতি হিসেবে নয়। অথচ আমাদের দেশের একদল চিকিৎসক এটিকে চিকিৎসা হিসেবে উল্লেখ করে রোগীদের বিভ্রান্ত করছে। এ পদ্ধতিতে ক্রিটিক্যাল কন্ডিশন থেকে যে রোগী ফিরে আসছেন বা বেঁচে যাচ্ছেন তিনি জীবনের বাকি দিনগুলোয় অন্য এক প্রাণঘাতী ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে বেঁচে থাকবেন বা করুণ মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাবেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যে দেশে যে ভাইরাসজনিত রোগের প্রকোপ বেশি সে দেশে নিরাপদ রক্ত সঞ্চালনের ক্ষেত্রে রক্ত বা তার উপাদান সে ভাইরাস থেকে মুক্ত কিনা তা অবশ্যই র‌্যাপিড টেস্ট নয় মলিকিউলার টেস্টের মাধ্যমে নিশ্চিত করতে হবে।

এটি না করে কোনোভাবেই রক্ত পরিসঞ্চালন করার সুযোগ নেই। যদিও বাংলাদেশে হামেশাই এটি ঘটে থাকে। তাছাড়া সব র‌্যাপিড টেস্টের সক্ষমতা সমান নয়। আমাদের দেশে সম্প্রতি সিডিসির তত্ত্বাবধানে হেপাটাইটিস ‘বি’র দেশব্যাপী প্রকোপের ফলাফলে ভয়ংকর হিসাব মিলেছে। বিশেষ করে মলিকিউলার টেস্ট না করে যারা শুধু র‌্যাপিড টেস্টের ওপর নির্ভর করেছেন তারা ঝুঁকিতে রয়েছেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ পর্যন্ত দেশে যে প্রক্রিয়ায় করোনা আক্রান্ত রোগীদের শরীরে প্লাজমা প্রয়োগ করা হয়েছে, তাদের মধ্যে ৭০ থেকে ৮০ ভাগের মৃত্যু হয়েছে। বাকি ২০ থেকে ৩০ ভাগ রোগী সুস্থ হয়েছেন। যারা সুস্থ হয়েছেন তাদের প্লাজমা না দিলেও সুস্থ হতেন বলে মনে করছেন তারা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here