করোনায় মৃত্যুরোধে আশার আলো

0
445
ঠাকুরগাঁও সদরে একজন ও হরিপুরে আরও একজন করোনায় আক্রান্ত !

খবর৭১ঃ করোনাভাইরাস সংক্রমণ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ায় ব্যাপক সংখ্যায় মানুষ কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। আমরা সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে প্রস্তুতি ও পদক্ষেপ নেয়ার যে অপূর্ব সুযোগ হাতছাড়া করেছি, তা নিয়ে আজ আঙুল কামড়াতে হচ্ছে।

আমাদের মতো স্বল্প সম্পদ ও ক্ষুদ্র সামর্থ্যরে জনপদের জন্য চিকিৎসার সুযোগ তৈরি করে সবাইকে উন্নত বিশ্বের মতো ব্যয়বহুল চিকিৎসার আওতায় এনে সারিয়ে তোলার চেষ্টা অসম্ভব কল্পনা ও দুঃসাধ্য বলতে হবে।

এ অবস্থায় উন্নত বিশ্বের নাজেহাল অবস্থা দেখে আশঙ্কার পারদ ক্রমশ চড়ছে। তবে পশ্চিমের ব্যর্থতায় হতাশ হয়ে হাত গুটিয়ে ফেলার কোনো যুক্তি নেই। আশার কথা, দেরিতে হলেও সবার টনক নড়েছে।

কোভিড-১৯ মোকাবেলার তোড়জোড়ে গতি দেখা যাচ্ছে। তবে সংক্রমণ প্রতিরোধের সহজ পথটি হারিয়ে চিকিৎসার উদ্যোগ গ্রহণ ও সঠিক পথ হারানোর আর সুযোগ নেই।

আইসিইউ, ভেন্টিলেটর, অক্সিমিটার ইত্যাদি অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে যে যথাযথ ও পরিপূর্ণ সমাধান নেই, তা আজ মানবজাতির কাছে পরিষ্কার হয়ে উঠেছে। ধনী-গরিব, উন্নত-অনুন্নত দেশ ও জনপদ নির্বিশেষে সবারই আপন-পরান-বাঁচা ধরনের ত্রাহি অবস্থা।

তবুও আশার আলো একেবারেই নিভে যায়নি। ফলে পুঁথি-পণ্ডিতের মতো জ্ঞান-বন্দি চিন্তার বেড়াজাল ও নির্ভরতা থেকে সরে এসে প্রজ্ঞার অসামান্য সম্ভাবনার দিকে হাত বাড়াতে হবে। অবজ্ঞা না করে হাতের কাছেই সন্ধান করা প্রয়োজন পরিত্রাণের উপযুক্ত সূত্র।

ইতিহাসজুড়ে আগের প্রজ্ঞা-সামর্থ্যরে প্রমাণ রয়েছে বিস্তর। প্রাণ বাঁচাতে পশ্চিমের জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তির সব উৎকর্ষতাকে হার মানিয়ে বাংলাদেশের খাবার স্যালাইন দৃষ্টান্তে অদ্বিতীয়। করোনাভাইরাস যেভাবে ব্যাপকহারে ছড়িয়ে পড়ছে, তাতে রোগাক্রান্তদের সংখ্যাও বাড়ছে পাল্লা দিয়ে।

এ মুহূর্তে আমাদের আক্রান্তদের ৮০ শতাংশ মৃদু মাত্রার রোগ নিয়ে যথাযথ ঘর-বন্দি বা আলাদা থাকলেও সামান্য উপশমমূলক ওষুধ সেবন করলে সহজেই রোগ নিরাময়ের আশা করা যায়।

তাদের এ মুহূর্তে পরীক্ষা করা ও হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা দেয়া নয়, বরং বাড়িতে ঘর-বন্দি তথা লকডাউন-আইসোলেশনে রাখাই উত্তম। তা সত্ত্বেও গুরুতর রোগে আক্রান্ত ২০ শতাংশ রোগী যাদের প্রায় সবাই শ্বাসকষ্ট আক্রান্ত হবেন, তাদের হাসপাতালে ভর্তি হতে হচ্ছে।

হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের এক সামান্য অংশের প্রয়োজন হয় ভেন্টিলেটর। বিরাট অংশের প্রয়োজন হবে শুধু অক্সিজেন। এ কারণে তারা হয়ে উঠতে পারে নতুন মাথাব্যথার কারণ।

করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে কিছু সংখ্যক রোগী ফুসফুসের নিউমোনিয়া জাতীয় সিন্ড্রোমে আক্রান্ত হয়। এদের ফুসফুসের অভ্যন্তরে পানি জমে এক ধরনের শ্লোথ গড়ে তোলে। ফলে ফুসফুসের স্তর ভেদ করে নিঃশ্বাসে নেয়া বাতাসের অক্সিজেনের রক্তে প্রবেশে বাধা তৈরি হয়।

রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ একটি বিশেষ মাত্রার নিচে নেমে গেলে হৃৎপিণ্ডের কাজ আকস্মিক বন্ধ হয়ে রোগী মৃত্যুবরণ করেন। রক্তের অক্সিজেনের মাত্রা কমে যাওয়াই কোভিড-১৯ বা করোনা আক্রান্ত মানুষের মৃত্যুর প্রধান কারণ।

