করোনার প্রেক্ষাপটে বিনিয়োগ সম্ভাবনা

0
303
করোনার প্রেক্ষাপটে বিনিয়োগ সম্ভাবনা

খবর৭১ঃ দেশের জাতীয় আয় বৃদ্ধি তথা অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য বিনিয়োগের (অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক) ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মূলত অভ্যন্তরীণ ভোগচাহিদা, বিনিয়োগ ও সরকারি খরচের সমন্বয়েই জিডিপি গড়ে ওঠে। বৈদেশিক বাণিজ্যের ব্যালেন্সও জাতীয় আয়ের একটি উপাদান।

বাংলাদেশের বিনিয়োগ ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ষাটের দশকে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে বৃহৎ শিল্পে বিনিয়োগের মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রচেষ্টা নেয়া হয়। দেশে সোনালি আঁশ পাটের উৎপাদন ও ফলন পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি হওয়ায় এবং চট, বস্তা, ব্যাগ ইত্যাদি পাটজাত দ্রব্যের বিশ্বব্যাপী চাহিদার ফলে অসংখ্য পাটকল গড়ে ওঠে।

এ ছাড়া পশ্চিম পাকিস্তানে উৎপাদিত তুলা ও বিদেশি তুলা আমদানির মাধ্যমে ব্যবহার করে বস্ত্রকলেরও বিস্তার ঘটে। এর পাশাপাশি কুটির শিল্পের মাধ্যমে দেশে তৈরি কাপড় যেমন- শাড়ি, লুঙ্গি, গামছা, বিছানা ও গায়ে দেয়ার চাদর, সতরঞ্চি ইত্যাদির চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কুটির শিল্পও বিকাশ লাভ করে।

স্বাধীনতার পর পাট ও বস্ত্রকলের মতো বৃহৎ শিল্পগুলো ১৯৭২ সালে জাতীয়করণ করা হয়। বিশ্বব্যাপী পাটের তৈরি দ্রব্যাদির বিকল্প সিনথেটিক ব্যবহার জনপ্রিয় হওয়ায় আমাদের বড় বড় শিল্পগুলো অলাভজনক হয়ে পড়ে। স্বাভাবিকভাবেই বিকল্প হিসেবে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের বিকাশ ঘটতে থাকে। শুধু বস্ত্র তৈরির ক্ষেত্রেই নয়, ক্রমান্বয়ে কৃষি যন্ত্রপাতি, দৈনন্দিন ব্যবহার্য জিনিস তথা লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং দ্রব্যাদিও এসএমই’র মাধ্যমে উৎপাদিত হতে থাকে। আশির দশকে তৈরি পোশাক (রেডিমেড গার্মেন্টস) শিল্প দেশে একটি উল্লেখযোগ্য শিল্প হিসেবে পরিগণিত হয়; যা ক্রমান্বয়ে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ রফতানি পণ্য হিসেবে পরিগণিত হয়।

শিল্পের বিকাশের ফলে কৃষির ওপর নির্ভরশীলতা কমে গেলেও আধুনিক পদ্ধতি, যন্ত্রপাতি ও সার ব্যবহার করে সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় কৃষিরও ব্যাপক উন্নয়ন হয়। শিল্প ও কৃষির যুগপৎ উন্নয়নের ফলে জনবহুল একটি দেশের খাদ্য ও কর্মসংস্থানে কোনো অসুবিধা হয়নি। মানুষ অধিকহারে কাজ পাওয়ার কারণে অভ্যন্তরীণ ভোগচাহিদা বাড়তে থাকে। সংগঠিত ব্যবসাসহ স্ব-উদ্যোগে পরিচালিত ক্ষুদ্র ব্যবসার প্রসার লাভের ফলে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতিসঞ্চার হয়। সঙ্গত কারণে বিগত প্রায় তিন দশক দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে ইতিবাচক ধারা অব্যাহত থাকে এবং বিশ্বে বাংলাদেশ একটি উদীয়মান দেশ তথা ‘এ কান্ট্রি অব মিরাকল’ হিসেবে পরিগণিত হয়।

দেশের কর্মসংস্থান, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, অবকাঠামো উন্নয়ন, ভোগচাহিদা বৃদ্ধি ইত্যাদির ফলে অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগের পাশাপাশি বাংলাদেশে বৈদেশিক বিনিয়োগও উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। বলতে গেলে ভোগ্যপণ্যের বহুজাতিক কোম্পানিগুলো এ দেশে ভালো ব্যবসা করছে।