এ কারণে এ জাতীয় রোগীর চিকিৎসায় ও জীবন বাঁচাতে শতভাগ অক্সিজেনের প্রয়োগ গুরুত্বপূর্ণ। এ অবস্থায় বাতাসের পরিবর্তে শতভাগ বিশুদ্ধ অক্সিজেন দেয়া হলে রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ বাড়ে। তবে কখনও কখনও বিশুদ্ধ বা শতভাগ অক্সিজেন দিলেও ফুসফুসে জমা পানির স্তরের বাধা পেরিয়ে যথামাত্রায় অক্সিজেন রক্তে প্রবেশ করতে পারে না।

এ অবস্থায় ফুসফুসের অভ্যন্তরে বাতাস বা অক্সিজেনের চাপ বাড়ানো গেলে অক্সিজেন প্রবেশ বাড়তে থাকে। রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা একটি নির্দিষ্ট মাত্রার ওপর রাখা গেলে হৃদযন্ত্র আকস্মিকভাবে অকেজো হওয়ার ও মৃত্যুর ঝুঁকি কমে।

ফলে উচ্চচাপে শতভাগ অক্সিজেন দেয়া কোভিড-১৯ রোগ নিরাময়ে খুবই কার্যকর। এর জন্য প্রয়োজন হয় বিপুল পরিমাণে শতভাগ অক্সিজেনের সরবরাহ ও তা প্রদানের উপযুক্ত ডিভাইস।

আর এ ডিভাইসটি পানি ও একটি সরু নলের মতো ঘরোয়াভাবে সহজলভ্য ও ফেলে দেয়া শ্যাম্পুর বোতলের মতো গৃহস্থালি বর্জ্য দিয়েই তৈরি করেছেন আইসিডিডিআর’বির উদ্ভাবনী চিকিৎসক ডাক্তার মোহাম্মদ জোবায়ের চিশতী, যা আপদ উত্তরণের এক সম্ভাবনাময় ডিভাইস।

বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণে শিশুদের নিউমোনিয়া নিরাময় ও জীবন রক্ষায় জাদুকরি হয়ে ওঠে এ ডিভাইসের ব্যবহার, মৃত্যুহার কমে যায় ৭৫ শতাংশ। এতে বোতলে পানি ভরে তাৎক্ষণিকভাবে তার মধ্য দিয়ে প্রশ্বাস নেয়ার একটি নল প্রবেশ করিয়ে দিলেই একটি অতি সাধারণ নিয়মে ফুসফুসের অভ্যন্তরে বাতাস বা অক্সিজেনের চাপ বেড়ে যায়।

এতে রক্তে অক্সিজেনের মাত্রাও বাড়তে থাকে। কমে আসে মৃত্যু ঝুঁকি। অক্সিজেন ব্যবহারের পরিমাণ কমে আসে, হয় সাশ্রয়ী। সামান্য কৌশলে ও রোগীর শয্যাপাশেই গড়ে তোলা যায় এ ধরনের ডিভাইস, যা কার্যকারিতায় অসামান্য ও মামুলি ব্যয়সাপেক্ষ।

গবেষণার পর্ব পেরিয়ে জাদুকরি এ ডিভাইস ব্যবহারের ফলাফল ২০১৫ সালে প্রকাশিত হয় বিশ্ব বরেণ্য মেডিকেল জার্নাল ল্যানসেটে। সংবাদ মাধ্যমের কল্যাণে দেশবাসীও এ অসামান্য উদ্ভাবনের খবর পায়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও এ ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে নিউমোনিয়া গাইডলাইন নবায়নের উদ্যোগ নেয়। ইথিওপিয়া, নেপাল ও মিয়ানমারে এর ব্যবহার শুরু হয়েছে।

আজকের বিশ্বময় হাহাকার পরিস্থিতিতে শ্যাম্পুর বোতল দিয়ে তৈরি এ অসামান্য ডিভাইস হতে পারে পরিত্রাণ ও কল্যাণের সুপ্রশস্ত মহাসড়ক। খাওয়ার স্যালাইনের মতো এ দরিদ্র জনপদের মেধাবী সন্তানদের পক্ষ থেকে তা হতে পারে বিষম দুর্বিপাকে পড়া সভ্যতা ও মানবজাতির জন্য এক অনন্য উপহার, এক অনবদ্য জীবণাস্ত্র। মহান সৃষ্টিকর্তার অনুগ্রহে তুচ্ছেই নিহিত থাকতে পারে প্রকাণ্ডের সমাধান।

ঈশপের গল্পের সিংহকে মুক্ত করার ইঁদুরের অভিনব কৌশল ও কৃতিত্বের মতো চিশতীর নতুন গল্প হতে পারে আগামীর শিশুদের জন্য অভাবনীয় জীবন-উপজীব্য, সভ্যতার অন্যতম মূল্যবান শিক্ষা।

মানবজাতিকে জানানো হয়েছে যে মহান সৃষ্টিকর্তা কোনো কিছুকেই মিছেমিছি সৃষ্টি করেননি। মাটিতে সমস্যার সমাধানে ইতালির প্রধানমন্ত্রীর আকাশের আশ্রয়প্রাপ্তির অসহায় আকুতি দেখেছে বিশ্ব। এ অবস্থায় মানুষের ছোট প্রচেষ্টাকেও অবহেলা করার সুযোগ নেই। ভুলে গেলে চলবে না যে, ধনী ও দরিদ্রের প্রাণের মূল্য একই।

অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম : সাবেক ডিন, সার্জারি অনুষদ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here