বিশ্বমন্দা, যুদ্ধ, মহামারী ইত্যাদি কারণে বিশ্ব অর্থনীতির গতি পরিবর্তনের ফলাফল বাংলাদেশকেও ছুঁয়ে যায়; কখনও কখনও আমদানি-রফতানি, ব্যবসা ও বিনিয়োগে পড়ে নেতিবাচক প্রভাব। গত প্রায় ছয় মাস ধরে সারা বিশ্বে নভেল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ও সংক্রমণের ফলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রায় স্থবির হয়ে আছে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো মহামারীতে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবহন, ভ্রমণ, পর্যটন ও হোটেল-রেস্তোরাঁ, পোশাক, ফ্যাশন, রফতানি পণ্য, রড, সিমেন্ট ও স্টিল খাতে উৎপাদন আগের তুলনায় কমে ৩০-৩৫ শতাংশে নেমেছে। এসব পণ্যের বিক্রয় কমেছে ৭০ শতাংশ।

২০১৯-২০ অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানি আয় কমেছে ৩৮ শতাংশ, শুধু এপ্রিলে কমেছে ৮০ শতাংশ। মহামারী বিস্তারের পর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৩০০ কোটি ডলার তৈরি পোশাক রফতানি আদেশ বাতিল হয়েছে। গত এপ্রিলে ৩৬০ মিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক রফতানি হয়েছে। ২০১৯ সালের এপ্রিলে রফতানি হয়েছিল ২.৪২ বিলিয়ন ডলার মূল্যের তৈরি পোশাক। বিগত বছরের তুলনায় এ বছর এপ্রিলে রফতানি কমেছে ৮৪ শতাংশ। পরবর্তী মাসগুলোর অবস্থা আরও খারাপ হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।

২০১৯ সালে প্রায় ছয় লাখ লোক চাকরি নিয়ে প্রবাসে গেছে। এ বছর বিদেশ যাওয়া দূরে থাক, লাখ লাখ শ্রমিক বেকার হয়ে দেশে ফিরেছে কিংবা দেশে ফেরার অপেক্ষায় রয়েছে। সঙ্গত কারণে রেমিটেন্স আসাও কমে গেছে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়ে জুন মাসে ৩৫ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। এর কারণ রেমিটেন্সের পাশাপাশি বৈদেশিক ঋণ ও অনুদানপ্রাপ্তি এবং আমদানিতে বৈদেশিক মুদ্রার ব্যবহার কম হয়েছে।

সংক্রমণের শুরুর দিকে আইএমএফ ঘোষিত ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক ২০২০ অনুযায়ী, ২০২০ সালে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হতে পারে ২ শতাংশ; যা ২০২১ সালে বেড়ে ৯.৫ শতাংশ হতে পারে বলে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে। কিন্তু এ বছর জুন মাসে বিশ্বব্যাংক যে গ্লোবাল ইকোনমিক প্রসপেক্টাস প্রকাশ করেছে, তাতে বাংলাদেশের ২০২০ সালের প্রবৃদ্ধি ১.৬ শতাংশ এবং ২০২০-২১ সালের প্রবৃদ্ধি আরও কমে ১ শতাংশ হওয়ার আশঙ্কা করা হয়েছে। তবে আগামী বছর বৈশ্বিক গড় প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৪ শতাংশ। তাদের ভাষায়, ৮০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড় মন্দায় পড়বে বিশ্ব।

বহির্বিশ্বের দেশগুলো থেকে তৈরি পোশাকের রফতানি আদেশ বাতিলের ফলে পোশাক খাতে প্রায় ৫০০ কোটি ডলার ক্ষতির আশঙ্কা করছে বিজিএমইএ। এ পরিস্থিতিতে কারখানাগুলো ৫৫-৬০ শতাংশ সক্ষমতায় চালিয়ে শতভাগ শ্রমিক রাখা সম্ভব নয়। পোশাক শিল্পে প্রায় ৪০ শতাংশ শ্রমিক বেকার হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। অন্যান্য শিল্প-কারখানা থেকেও শ্রমিক ছাঁটাই হচ্ছে। এমন কী দেশের বেসরকারি ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো কর্মী ছাঁটাই ও বেতন কমানোর পদক্ষেপ নিচ্ছে, যা খুবই উদ্বেগজনক।

এদিকে রাজধানী শহরে স্ব-উদ্যোগী বহু পেশাজীবী মানুষ কর্মহীন হয়ে গ্রামে ফিরে যাওয়ার খবর সংবাদপত্রে প্রকাশিত হচ্ছে। দেশের প্রায় চার কোটি দরিদ্র লোকের সঙ্গে ইতোমধ্যে আরও প্রায় দেড়-দুই কোটি লোক যুক্ত হয়েছে মর্মে অভিজ্ঞ মহলের ধারণা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here